আমার আগের লেখায়, একটি ছোট হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় এক মহান নেতার মহানুভবতার কথা লিখেছিলাম, এবারও সেই হাসপাতালের আর এক নেতার দার্ঢ্যের কথা বলব।
ইনি হাসপাতালের অফিসে করণিকের পদ আলোকিত করে ছিলেন। আগের রেডিওগ্রাফার ভদ্রলোকের মতো এঁর দাপটে ব্যাঘ্র ও বৃষভ একত্রে নীর পান না করলেও, তরক্ষু ও মেষ হামেশাই একাসনে বিশ্রম্ভালাপ করে থাকে বলে জনশ্রুতি। এক প্রখর গ্রীষ্ম দিনে দুপুর বেলায় হাসপাতালের আপৎকালীন বিভাগে, একটি হাতে আঘাতের রোগী এল। পাশেই কারখানা থাকার জন্য এই ধরনের রোগী প্রায়ই আসত। আমায় ফোন করে জানালে, ওখানে গিয়ে দেখি তেল, ময়লা, কালি মাখা রক্তাপ্লুত হাতে রোগী যন্ত্রণায় চিৎকার করছে।
দ্রুত ওকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যেতে বললাম। অপারেশন টেবিলে তুলে রোগীর হাত কিছুটা পরিষ্কার করে লোকাল ব্লক অ্যানাস্থেসিয়া দিয়ে অবশ করে দিলাম। রোগীর চীৎকার বন্ধ হলো। এবার ভালো করে পরীক্ষা করে দেখি রোগীর ডান হাতের মধ্যমার অগ্রভাগ পুরো গুঁড়িয়ে গেছে, নখ এবং হাড় টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, চামড়া এবং অন্যান্য টিস্যুর অবস্থাও তথৈবচ। কর্মরত অবস্থায় আঘাত লেগেছে বলে গোটা হাত তেল,কালি,ময়লায় মাখামাখি।
ভালো করে স্যাভলন আর স্যালাইন দিয়ে ক্ষতস্থান ধুয়ে পরিস্কার করলাম। তারপর অনেক সময় নিয়ে ময়লার প্রতিটি কণা ফরসেপস্ দিয়ে পরিষ্কার করলাম। থেঁতলানো মৃত টিস্যুগুলি আস্তে আস্তে বাদ দিলাম। এবার বিশেষ ধরনের ‘নেল রিপোজিসান স্টিচ্’ দিয়ে নখের আঘাতের রিপেয়ার করলাম। তারপর অন্যান্য সমস্ত ক্ষতস্থানগুলি রিপেয়ার করে দিলাম। এতক্ষণে আঙ্গুলের চেহারা একটু ভদ্রস্থ হলো।
রোগী এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ওকে ঘুম থেকে তুলে হাতের চেহারা দেখালাম। বললাম, আমার পক্ষে যতটা করা সম্ভব আমি করেছি, কিন্তু এই আঙ্গুলটি যে ভাবে থেঁতলে গুঁড়িয়ে গেছে তাতে আঙ্গুলটির কিছু অংশের রক্ত চলাচলও দারুণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, ফলে সেই অংশটি পচে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই প্রবল। তাই যদি হয় তা দু এক দিনের মধ্যেই বোঝা যাবে। তখন আঙ্গুলের সেই পচে যাওয়া অংশটি কেটে বাদ দিতে হবে।
