২০ জুলাই, ২০২০
“বিডিওকে ঘরে ঢুকতে দিচ্ছেন না কেন ?”
প্লেন ড্রেস পুলিস অফিসার মার্জিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করলেন।
উপস্থিত ভিড়ের চেহারা অসংযত ভারতবর্ষ।
কে আগে ক্ষোভ উগরিয়ে দেবে যথেষ্ট ঘৃণার অনুপান মিশিয়ে! নাগরিক স্বাস্থ্যের অধিকার রক্ষার দায়িত্ব যে তাদের উপরেই বর্তায়, নাইটি এবং বারমুডারা হামলে পড়ে গাঁকগাঁক চিৎকারে বোঝাচ্ছিল।
খাকি উর্দির কনস্টেবলদের পিছনে রেখে অফিসার ফের প্রশ্ন ছুঁড়লেন।
“আরে উনি পজিটিভ না নেগেটিভ সেই খবর তো আমাদের এবং হাসপাতালের কাছে। আপনারা নিশ্চিত হচ্ছেন কীভাবে?”
হাঁউমাউ কাউকাউ এর আড়ালে উত্তর শোনা গেল না। কিংবা উত্তর খোঁজা বৃথা। এভাবেই তো গুজবের কক্ষপথে ঘুরছে পৃথিবী। মানুষের ইতিহাস তাই বলে।
এই ভয়ংকর ভাইরাস কোন দেশ ছড়িয়েছে, কেন ছড়িয়েছে, কীভাবে সংক্রমণ ছড়ালো তা নিয়ে এক লক্ষ থ্রিলারের প্লট লেখা হয়েছে। ড্যান ব্রাউন বা আগাথা ক্রিস্টি হয়তো হার মানবেন।
” বাচ্চা নিয়ে মহিলা যাবেন কোথায়? যিনি প্রশাসনে থেকে আপনাদের সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করছেন , সেইসব বিডিও, ডাক্তার , নার্স দের আপনারা ঘরে ঢুকতে দিচ্ছেন না ? বাধা দিচ্ছেন ? আরে থানা পুলিশ প্রশাসন কী মরে গেছে ? করছেন কী ?”
দোতলা থেকে তেরো বছরের সূর্যতাপস সব কিছু দেখছিল। তার মাকেও গত মাস থেকে ঢুকতে দেয়নি ফ্ল্যাটের আবাসিকরা। মা নার্সিংস্টাফ। বিডিও আন্টিকেও চেনে সূর্যতাপস। প্রায়ই ওর গাল টিপে আদর করে বলেন , “বড় হয়ে কী হবে ?”
সূর্যতাপস গম্ভীর মুখে বলে, “স্পেস ওয়াকার। মহাকাশে যাব।”
আন্টি খুশি হয়ে ওকে একটা পোস্টার দিয়েছিল রাকেশ শর্মার।
সেই আন্টিকেও ঢুকতে দিচ্ছে না !
পাঞ্জাবি পরা ঐ কাকুটা নাকি টিচার। তিনিও বাধা দিচ্ছেন ? সূর্যতাপস অবাক হল।
” স্যার, অভিযান সফল করতে হলে এভাবে হবেনা।” কঠিন গলায় বললেন অফিসার। সানগ্লাস পরা আরেকজন ভারিক্কি চেহারার পুলিশ দৌড়িয়ে এলেন।
” ভদ্রলোক ? দাঁড়া। বোঝাচ্ছি। কাকে বলে নাগরিক অধিকার আর ভদ্রতা!”
“স্বাস্থ্য? নিজেরা মাস্ক ছাড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে , থুতনিতে ঝুলছে মাস্ক আর মাস্তানি দেখানো ?”
হিড়হিড় করে চিল্লানো পাবলিকের টি শার্ট ধরে টেনে নিয়ে গেলেন অফিসার।
“সব কটাকে আজ ভ্যানে তুলব। এদের দাওয়াই লাঠি।”
সূর্যতাপস শুনতে পেল , পাশের বারান্দা থেকে দেবজ্যোতির ঠাকুরমা বললেন , “ঠিক হয়েছে। এই লোকগুলোর বাপ জেঠাই বিদ্যাসাগরকে বিধবার বিয়ে দিতে এমন হাঙ্গামা করেছিল। মেরে হাড় গুঁড়িয়ে দিতে হয়।”
প্লেনড্রেস পুলিশ অফিসার কাকুর প্রতি সম্ভ্রমে মন ভরে উঠল সূর্যতাপসের। উনি বলে গেলেন , ফের যদি কোনও কোভিড যোদ্ধাদের বাড়িতে থাকতে কোনও বাধা দেওয়া হয়, পিটিয়ে ছালচামড়া তুলব।”
কেঁউ কেঁউ করা ভিড় পুলিশের পিছন পিছন ছুটল।
” ওদের কী করা হবে দিদা?”
