-“তাইলে তুমি আমায় বাড়ি যেতেও দিবা না ?”
-“বাড়ি?” হো হো করে হেসে উঠল লোকটা। “বাড়ি থাকলে তো ফিরবি। সব উড়ে যাচ্ছে ঝড়ে। তাছাড়া তরে নেবে কে?”
শ্যামবর্ণা তণ্বীর চোখে ভয়। সিঁটিয়ে গেল সরাইখানার দেওয়ালে।
– “আমি তোমার বিয়া করা বউ নই?”
– “এরে বিয়া কে বলল? মালাবদল আর সিন্দুর দিলেই বিয়া ? তুই তো একটা পোকায় কাটা মেয়ে!”
গঙ্গার চোখে আর জল নেই। দু’মাস ধরে ঝরতে ঝরতে শুকিয়ে খটখটে। এই লোকটার জন্য গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে এল সে! পাক্বা প্রেমের অভিনয়! বেচে দেওয়ার তালে। জেনে ফেলেছে গঙ্গা। প্রেমিক না ছাই! আড়কাঠি। ফিরবার পথ নেই ! তার গা শিরশির করছে। লুকিয়ে ভোররাতে বজ্জাত লোকটার মোবাইল থেকে মেসেজ পাঠিয়েও দিয়েছে বোন যমুনার কাছে। যমুনা কলকাতায় এক বাড়িতে খাওয়া পরার কাজ করে। তারা মানুষ ভাল। পুলিশকে নিশ্চয়ই খবর দিয়েছে এতক্ষণে। না দিলে? গঙ্গার বুক ধড়ফড় করে উঠল।
“তুমি আমায় এমনভাবে ঠকাইলা!”
গঙ্গা চিৎকার করে উঠতেই লোকটা এসে ওর মুখ চেপে ধরল। “চিল্লাবি তো লাশ ফেলে দেব।”
এই সেই প্রেমিক যে একটা ঘর , বিছানায় নতুন চাদর , আলনায় নতুন সালওয়ার কামিজের স্বপ্ন দেখিয়েছিল! ফিল্মের হিরো দেবের মতো পাগলু ড্যান্স দেখাবে আর মাংসভাত খাওয়াবে বলে শপথ করেছিল! গঙ্গা আঠেরো বছরের সুন্দরী। তাজা, চিকণ। শ্যাম্পুর অভাব । তাও রেশমি চুল। গায়ে শেফালির গন্ধ। টিকোলো নাক। দোয়েলের স্বর।
এমন সরেস সুন্দরীকে বেচে কতো টাকা পাওয়া যাবে সেই স্বপ্নে মশগুল ছিল পথের প্রেমিক। সমস্যা বাঁধল আচমকা লকডাউন । মার্চের বাইশ থেকে। জনতা কার্ফু। নয়তো এতোক্ষণে মুম্বাই দিয়ে আসার কথা ছিল মেয়েটাকে। সব ভেস্তে গেল।
সেই থেকে এই সরাইখানায় কাটছে গঙ্গার জটাজূটময় জীবন। তালাবন্ধ শহরে দিন রাত এই লোকটার সঙ্গে অসহ্য লাগে । এর থেকে মরে যাওয়া ভাল। হাতের সামনে কাটারি পেলে নিজের গলায় পোঁচ দিত গঙ্গা।
বাড়ি ফিরেই বা হবে কী ? বাবার লোভে চকচক চোখ একদম এই লোকটার মতোই। যমুনার মতোই গঙ্গাকেও একবাড়িতে কাজে দিয়েছিল। সেখানে বুড়ো মালিকটা অসভ্যতা করত। বাবা মাস গেলে শুধু মাইনে আনতে যেত। কোনওদিন তার একটা অনুযোগও কানে তোলেনি। ‘কন্যাশ্রী’ না কিসের জন্য টাকা পাওয়া যাবে শুনে তাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে আনল বাবা।
হোটেলের ঘরে টিভিতে দেখাচ্ছে বিরাট এক ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসছে তাদের পাথরপ্রতিমার দিকে। মন খারাপ ভাইটার জন্য। বড্ড ছোট। আর মায়ের জন্যও। ঝড়ে ঘর ভেসে গেলে আর কী বাঁচবে মা , ভাই!
