“ছানার জিলিপি খাওয়াবে আজ?” মোবাইলে অর্পণের গলায় আবদার। চমকে গেল সুপর্ণা।
সন্ধ্যাবেলা কস্মিনকালেও ফোন করে না অর্পণ। ‘পিপিই’ ধরাচুড়ো পড়ে একবার আই টি ইউ-তে ঢুকে পড়া মানে মোবাইলের সঙ্গে সম্পর্কহীন। অতএব বিনা কারণে ফোন করেনি অর্পণ।
আন্দাজেই ঢিল ছুঁড়ল সুপর্ণা। “কী ব্যাপার, চার নম্বরের ফিমেল পেশেন্ট স্টেবল হল?”
ওদিক থেকে এককলি গান ভেসে এল অর্পণের গলায়।
গোঁফ ব্যাপারটা ডাক্তার অর্পণ চক্রবর্তীর নেশা থেকে শ্লাঘায় পরিণত হয়েছে। সুপারস্পেশালিটি হাসপাতালের কিংবদন্তী কার্ডিয়াক সার্জন, ডাক্তার সরকারের টিমের অন্যতম সদস্য সে। কৈশোরে বাবাকে হারিয়ে, শুধুমাত্র মায়ের অদম্য আগ্রহে মেধাবী অর্পণ আজ পৌঁছেছে এই জায়গায়। যেসব রোগীদের হৃদয়, ফুসফুস কাজ করতে চায় না, অর্পণরা তাদের বাঁচিয়ে রাখে যন্ত্রে। দেখভাল করে। তারপর একদিন কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের যন্ত্রকে ঠেলে শরীর নিজেই সচল হয়ে ওঠে। ভেন্টিলেশন থেকে বার হয়ে আসে। কাজটা প্রচন্ড কঠিন কারণ এটা টিম ওয়ার্ক।
সেই বোঝাপড়া পরিবারেও থাকতে হয় বৈকি । সমস্ত রোগীর মনিটরিং করে রাতদুপুরে বাড়ি ফেরে অর্পণ। সুপর্ণা খাবার বেড়ে বসে থাকে। হাতে পছন্দের বই। ক্লাসিক থেকে শুরু করে হালফিলের বাংলা, ইংরেজি সাহিত্য সব প্লেটের উপরে সাজিয়ে দেয় । সুপর্ণা সুগৃহিনী। ঘরকে কীভাবে স্বর্গ করে তুলতে হয় তার ফর্মুলা জানে। অর্পণের ব্যাঙ্ক থেকে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট সব শক্তহাতে দেখাশোনা করে। হয়তো সেই সুখাবেশের প্রেক্ষিতেই অর্পণ গভীর মনোযোগ দিতে পারে রোগীদের এবং গোঁফকে।
ভেন্টিলেশনের রোগীরাও ঠিক গতানুগতিক রোগী নয়। একেবারে নিস্পন্দ। সাড়াশব্দ নেই, চোখের পিটপিটানি নেই। যেকোনও মানুষ হঠাৎ দেখলে ভাববে মৃত। গুজব ছড়ায়ও খানিকটা সেই কারণে। “মৃত মানুষকে ভেন্টিলেশনে ভর্তি করে রেখেছে” ইত্যাদি ইত্যাদি। জীবন-মৃত্যুর মাঝখানেও যে একটা অতীন্দ্রিয় সময় আছে সেটা ECMO স্পেশালিস্ট অর্পণের মতো গুটিকয়েক ডাক্তার উপলব্ধি করেন। কী সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সেই লক্ষণরেখা! কখন যে মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়বে স্বয়ং ভগবানও বোধহয় জানেন না। জানেন যম।
ইদানিং যমের সঙ্গে আঁতাত করেছে নতুন এক স্যাঙাত। কোভিড । ফটাফট ভরে যাচ্ছে ভেন্টিলেটর বেড। সদ্য মা হওয়া এক তরুণী চার নম্বর বেডে। কোভিড পজিটিভ। বাচ্চাটা নিওনেটাল ওয়ার্ডে। মায়ের দুধ পায়নি, কিচ্ছু না। তরুণীর স্বামী, বাবা, মা নিয়মমাফিক কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে। হিমশীতল আই টি ইউর ভিতরে আজ নিয়ে পাঁচদিন হল রোগিনীর জন্য সব কিছু একহাতে করে চলেছে অর্পণ। কী এক অদ্ভুত আতঙ্কে ভুগছে গোটা