“গাড়িতে তুলে নিয়ে থানায় উত্তমমধ্যম দেবে। রোগ আর আতঙ্ক দুটোই ছড়াচ্ছে তো এইসব লোকেদের জন্য। শেখালেও শিখবে না।”
নিচের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ চোখ উজ্জ্বল সূর্যতাপসের।
মা ?
বিডিও আন্টি এবং মা একসঙ্গে ঢুকছে অ্যাপার্টমেন্টের গেট দিয়ে।
একমাস বাদে মা বাড়ি ফিরল। ভাগ্যিস পুলিশ কাকুরা অভিযান করলেন।
মা নিচ থেকে বললেন “সূর্য, তোর জন্য কিছু আনতে পারিনি বাবা। লকডাউনে সব বন্ধ। দোকানপাট।”
“কিচ্ছু লাগবে না মা।” সূর্য হাসছে আনন্দে ।
” অভিযান কাকে বলে আজ নিজের চোখে দেখে নিলাম।”
মাস্কের বাইরে চোখে চোখে হেসে ফেললেন বিডিও আন্টি।
“কী বুঝলে ?”
“মা জানো, আজকের তারিখেই চাঁদে অভিযান করেছিল পৃথিবীর মানুষ। একান্ন বছর আগের বিশ জুলাই মানুষ প্রথম পা রেখেছিল চাঁদের মাটিতে।”
দেবজ্যোতি বাধা দিয়ে বলল, ” ভুল। সবাই হাঁটেননি। শুধু নিল আর্মস্ট্রং আর অলড্রিন। মাইকেল কোলিন্স ছিলেন স্পেসশিপে।”
সূর্যতাপস বলল, “সেটাই তো কোলিন্সের লকডাউন। ওকে ওটাই আদেশ দেওয়া হয়েছিল যা তিনি অক্ষরে অক্ষরে মেনেছেন। থেকেছেন অ্যাপোলো ১১ র ভিতরে। আমরা কিন্তু চূড়ান্ত ইনডিসিপ্লিনড। কোনও নিয়ম মানছিনা। মাস্ক পরছিনা। হুটহাট বাইরে যাচ্ছি।”
মা নিচ থেকে বলল, “আমাকে ছুঁয়ে দিসনা। আগে স্নান করব।”
আজকের পুলিশ অফিসারের কথা ভাবছিল সূর্যতাপস। ঐ কাকুকে পরে সে অভিনন্দন জানাবে। থ্যাংক ইউ বলবে।
সূর্যতাপস বইতে পড়েছে, চাঁদে প্রথম যখন নিল আর্মস্ট্রং পা দিয়েছিলেন, পৃথিবীতে বলা হচ্ছিল, ‘একটা মানুষের ছোট্ট পা ফেলা , মানবজাতির বিরাট পদক্ষেপ।’
একদিন অতিমারি কেটে যাবে। ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়ে যাবে হয়তো। আজকের এই অভিযানটাও কিন্তু মোটেই সেদিনের তুলনায় ছোট নয়।বরং একান্ন বছর বাদে সে গল্প করতে পারবে এইরকম পুলিশ অফিসাররা অভিযান করেছিলেন বলেই তাদের দেশ থেকে বিশৃঙ্খলা, বজ্জাতি দূর হয়েছিল। রোগ নিয়ন্ত্রণে এসেছিল।
একটা মহামারীর ইতিহাসে এই অভিযানটাও কিন্তু কম গুরুত্বর নয়।
দেবজ্যোতি পুরো ঘটনাটা মোবাইলে ভিডিও করেছে। শেয়ার করল সূর্যতাপসকে।
আচ্ছা, অ্যাস্ট্রোনট না হয়ে এমন দুর্দান্ত পুলিশ অফিসার হলে কেমন হয় ?
মুগ্ধ্ হয়ে দেখতে দেখতে ধন্দে পড়ল সূর্যতাপস।