কিন্তু সুন্দরীদের লড়াই কাকে বলে তা জানে তারা। জঙ্গলের মেয়েরা। জান দেবে তবু মান দেবেনা।
আয়লার সময় দেখেছে গঙ্গা। তখন সে ছিল ন’ বছরের বালিকা। শিকড় দিয়ে ঝড়ের দাপট থামিয়ে দিয়েছিল সুন্দরীরা। সঙ্গে ছিল গেঁওয়া। আয়লার দস্যুতাকে রোধ করতে পারেনি কংক্রিটের বাঁধও। কিন্তু সুন্দরী গাছেরা মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। তাই এদের বাঁধন থেকে মাটি কাড়তে পারেনি বন্যার জল। নয়তো কলকাতা শহর টহর সব ডুবে সমুদ্দুরে ভেসে যেত।
আহা! আপনজনের গোড়াও যদি এমন মজবুত হতো! গঙ্গার বুক টনটন করে। তাকে কেউ ভালবাসেনা। বাবা না, মাও না। কেউ নয়।
ঠকঠক শব্দে কড়া নাড়ল কে? লোকটা উঠে বসল। তাকে নির্দেশ দিল বাথরুমে লুকিয়ে পড়তে। গঙ্গা বাথরুমে ঢুকেই শুনতে পেল দরজা ভাঙার আওয়াজ। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে উঁকি দিল গঙ্গা।
পুলিশ ! এদের মধ্যে দু’জন মহিলা পুলিশও আছে। যমুনার প্রতি কৃতজ্ঞতায় চোখে জল এল গঙ্গার। একেই বলে মায়ের পেটের বোন।
“বেরিয়ে এসো মেয়ে । ভয় নেই।”
গঙ্গা পাংশুমুখে বেরিয়ে এল।
“কোথায় থাকো? ”
পাথরপ্রতিমা শুনেই চমকে গেল পুলিশের দল। “ভয়ংকর পরিস্থিতি ওখানে। ডিজাস্টার শুরু হয়েছে। এসপ্তাহটা বরং ওকে হোমে রেখে দিই কী বলেন ম্যাডাম?”
গঙ্গার চোখের সামনে আড়কাঠি গ্রেফতার হল।তবুও স্বস্তি পেল না গঙ্গা। গোটা পাথরপ্রতিমা নাকি ভেসে যাবে এমন শক্তিশালী এই সাইক্লোন । যাবে কোথায় সে ? বাড়ি ফিরতে হবে তো ?
গরম ভাতের থালা সামনে নিয়ে স্হানু হয়ে বসে আছে গঙ্গা। আজ দুর্যোগ তাই হোমের বদলে থানার লকআপে বসে একা। মহিলা কনস্টেবল তাকে এক বাটি ডাল, আলুসেদ্ধ দিয়ে গেলেন। “খেয়ে নাও মেয়ে ।”
গঙ্গার চোখ টিভির দিকে। বাইরে প্রবল ঝড়। আকাশটাকে কে যেন একটা মস্ত তরোয়াল দিয়ে ফালা ফালা করে চিরছে আর সাঁই সাঁই আওয়াজে কেটে যাচ্ছে বাতাস। থানার ঘুলঘুলি দিয়ে বাইরে তাকাল সে। নারকেল গাছগুলো বেঁকে নুয়ে পড়ছে। আহা! কী কষ্ট হচ্ছে ওদের। রোজ অমন নুয়ে পড়ে চাষের ধান কেটেছে মা। তারপর কোমর ব্যথা নিয়েই তাদের রাঁধাবাড়া করেছে দিনের পর দিন।
টিভির স্ক্রিনে ঝড়ের ছবি। রাডার না কি একটা যন্ত্র তুলেছে অনেক উঁচু আশমান থেকে। ঝড় যেভাবে আসছে গুঁড়িয়ে যাবে গ্রাম। ভাত আর মুখে রুচছে না। গঙ্গা চুপ করে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়ল।
গোটা দেড়দিন থানার মধ্যে কাটিয়ে দিয়েছে গঙ্গা। সেদিন রাতেই বিজলি চলে গেছে। তাদের অবশ্য কোনওদিনই বিদ্যুৎ ছিলনা। কুপি আর লম্ফ। অসুবিধেও হয়নি তাই।
মহিলা কনস্টেবল বললেন, পাথরপ্রতিমায় যাওয়ার প্রশ্নই নেই। বড় বড় গাছ পড়ে গেছে রাস্তায় । মোবাইলে সেই রাডারের ছবি দেখাল পুলিশ দিদি। ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসকে নাকি আটকে দুর্বল করে দিয়েছে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। এই দুশো কিলোমিটার যদি ঐ ভয়ানক বেগে ছুটে আসত আমফান, ভেঙে চুরমার হয়ে যেত কলকাতা।
“ম্যানগ্রোভ কী ম্যাডাম?”
