আমি পাঁচু মাহাতো। পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলমহল অঞ্চলের পিড়াকাটা গ্রামে বাড়ি। নিজের আসল নামটা লিখলাম না বিশেষ কারণে। আগে ব্যাপারটা বলে নিই। তারপর আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন আসল নাম না বলার কারণ।
আমাদের জঙ্গলমহল অঞ্চলে বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের রোগজ্বালায় ভরসার জায়গা ছিল শালবনী সুপারস্পেশালিটি হাসপাতাল। অল্প দিনের মধ্যেই প্রচুর ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ হয়। রমরমিয়ে শুরু হয় নতুন, নতুন বিভাগ। হাসপাতালের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা আর চিকিৎসা পরিষেবার কথা দিকে দিকে ছড়িয়ে যায়। বহুবার অনেক আশঙ্কাজনক রোগী সুস্থ করে সংবাদপত্রের শিরোনামে উঠে আসে আমাদের হাসপাতাল। আমরা গ্রামের গরীব লোক। সামান্য কিছুতেই মেদিনীপুরে বড় হাসপাতাল ছুটতে হ’ত। বাড়ির কাছেই এরকম চিকিৎসা আর কর্মীদের আন্তরিকতায় আমরা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছিলাম। রোজ আউটডোরে ভিড় উপচে পড়তো। ভরা মরশুমে ১১০০-১২০০ রোগী আউটডোর পরিষেবা পেতেন। ইনডোর বেড ছাপিয়ে মেঝেতে। রক্ত পরীক্ষা, বুকের ছবি, পেটের ছবি, ইসিজি, ইত্যাদি সবকিছুই এখানেই হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ওই যে বলে না.. গরীবের কপালে সুখ সয় না। হঠাৎ একদিন শুনলাম হাসপাতাল জিন্দাল গোষ্ঠীর হাতে চলে যাচ্ছে। তখন কিছু লোকে আমাদের উল্টো বোঝাচ্ছিল বটে কিন্তু আমরা তখনই সিঁদুরে মেঘ দেখছিলাম। যদিও বলার উপায় ছিল না। বললে আমাদের বাড়ি-ঘর আর ঘাড়ের ওপর মাথা আস্ত থাকতো না।
তারপর কিছুদিন দেখলাম সরকারি ডাক্তার-নার্সদের সাথে জিন্দাল গোষ্ঠীর ডাক্তার-নার্সরাও ডিউটি করতে শুরু করলেন। আমাদের নেতারা বুঝিয়েছিলেন, উন্নততর পরিষেবা দেওয়ার জন্যই জিন্দাল গোষ্ঠী এসেছে, কিন্তু বাস্তবে হ’ল উল্টো। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম – ডাক্তারদের অধিকাংশই মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ থেকে ‘খেপ খাটতে’ এসেছে অর্থাৎ হাউসস্টাফশিপ করতে করতে কয়েক ঘন্টার জন্য এই হাসপাতালে এসে কাজ করে আর ঘন্টা হিসেবে টাকা পায়। আমার এক ভাইপো ডাক্তার। সেই সুবাদে আমি জানি, হাউসস্টাফশিপ করতে করতে এভাবে অন্য হাসপাতালে কাজ করা বে-আইনি। তাছাড়া মেডিসিনের ডাক্তার বলে যাঁকে দেখানো হচ্ছিলো তাঁর মেডিসিনের কোনও ডিগ্রি নেই। তার বদলে হাবিজাবি যেসব ডিগ্রি আছে সেগুলো আমরা কোয়াক ডাক্তারের নামের পাশে দেখতেই অভ্যস্ত। পেডিয়াট্রিক্সের ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন নিয়ে হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীরাও হাসাহাসি করতেন। অন্যান্য সব বিভাগেই এক অবস্থা। যদিও তখনও আমাদের অগতির গতি সরকারি ডাক্তাররা ছিলেন। আমরা তাঁরা ডিউটিতে থাকলে জিন্দালের ডাক্তারদের কাছে কখনোই যেতাম না। একদিকে সরকারি ডাক্তারদের কাছে ভিড়, অন্যদিকে জিন্দালের ডাক্তার মাছি তাড়াতেন। নার্সদের ক্ষেত্রেও তাই। জিন্দালের বেশিরভাগ নার্সেরই প্রথাগত বি.এস.সি. বা জি.এন.এম. ডিগ্রি নেই। বেশিরভাগই অর্ধ-প্রশিক্ষিত কর্মী। যথারীতি রোগী পরিষেবাও সেরকমই হচ্ছিল। আমরা ফুঁসছিলাম কিন্তু কিছু বলার সাহস ছিল না। কোনও প্রথম সারির মিডিয়া বা সংবাদমাধ্যম এসব খবর দেখায় নি। জনগণের টাকায় তৈরি হাসপাতাল ধীরে ধীরে জিন্দালের অশুভ গ্রাসে চলে যাচ্ছিল।