পৃথিবী। এই বুঝি এল করোনা। হবে কিন্তু সবারই । কেউ পার পাবে না। ফেসবুকে হাস্যকর প্যানিক ঝড়। ‘আমার একশো মিটারে কোভিড রোগী, মরে যাব’। আই টি ইউয়ের কিছু কিছু ট্রেনড স্বাস্থ্যকর্মীও আতঙ্কের আবহে কাজে আসছে না। স্যালাইন পাল্টানো থেকে কৃত্রিম শ্বাসনল বদলানো, এমনকি রোগিনীর মলমূত্র সাফ সব করতে হচ্ছে অর্পণকে। আই টি ইউর পৃথিবী একদম আলাদা। অসম লড়াই যমে চিকিৎসকে।
প্রেমিকা থাকতেই সুপর্ণার দাবি ছিল, গোঁফ ছাঁটা চলবে না। অর্পণ আগাগোড়া বদলেছে এই কুড়ি বছরে। বদলেছে তার চিকিৎসক সত্ত্বা, পিতৃসত্ত্বা। মেয়ের বাবারা বোধহয় একটু বেশিই সংবেদনশীল হয়। কিন্তু বদলায়নি তার গোঁফ। চন্দনদস্যু বীরাপ্পনকে আজও মনে রেখেছে অর্পণ। গোঁফ আসলে একটা আইডেন্টিটি। তার ক্ষেত্রে দাম্পত্যের প্রশ্রয় ।
কিন্তু চার নম্বর পেশেন্ট ইমপ্রুভ করছে না কেন? দুদিন ঠায় দাঁড়িয়েও ঠাহর হয় না অর্পণের। সে ফেল করলে বাচ্চাটা চিরদিনের জন্য মা হারা হবে। সব পরীক্ষায় পাশ করা মুশকিল। এই সময়টা ডাক্তারের জন্য নিদারুণ অসহায় মুহূর্ত। নিজেকে নামানুষ এক ভিনগ্রহী মনে হয়। উন্নতির প্যারামিটারগুলো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে। তরুণীর বর রোজ ফোন করে স্ত্রীর খোঁজ নেয়। সেই কাতর প্রশ্নের কী জবাব দেবে বুঝতে পারে না অর্পণ।
কোভিড রোগীদের থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা অনেক বেশি। তাই পিপিই পড়তেই হয় । কিন্তু আজ মেয়েটার চোখের মণি যেন বেশি নড়ছে! কিছু বলতে চায়? বুকে তরঙ্গ খেলে গেল অর্পণের। কুড়ি মিনিট ধরেও কিছু বুঝতে না পেরে অধৈর্য হয়ে মাস্ক খুলে ফেলল অর্পণ।
মিরাকল ঘটল তখনই। রোগিনীর দুই হাত হঠাৎ নড়ে উঠল। ঠোঁটের ফাঁকে মৃদু হাসি। দ্রুত খাতা পেন এনে দিল অর্পণ। কাঁপা কাঁপা হাতে কয়েকটা অক্ষর। “ডাক্তারবাবু , বাঁদিকের গোঁফ ছোট কেন?”
সকালে দাড়ি কামাতে গিয়ে বাঁদিকের গোঁফটা অসাবধানে ছোট হয়ে গেছিল। সেটাই যে তুরুপের তাস হবে ভাবতে পারেনি। সুপর্ণা জানাল, রোগিনী নাকি অর্পণের ফেসবুক ফ্রেন্ড। অনেকবার লাইক মেরেছে ডাক্তারের প্রোফাইল ফটোতে। হয়তো গোঁফের তারতম্য রোগিনীর অবচেতন মস্তিষ্কে উত্তেজনা এনেছে। ছানার জিলিপি এগিয়ে দিয়ে সুপর্ণা সেই কুড়ি বছর আগের হাসি হাসল।
“শোনো, আজ জুকারবার্গের জন্মদিন। ওঁকেও একটু ক্রেডিট দিও। ফেসবুকের আবিষ্কারক।” অর্পণ শুধু একটা ভবিষ্যত ছবি ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তরুণী মায়ের কোলে নবজাতক। বাঁদিকের গোঁফে তা দিতে গিয়ে নিজেই হেসে ফেলল ‘হো হো’ করে।
অসাধারণ আপনাদের জন্য গর্ব হয়. ভগবানের (? ) কাছে প্ৰাৰ্থনা করি এইভাবে মানুষের পাশে থেকে তাঁদের জীবনদান করুন
ভীষণ ভালো লাগল।
অপূর্ব! এমনও হতে পারে…. অবাক!
গল্প হলেও সত্যি।
প্রাণ আছে প্রাণ আছে…
খুব ভাল লাগল