আমাদের এলাকার গ্রামের মানুষের কাছে বাস্তবিকই স্বপ্ন যে তাদের চোখের সামনে একজন চিকিৎসক এসছেন সুদুর কলকাতা টেগোর পার্ক থেকে শ্রমলক্ষ্মী কলোনীর এই দ্বিজেন চক্রবর্তী স্মৃতি সেবা সদনে চিকিৎসা পরিষেবা দিতে। আপাতত ভাবে দন্ত পরিষেবা হলেও এলাকার বহু মানুষ অধীর প্রতিক্ষায় আছেন এই সেবা সদনে দন্ত চিকিৎসার পরিষেবার পাশাপাশি অন্যান্য সামগ্রিক চিকিৎসা পরিষেবা কবে থেকে পাবেন এই আসায়।
প্রক্রিয়া চলছে অন্তত সাপ্তাহিক না হলেও এই মুহূর্তে মাসে অন্তত একদিন করে মেডিকেল ক্যাম্প চালানোর জন্য যদি কোনও চিকিৎসক বন্ধুদের সহযোগিতা পাওয়া যায়। আমরা ভরসা রাখি নিশ্চয়ই কেউ না কেউ আমাদের এই প্রয়াসকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে আমাদের উৎসাহিত করবেন। ছোট্ট পায়ে পথ চলার শপথ নিয়ে আমাদের এই উদ্যোগের সমস্ত ভাবনাই ছেড়ে দিয়েছি আমাদের অভিভাবক চিকিৎসক বন্ধুদের উপর।
আপাতভাবে প্রতি মঙ্গলবার বিকেল চারটে থেকে চলছে নিয়মিতভাবে যেকোনো দন্ত চিকিৎসার পরিষেবা। পরিষেবা দিচ্ছেন দন্ত রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শর্মিষ্ঠা রায়। এই দু’ মাসেই ডা.শমিষ্ঠা রায় আমাদের এলাকার মানুষের কাছে হয়ে উঠেছেন ডা. দিদি। আপাতভাবে এই মুহূর্তে গড়ে ৮ – ৯ করে প্রতি সপ্তাহেই কেউ না কেউ এই পরিষেবা নিতে আসছেন।
এমনই একজন গতকাল ২২ ফেব্রুয়ারি সোজা হয়ে হাঁটতে না পারা আমাদের পাড়ারই এক জ্যেঠিমা তার ছেলের মোটর ভ্যানে করে হাজির। মুখের ডানপাশে ব্যথা। দূরে গিয়ে ডাক্তার দেখানোর সামর্থ্য নেই। এমনকি চলার শক্তিও নেই। তাতে কি? রাস্তাতেই চিকিৎসা পরিষেবা চললো। প্রতিদিনের ছবি সেভাবে আর এখন ফেসবুকে দেওয়া হয় না। বলতে পারেন ইচ্ছে করেই পোষ্ট করিনা। কি হবে নিজেদের এই ক্ষুদ্র প্রয়াসকে বড় করে দেখানোর। কিন্তু বিশ্বাস করুন ২২ ফেব্রুয়ারির এই ছবিটা না পোষ্ট করে আর থাকতে পারলাম না। আমাদের কাছে এও এক স্বপ্ন এই পরিষেবা দেখতে পাওয়ার।
গত ২ জানুয়ারি ২০২২ শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ এবং ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির অশোকনগর শাখার যৌথ উদ্যোগে দ্বিজেন চক্রবর্তী স্মৃতি সেবা সদনের আনুষ্ঠানিক উদ্ভোধন হয়।
এই দিন আনুষ্ঠানিক উদ্ভোধন হলেও আমাদের অশোকনগর শাখার পক্ষ থেকে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক প্রচার কর্মসূচির উদ্যোগ নেওয়া হয় গত ২০২১ সালের ইংরেজি মে মাস থেকে। সেই সময় আদিবাসী এলাকা সহ পাশ্ববর্তী গ্রামগুলিতে চলে এলাকার মেহনতী মানুষের ব্লাড প্রেসার সহ অক্সিজেন স্যাচুয়েশন মেপে দেখা। অসুস্থ রোগীদের আমাদের এখানকার মুল ক্লিনিক বারাসাত সিটিজেনস ফোরামে নিয়ে এসে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া। পাশাপাশি ব্লাড প্রেসারের রোগীকে প্রয়োজনীয় প্রেসারের ওষুধ ব্যবস্থা করে দেওয়া – মুলত এই কাজগুলোই অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক প্রচার কর্মসূচির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলো। পরবর্তীতে এলাকার মানুষের বিশেষকরে কোভিড পরিস্থিতির কারণে স্বাস্থ্য পরিষেবার চাহিদা দিন কে দিন বাড়তে থাকে। আনন্দের বিষয় এই চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে সেই মুহুর্তে কিছুটা স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়া সম্ভব হয়েছিলো শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের চিকিৎসক বন্ধুদের আন্তরিক সহযোগিতায় এবং তা মুলত টেলি মেডিসিনের মাধ্যমে। পরবর্তীতে বলা চলে ধীরে ধীরে এলাকার সাধারণ মানুষের আন্তরিক সহযোগিতায় আমরা গড়ে তুলতে সক্ষম হই আমাদের ছোট্ট এই সেবা সদন।