এবার ক্ষতস্থানটি বিশেষ ভাবে ব্যান্ডেজ করে দিলাম, একটু চামড়ার অংশ ফাঁকা রেখে, যাতে পরবর্তী কালে রক্ত চলাচল পরীক্ষা করা যায়। রোগীকে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হল। পরদিন দুরুদুরু বক্ষে রাউন্ডে গেলাম। প্রথমেই ওই আঙ্গুলটি পরীক্ষা করলাম, দেখলাম ওই চামড়ার খোলা অংশটি কালো হয়ে যায় নি, লালই আছে। বুকে একটু বল এলো, আমার সমস্ত পরিশ্রম বোধহয় বৃথা যাবে না। পরদিন ওই রোগীর ব্যান্ডেজ খুললাম, দেখলাম ক্ষতস্থান ঠিকই আছে, আর আঙ্গুলও পচে যায় নি। নতুন করে ড্রেসিং করে আমার অস্থিশল্যচিকিৎসার আউটডোরে চলে গেলাম।
ম্যারাথন আউটডোর শেষ করে সেদিনের সব প্ল্যাস্টার, ড্রেসিং ইত্যাদি সাঙ্গ করতে বেলা গড়িয়ে গেল। তারপর ডিউটি রুমে আমার টিফিন বাক্স খুলে দেখি ওই গরমে আমার ভাত তরকারি পচে উঠেছে, এটা প্রাত্যহিক ব্যাপার, ওটাই খেতে শুরু করার প্রায় সাথে সাথেই জনা কুড়ি সঙ্গীসাথী নিয়ে ওই নেতার প্রবেশ।
কারখানা খুবই কাছে হওয়ার জন্য এইসব চমকানোর কাজে লোকজনের অভাব হতো না। আগে প্রাণ কে করিবে দানের জন্য একটি ফোন কলই যথেষ্ট ছিলো। ঘরে ঢুকেই জনৈক সঙ্গীর গর্জন ‘ এই যে (ছাপার অযোগ্য), রোগী ওদিকে বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে আর এই (ছাপার অযোগ্য) এখানে বোSe বোSe আয়েS মারাচ্ছে। আমি একটু অবাকই হলাম। আজ রাউন্ডে তেমন ছটফট করার মত রোগী তো দেখিনি। তাহলে কী কোন নতুন রোগী ভর্তি হল, যাকে আমি দেখিনি।
জিগ্যেস করলাম ‘কোন রোগী’? জবাবে যা বুঝলাম আমার সেই তিন দিনের পুরনো হাতের আঘাতের রোগীর জন্যেই ওঁদের এই অপরূপ প্রয়াস। এই মারমুখী জনতার সামনে একটু কুণ্ঠিত হয়েই বললাম ‘ ওই রোগীর অপারেশন তো সেদিনই করে দিয়েছি আর রোগীতো মোটামুটি এখন অবধি ঠিকই আছে ‘। চোপ্ ( ছাপার অযোগ্য ) । এবার নেতা অবতীর্ণ হলেন। বললেন যে ‘ আপনি একজন সাধারণ অস্থিশল্যচিকিৎসক হয়ে আপনার এতখানি স্পর্ধা হয় কি করে, যে আপনি হাতের আঘাতের অপারেশন করেছেন, এ বিষয়ে আপনার কী অভিঞ্গতা আছে ? জানেন এসব প্লাস্টিক সার্জারি ছাড়া হয় না? ওই অপারেশন করে যে অন্যায় আমি করেছি তার যথাযথ বিচার ওঁরা করবেন এবং যথোপযুক্ত শাস্তি ও আমার হবে । আমার ক্ষুদ্রত্ব সম্পর্কে আমার নিজের কখনোই সন্দেহ ছিলো না। কিন্তু গত দশ বারো বছর ধরে কয়েক হাজার হাতের আঘাতের চিকিৎসা এই অধম করতে বাধ্য হওয়ায় (অন্য কোন সহকর্মী এর চিকিৎসা করতে অপছন্দ করায় এবং অন্য কোথাও পাঠানোর উপায় নেই বলে ) সামান্য কিছু অভিঞ্গতা আমার যে ছিলো না, তা নয়। সে যাই হোক ,আরো কিছুক্ষণ আমায় অপরূপ বাক্যবিন্যাসে স্নাত করে এই বলে বিদায় নিলেন যে ‘ যদি ওই রোগীর হাতের কিছু হয়, তাহলে তারাপদ রায়ের ভাষায় ‘ আমার টেংরি লেংরী করে দেবেন ‘ । ক্ষুধার জ্বালা থাকা সত্ত্বেও ‘ মেজদিদি’ র ‘কেষ্ট’ র মত ‘ ‘ কদন্ন নিঃশেষ করিয়া ‘ খাওয়া আর সম্ভব হলো না, ভাত আর গলা দিয়ে নামল না । হাত ধুয়ে তাড়াতাড়ি ওয়ার্ডে গেলাম, দেখি নেতা বর্ণিত ‘ বিছানায় শুয়ে ছটফট ‘ করা রোগী গভীর নিদ্রা মগ্ন। ওঁর সুগভীর সুসুপ্তি ভঙ্গ করে জিগ্যেস করলাম , ‘ ওঁর কী কষ্ট হচ্ছে’ ? ‘ কই কিছু না তো ‘ উনি জবাব দিলেন । ‘ আপনি কি আমার বিরুদ্ধে ইউনিয়নে অভিযোগ করেছিলেন ? আপনার চিকিৎসা ঠিক মতো হচ্ছে না বলে ? ‘ইয়ে মানে ওই আর কি ‘ । ধীরে ধীরে সেখান থেকে চলে এলাম । এরপর প্রতিদিন ওই রোগীকে রাউন্ড দিয়েছি , একদিন অন্তর ড্রেসিং করেছি অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গিয়ে। আমার হাতের আঘাতের প্রতিটি রোগীকেই আমি চিরকাল নিজে ড্রেসিং করেছি, কারণ এতে ক্ষতস্থানের দৈনিক উন্নতি বা অবনতি নিজে বোঝা যায়, অন্যের মুখে ঝাল খেতে হয় না। প্রতি ড্রেসিং এই দেখতাম ক্ষতস্থান ধীরে ধীরে শুকিয়ে আসছে। যেহেতু প্রাথমিক অবস্থায় ক্ষতস্থানে অনেক তেল, ময়লা ইত্যাদি ছিল, এই ক্ষত বিষিয়ে ওঠার প্রভূত সম্ভাবনা এর ছিল । ভাগ্যক্রমে তা হয়নি। প্রায় দিন পনের পরে এঁর ক্ষত সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেলে এঁনাকে ছুটি দিয়ে দিলাম । ওষুধপত্র সব বুঝে নিয়ে উঁনি যখন চলে গেলেন, অপসৃয়মান ওই রোগীর দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। এই রোগীর গুঁড়িয়ে যাওয়া আঙ্গুলটি ভাগ্যক্রমে আমি বাঁচাতে পেরেছি, পুরষ্কার হিসেবে পেয়েছি কিছু পরুষ বাক্য আর চূড়ান্ত অপমান । যদিও আমার মতো নগন্য মানুষের খুব বেশি মান অপমানবোধ না থাকাই শ্রেয় তবুও কোথাও রক্তক্ষরণতো হয়। তাকে অস্বীকার করি কি করে। ভেসে ওঠে ‘সুবর্ণরেখা’ র সেই সংলাপ, ‘ রাত কতো হলো ? উত্তর মেলে না ‘। তাই আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী, ব্যাথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি আমি।
সত্যি খুব খারাপ লাগছে।দেশে দুঃসময় চলছে বহুদিন যাবৎ( অতিমারির কথা বলছি না, অপশাসন এর কথা বলছি)। তার একটা ফলশ্রুতি আপনার এই লাঞ্ছনা।
অনেক ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন।
এভাবে চলে! আর কতদিন! কত সহ্য করতে হবে?!