“সুন্দরী গাছ। যারা বুক পেতে মাটি আগলায়। কলকাতার এখানেও প্রচুর গাছ উপড়েছে। ভেঙে পড়েছে।”
থানার জানলা দিয়ে দেখতে পেল গঙ্গা, কাঠচেরাই করাত এনে গাছের গুড়ি কাটছে কিছু লোক। গাছটা হাউমাউ করে কেঁদে কঁকিয়ে চিৎকার করছে। কেউ কী শুনতে পাচ্ছে না ? গঙ্গা তো জানে কুড়ুলের ঘায়ে গাছগুলোর কেমন কষ্ট হয়। এই আমগাছটা তার মায়ের বয়সী হবে। কীভাবে দায়ের কোপ দিয়ে দড়ি বেঁধে টানছে! সর্বংসহা মায়ের জন্য গঙ্গা স্হান কাল ভুলে ডুকরিয়ে উঠল।
“কী হল রে?”
“ম্যাডাম আমি বাড়ি ফিরব।”
“বেমক্কা বায়না করিসনা। এখন যাওয়া হবে না। মহিলা কনস্টেবল কড়াসুরে বললেন।”
ঝড়ের চারদিন বাদে আজ গঙ্গা পাথরপ্রতিমা ফিরছে। কোত্থেকে আবির্ভূত হয়েছেন শিবের মতো একজন পুলিশ অফিসার । মহিলা কনস্টেবল বললেন তাদের মতো বহু মেয়েকেই নাকি উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গ্রামে। তবে আপাতত থাকতে হবে রিলিফ ক্যাম্পে। ভ্যানে উঠেই দেখতে পেল গঙ্গা প্রচুর চেনা মুখ। সুফিয়া, রাখী, পদ্মা, নাফিসা, রিনা। সার সার সুন্দরী।
যাত্রাপথে দেখতে পেল গঙ্গা, সেনাবাহিনীর তরতাজা তরুণের মতো পাতা মেলে শহীদ হয়ে শুয়ে আছে হাজারে হাজারে সবুজ গাছ । টাটকা রক্ত পড়ছে তাদের গা থেকে। চুঁইয়ে চুঁইয়ে । শহরের মানুষ বোঝে না, জানেওনা। গ্রামের লোকই কী বোঝে ? তাহলে সুন্দরীরা দিনের পর দিন এভাবে বেহাত হয়ে যেত ?
রিলিফ ক্যাম্পে একজন শহুরে তরুণী তার নাম জানতে চাইল। সরকারি অফিসার। গঙ্গা ব্লাউজের ভিতর থেকে আধার কার্ড বার করে দিতে চমৎকৃত হলেন। “বাহ, তোমাকে তো একদম মিস শেফালির মতো দেখতে! নাচতে জানো বুঝি?”
“নাহ।”
“বড় কষ্টের জীবন কাটিয়ে গেছেন গো। খুব গুণী শিল্পী আর তেমন সুন্দরী ছিলেন মিস শেফালি।”
অচেনা তরুণীটির হাত ধরে হঠাৎ চিৎকার করে কেঁদে উঠল গঙ্গা।
“আমাদের বাঁচান দিদি। আমরা মরে গেলে সবাই কিন্তু ডুবে যাবে।” নাফিসা, রিনা, সুফিয়া সবাই ফুঁপিয়ে উঠল।
হঠাৎ শিবের মতো সুন্দর পুলিশ অফিসার এসে বললেন, “গঙ্গা দাস কে আছ ? তোমার বাবা নিতে এসেছে , যাও।”
গঙ্গা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “যাব না স্যার। বলে দিন, আমি এখানেই থাকব।”
“যাবি না মানে? এমনিই মুখ পুড়িয়েছিস তুই” বাবা হতভম্ব।
“তাহলে আর নিচ্ছ কেন ঘরে বাবা!”
কয়েক সেকেন্ড নীরবতা। বাবা সুর বদলে বলল, “তোর মা কষ্ট পাচ্ছে। নইলে আসতাম না। পঞ্চায়েত হুজ্জুতি করবে তুই ফিরলে। খাপ বসাবে । কত টাকা জরিমানা চাইবে কে জানে!”
গঙ্গা কান্না চাপল। তার বয়স আঠেরো। সে জানে, এক একটা সুন্দরী গাছ সত্তর বছর অবধি বেঁচে সাগরদ্বীপকে রক্ষা করে। “শোনো বাবা, মাকে বোলো মহাপ্রলয় আসছে। ঝড় আসতেই থাকবে। সমুদ্দুরের দেবতা ক্ষেপে গরম হয়ে গেছে। কিন্তু এভাবে যদি আমাদের মেরেই ফেলতে থাকো তবে…”
আর কিছু বলতে পারল না গঙ্গা। গলা বুজে এল। উত্তাল বঙ্গোপসাগরের ঢেউ গর্জন করে আছড়ে পড়তে লাগল পাড়ে। মাটি খসে বাঁধ ভেঙ্গে পড়ল।
শোঁ শোঁ ঝড়ে কেঁপে উঠল তাবত সুন্দরবন।