‘
স্বাস্থ্য মোদের ভিক্ষা নয় স্বাস্থ্য মোদের অধিকার’ – এই স্লোগানকে সামনে রেখেই আমাদের এই পথ চলা। এই চলার পথের সঙ্গি হয়ে নবগঠিত দ্বিজেন চক্রবর্তী স্মৃতি সেবা সদন শুধু মাত্র একা নয় এই চলার পথের সঙ্গি আরও বেশ কিছু সংগঠনও। ৯০ দশকে চেঙ্গাইলে গড়ে ওঠা শ্রমিক কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্রকে ঘিরে ইতিমধ্যেই পশ্চিম বঙ্গের কয়েকটি জায়গায় চলছে যুক্তিসংগত এই মেডিক্যাল ক্যাম্প। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য যেমন আছে জলপাইগুড়ি ওয়েলফেয়ার সহ যুক্তিবাদী সমিতির মাথাভাঙা শাখার ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় ঝঙ্কার ক্লাবে মাসিক মেডিকেল ক্যাম্প। পাশাপাশি রয়েছে সহযোগী সংগঠন স্বাস্থ্য শিক্ষা নির্মাণ পরিচালিত এবং বন্ধু সংগঠন অভিজিত মিত্র মেমোরিয়াল সোসাইটি (AMMCS)-র পরিচালনায় ঢালাসানে এই কর্মপ্রয়াস। অন্য দিকে বাঁকুড়ায় বেলিয়াতোড়ে মদন মোহন স্মৃতি স্বাস্থ্য কেন্দ্র, মিনাখাঁর গোয়ালদহে, নৈহাটি, এমনকি সল্টলেকের এক বস্তি অঞ্চলেও চলছে এই রকম উদ্যোগ।
প্রতিটি স্বাস্থ্য পরিষেবার দেওয়ার এই চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো বলতে পারেন, ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ এই দাবির স্বপক্ষে এক একটি লড়াইয়ের খুঁটি। এমনকি এক একটি মডেলও। আমরা বিশ্বাস রাখি এই খুঁটি যত মজবুত হবে দমকা হাওয়ায় তা ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা ততই হবে ক্ষীণ। সত্যিই কি আধুনিক সঠিক যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব ? জানি এই প্রশ্ন অনেকের। আমরা বলি হ্যাঁ সম্ভব, তার উদাহরণ অনেক আছে। পৃথিবীর বেশ কিছু দেশ এই পরিষেবা দিতে সামর্থ্য হয়েছে।
এই স্বাস্থ্য পরিষেবার মডেলগুলোর মাধ্যমে সরকারের কাছে বার্তা দেওয়া– দেখুন, স্বল্প মুল্যে আধুনিক যুক্তিসম্মত চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া সম্ভব। বড় বড় কর্পোরেট হাসপাতাল নয় সদিচ্ছা থাকলে ছোট্ট পরিকাঠামোর মধ্যেও বেশ কিছু স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়া সম্ভব। পাশ্ববর্তী শ্রীলঙ্কার মতো দেশ যদি সবার জন্য স্বাস্থ্য চালু করতে পারে তবে আমাদের দেশে কেনও এটা সম্ভব নয় ? শ্রীনাথ রেড্ডির নেতৃত্বাধীন উচ্চ স্তরীয় বিশেষজ্ঞ দলের রিপোর্টে তো পরিষ্কার উল্লেখ ছিলো আমাদের দেশেও সবার জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবা সম্ভব।
পরিশেষে বলি আমরা মনে করি চিকিৎসা পরিষেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষের কাছেও জোরের সাথে এই বার্তাও তুলে ধরা কর্পোরেট লবির স্বাস্থ্যরক্ষার্থে আমরা চাইনা কোনও স্বাস্থ্য বীমা। আমাদের দাবি হওয়া উচিত একটাই ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ – এই দাবিতে সামনে রেখেই দ্বিজেন চক্রবর্তী স্মৃতি সেবা সদনের পথ চলা।