তোর আমার মত গণশত্রুরা আর কিই বা চাইতে পারি? খুব ভালো থাকিস।
আসল কথা, যাহারা দশের মতো, বিনা কারণে দশের সঙ্গে তাহাদের বিরোধ বাধে না। কিন্তু মানুষের ভিতরকার দীপ্যমান সত্যপুরুষটি স্থূলতা ভেদ করিয়া যখন দেখা দেয় তখন অকারণে কেহ-বা তাহাকে প্রাণপণে পূজা করে, আবার অকারণে কেহ-বা তাহাকে প্রাণপণে অপমান করিয়া থাকে।
ঠিক, অনেক ধন্যবাদ।
সর্বত্র এই এ্যাকই অবস্থা। এই সব অপমান গায়ে মাখলে হবে না-আপনি এক মহান পেশায় যুক্ত।
কিন্তু কখনও তো ধারাবাহিক আক্রমণ সহ্যের বাইরে চলে যায়।
ঐ যে রাস্তার নিরীহ কুকুরটা আছে-যাকে সবাই ঢিল মেরে যায়, কানের কাছে বাজি ফাটায়,ল্যাজে দড়ি দিয়ে ভাঙা টিন আটকে দ্যায় বা ফুলঝুরি বেঁঁধে দ্যায়, তার মতোই একদিন পাড়াছাড়া হতে হয়।
সেই, আপনিতো নিজে অসংখ্য অপমান সয়ে নীলকণ্ঠ। খুব ভালো থাকবেন।
আপনিতো অসংখ্য অপমান সহ্য করে নীলকণ্ঠ হয়ে আছেন। অনেক ধন্যবাদ, খুব ভালো থাকবেন।
নেতার যন্ত্রণা সম্ভাব্য মৃত্যুর
আহতের যন্ত্রণা ক্ষণিকে
ডাক্তারের যন্ত্রণা সেবার ,
আসলে ব্যাধি অনেক গভীরে সমাজের।
উপস্থাপনা দারুন।
অনেক ধন্যবাদ।
অনেক ধন্যবাদ, খুব ভালো থেকো।
লেখাটা পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম অনেক কথা । বারবার মনে হচ্ছিল আমরা অতি সাধারণ যারা ডাক্তার দেখাই ডাক্তার নিয়মমতো বাঁধা কিছু প্রশ্ন করেন । কিছু দেখেন যন্ত্রপাতি দিয়ে । এরপর দুর্বোধ্য অক্ষরে ( প্রায়শই ) খসখস করে প্রেসক্রিপশন লেখেন । কর্ম শেষ হলে ।
– আচ্ছা আসি
-আসুন।
কিন্তু আমি ঐ যন্ত্রবৎ চিকিসকের মধ্যে একটি মানুষ খুঁজেছি চিরকাল । পেয়েছি । কীভাবে ?
চিকিৎসক :- বাচ্চা কে গলা ভাত দেবেন ।
আমি :- একটা কথা বলব সাহস করে ?
চিকিৎসক :- বলুন।
আমি :-আচ্ছা শিশু বিশেষজ্ঞ রা কখনও শিশুদের খাইয়েছেন ?
চিকিৎসক :- হো হো ।
আমি :- হি হি
মন বলল ঐ দেখ একজন মানুষ আছেন চিকিৎসকের ভেতর !
এ লেখা আমায় চুম্বকের মতো আটকে রাখছে। একজন পেশেন্টকে নিয়ে চিকিৎসক উদ্বিগ্ন । দুরুদুরু বুকে পেশেন্টের খবর নিতে যাচ্ছেন । আঘাত পাওয়া আঙুলটি শেষ পর্যন্ত কেটে বাদ দিতে হবে না তো ? এ তো পেশেন্টের নিকট আত্মীয়রা ভাবেন ?
তারপর যারা চিকিৎসকদের এরকম হেনস্থা নিপীড়ন নির্যাতন করে, এর কি কোনো বিহিত নেই ? কেন এর কোনো সুরাহা হবে না ?
সব শেষে আবিষ্কার করলাম চিকিৎসক মানুষটি আমার যেন বড় চেনা । এ তো আমাদের অনিরুদ্ধ কলকাতা মেডিকেলের কলেজের ।
অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন ড. অনিরুদ্ধ কীর্তনীয়াকে ।
অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
Satti kato nirbodh amra sobai ek ek jon nijer mato kore ek ek jaigai bhinnyo bhinnyo roop e. Spordha eto dur je bhalo kharap er tophat bujhina. Naki bujheo bujhina. Eta abokhya na asfalon? Darun laglo…aro aro likhun Sir…..
অনেক ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন।
অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।