এরপর গত আগস্ট মাসে পাকাপাকি ভাবে সরকারি ডাক্তার, স্টাফ, নার্স সবাই চলে গেলেন। হাসপাতালের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ জিন্দালের হাতে এলো। আমরা আসল খেলাটা এরপর বুঝতে পারলাম। বলা হচ্ছিল, পরিষেবা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে হবে। আসলে দেখা গেল, কেবলমাত্র স্বাস্থ্যসাথী কার্ড থাকা লোকেরাই ভর্তি হচ্ছে। বেড ভাড়া রোজ ৭৫০ টাকা। তার সাথে ওষুধের দাম ইত্যাদি মিলিয়ে মোটা টাকা কার্ড থেকে হাপিশ করা হচ্ছিল। ওষুধের অবস্থাও সেরকম। এক-একজনের প্রেসক্রিপশনে তিন রকম করে ভিটামিন, দু’রকম হজমের ওষুধ মিলিয়ে খান পনেরো ওষুধ!! আমি একটু-আধটু জানি। এসব ওষুধ অকাজের। যেহেতু সরাসরি পকেট থেকে দিতে হয়নি, তাই অশিক্ষিত, গরীব মানুষের পক্ষে সবটা বোঝা সম্ভব হচ্ছিল না। যাদের কার্ড নেই তাদের উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে যেনতেন প্রকারেণ রেফার করা হচ্ছিল। আর সত্যিকারের ইমার্জেন্সি পেশেন্ট হ’লে? থাক। সেসব না বলাই ভালো। এই যোগ্যতার স্টাফ দিয়ে যা হয় আর কী.. শুধুমাত্র হাঁচি-কাশি-সামান্য জ্বর আর ওই ধরনের টুকটাক রোগীদের দিনের পর দিন ভর্তি রেখে কার্ডের টাকা নয়ছয় হচ্ছিল। আমাদের গ্রামের রতন মুর্মুর বাবার অন্য হাসপাতালে অপারেশন করাতে গিয়ে যখন স্বাস্থ্যসাথী কার্ড দেখানো হয় তখন বোঝা যায় কীভাবে টাকাগুলো কেটে নিয়েছে। আর তার ফলে সত্যিকারের দরকারে কার্ডটা কাজেই লাগছে না। আমরা তখনই আশঙ্কা করেছিলাম, ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সাধু উদ্দেশ্যে আসেনি। আমাদের আশঙ্কাই সত্যি হ’ল।
আগেকার রোগীতে ভর্তি থাকা হাসপাতালে টিমটিমে অন্ধকার। গড়ে ২০-২৫ জন রোগী ভর্তি হয়। তার সিংহভাগই শুধু প্রসূতি মায়েরা। আউটডোরে মেরেকেটে ২৫০-৩০০। যদিও কিছুদিন আগেই একটি প্রথম সারির সংবাদপত্রে পুরো মিথ্যে খবর প্রচার হয়েছে। বলেছে নাকি রোজ ৫০০ রোগী হয়.. মিথ্যে!! ডাহা মিথ্যে!! বিশ্বাস না হয়, যে কেউ একদিন হাসপাতাল চত্বর ঘুরে যান।
একদিনের ঘটনা বলে শেষ করবো। আমার বোন নার্স। এই সপ্তাহ দু’য়েক আগে একদিন দুপুরবেলা বোন আর জামাই বাজারে গেছে। ওদের বাচ্চা ফুটফুটে মেয়েটা বিছানায় খেলছিল। হঠাৎ খাওয়াতে গিয়ে গলায় একটু দুধ আটকে যায়। বাচ্চাটা শ্বাসকষ্টে নীল হয়ে যাচ্ছিল। আমরা সবাই খুব ভয় পেয়ে গেছি ততক্ষণে। বাচ্চার পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে হাসপাতালে নিয়ে এসে দেখি একজন অল্পবয়সী ডাক্তার ডিউটিতে। ততক্ষণে বাচ্চাটাও অনেকটা ঠিক হয়েছে। স্বাভাবিক শ্বাস নিচ্ছে। ডাক্তারের কাছে এলাম..
– কী চাই?
– দেখুন না স্যার, বাচ্চার গলায় দুধ আটকে গিয়ে..
– হাঁউমাঁউ কোরো না তো.. ওই বেডে শোয়াও
– স্যার, একটু দেখুন না তাড়াতাড়ি ..
– বাড়িতে কী করছিলে এতক্ষণ?
– সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসেছি স্যার। মুখে আঙুল দিয়ে একটু লালা-দুধ বের করে দিয়েছি। আর পিঠ চাপড়াচ্ছিলাম..
– এইসব অশিক্ষিত গাধাগুলো কিচ্ছু না বুঝে শুধু ওস্তাদি মারাবে। কে তোমাদের পিঠ চাপড়াতে বলেছিল?
– স্যার, আমরা আসলে ভয় পেয়ে..
– নিকুচি করেছে ভয়ের.. কর্পোরেট হাসপাতাল হ’লে এতক্ষণে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতো। যাও, গেটের বাইরে দাঁড়াও। দেখছি।
তারপর বাচ্চার বুকে একবার স্টেথোস্কোপ ছুঁইয়ে কপাল কুঁচকে বিচ্ছিরি ভাবে বললেন,
– যাও তো.. কিচ্ছু হয়নি। সকাল থেকে ফালতু ঝামেলা।
– স্যার, বাচ্চা কিন্তু বাড়িতে নীল হয়ে গিয়েছিল
– ডাক্তার কে? তুমি না আমি?
আমি আর কিছু না বলে চুপচাপ চলে এসেছিলাম। আপনারা যাঁরা আমার এই লেখা পড়ছেন সবাই শিক্ষিত, শহুরে মানুষ। আমার কথা মাফ করবেন, এই ব্যবহার দেখে মুখে কাঁচা খিস্তি উঠে এসেছিল। গিলে নিয়েছিলাম। পরে খোঁজ নিয়ে দেখেছি ওই ডাক্তারের বাবা বড় ব্যবসায়ী। ছেলেকে বেসরকারি জায়গা থেকে পয়সা দিয়ে পড়িয়ে এনেছেন। এনারা মানুষকে ‘মানুষ’ ভাবেন না।
মাঝে মাঝে ভাবি, হাসপাতালটা কার? জনগণের সম্পত্তি-ই তো? তাহলে এরকম ভাবে জনগণের সম্পত্তি বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে কীসের স্বার্থে? এতদিন বলার জায়গা পাইনি। আপনাদের ডক্টরস’ ডায়ালগের কথা অনেকদিন ধরে শুনছিলাম। তাই চিঠিতে জানালাম। ছাপার যোগ্য মনে করলে আমাদের কথা সবাইকে জানাবেন? মূলধারার সংবাদমাধ্যম এসব ছাপবে না। যেটা ছাপবে সেটা মিথ্যে ছাপবে। বড্ড অসহায় লাগছে..
অসাধারণ লেখা
একদম বাস্তব।
বাস্তব অভিজ্ঞতা তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ।আর
বেশি টাকা দিয়ে ডিগ্রি নিয়ে যারা ডাক্তার হয়েছেন,তারা পেশাটাকে পুরোপুরি ব্যাবসার জায়গাতে নিয়ে গেছেন।আর সেজন্যই বেশিরভাগ ডাক্তার আর রোগীর(রোগীর পরিবারের) এমন শোচনীয় সম্পর্ক।
পীড়াকাটা থেকে শালবনী হাসপাতালের দূরত্ব ও মেদিনীপুরের দূরত্ব একই
তাছাড়া পিরাকাটাতে গ্রামীণ হাসপাতাল আছে
বাচ্চাটিকে আগে পীড়াকাটা হাসপাতালে ও পড়ে সোজাসুজি মেদিনীপুরে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন ছিল
Right
হতে পারে, এই ঘটনা টা ঘটে থাকতে পারে, তাবলে হাসপাতাল এ স্বাস্থ্য সাথী রুগীর এর চিকিৎসা হয় আর বাকি দের হয়না, এটা ঠিক না আগে যে সব অপারেশন হতো না তা এখন হচ্ছে যেমন জেনারেল সার্জারি, টি. এল. এইচ, সিজার এর মতো অপারেশন বিনা মূল্য তে করছে
পাঁচু বাবু আপনি বোধকরি বেশ অনেকদিন হসপিটালে আসেননি। আপনার লেখা থেকে সেটা বোঝা যায়। আপনার বোন এর বাচ্ছার ঘটনা টা দুঃখজনক। তো আপনি হসপিটাল এর ম্যানেজমেন্ট বা BMOH কে অভিযোগ জানালেন না কেন? আপনি কি অবহিত আছেন যে রোজ কত ফ্রী পেশেন্ট ভর্তি হয় বা রোজ কত ফ্রী অপেরাশন হয়? আপনি তথ্য জানার অধিকার প্রয়োগ করে জানতে চাইছেন না কেন? তথ্য জানলে কি আপনার মিথ্যে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় পান? রাজ্য সরকার বলেন যেই হসপিটালে ভর্তি হতে আসবেন তাকেই স্বাস্থ্যসাথী কার্ড থাকলে সেটা দেওয়া বাধ্যতামূলক। স্বাস্থ্যসাথী কার্ড গোপন করা টা অপরাধ। পাঁচু বাবু নাম গোপন করেছেন, আমিও করলাম।
বিনীত হসপিটাল এর এক কর্মচারী (এই হসপিটাল এর উন্নতি হলে আমার এলাকার স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে তাই এটা লেখা)
Like!! I blog frequently and I really thank you for your content. The article has truly peaked my interest.
A big thank you for your article.
These are actually great ideas in concerning blogging.