কাশীবাসী বুড়ি অনেকদিনের বাসি কাশি নিয়ে চেম্বারে ঢুকলো। সঞ্জয়দা সাবধান করে বললো, ‘ঠাকুমা ডাক্তারবাবুর সামনে কেশো না কিন্তু।’
বুড়ি বলল, ‘কাশি আসলে চাপব কি করে বাপ আমার। তুই হাগার বেগ এলে চাপতে পারিস?’
তারপর একটি বেল বার করে টেবিলে রাখল। বলল, ‘এই রাখলুম ভিজিট। টাকা পয়সা নাই কিন্তু।’
বললাম, ‘বেল নিয়ে কী করবো ঠাকুমা। ও তুমি নিয়ে যাও। খেয়ো।’
রোগ নির্ণয়ের জন্য রোগীদের মুখের ভাষা পড়া খুবই জরুরি। ইদানীং সব মুখই মুখোশের আড়ালে। তাই চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করছি। বুড়ির সুতো বাঁধা চশমার ফাটা কাঁচের আড়ালে আহত দৃষ্টি। অভিমানী স্বরে বলল, ‘টাকাও দেব নে, বেলও দেব নে, তাহলে তোর চলবে কি করে?’
আমি হাসলাম, ‘ঠিক চলে যাবে।’
বুড়ি বলল, ‘কিচ্ছু চলবে নে। বেলটা রেখে দে। ভালো করে চটকে বিচি গুলো ফেলে দুধে গুলে খাস। আহা, অমৃতের মতো সোয়াদ। কাশী থেকে ফেরার পরে একদিনও জোটেনি। কী কুক্ষণে যে মহামারির আগে বাড়ি ফিরতে গেলুম।’
সময় নষ্ট হচ্ছে। লক ডাউনের সময় তাড়াতাড়ি রোগী দেখছি, যাতে ভিড় না জমে। রোগীদের শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার দায়িত্বে আছে গৌড়। কেউ চেম্বারে উঁকি মারার চেষ্টা করলেই তেড়ে ধমক লাগাচ্ছে। গৌড় বাইরে থেকে বলল, ‘ডাক্তারবাবু, একটু হাত চালিয়ে। ভিড় বাড়ছে।’
বললাম, ‘আমি ইতিহাস পরীক্ষা দিচ্ছি না গৌড়, যে হাত চালিয়ে খাতা ভরে যা খুশি লিখে আসব।’
হাত চালিয়ে কি সবসময় রোগী দেখা যায়? করুণ চোখের শীর্ণা মহিলা বুকে ব্যথা নিয়ে এলে জানতে চাইব না, সে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার কিনা? এক্সরে, ইসিজি আর একটা পেন কিলার লিখেই দায়িত্ব সারব?
যাহোক বুড়িকে বললাম, ‘তোমার এই বিচ্ছিরি কাশি কতো দিনের?’
‘কাশি?’ বুড়ি অবাক হয়। ‘কাশির জন্য তোকে দেখাতে এয়েচি কে বললে? আমি তো এয়েচি ত্রাণ নিতে।’
‘ত্রাণ?’
‘হ্যাঁ, তোরা কালকে দিলি না। চাল, ডাল, তেল, ডিম। আমার পাশের ঘরের একজন নিয়ে গেচে।’
‘ত্রাণ নিতে তুমি ডাক্তারের চেম্বারে এসেছো?’
‘আর কনে যাব? এ পাড়ায় কারো বাড়ি চিনি না তো।’
বললাম, ‘ঠিক আছে, কাল সকাল এগারোটায় দুই বাড়ি পরে যে মুদির দোকান আছে, ওখানে এসো। আমি বলে রাখবো।’
সঞ্জয়দাকে বললাম, ‘ঠাকুমার নামটা লিখে রাখো। চেম্বার শেষ করে ডিউকের কাছে দিয়ে দেব।’
বুড়ি বলল, ‘বুকটাও একটু দেখে দে বাবা। একটু কাশির ওষুধও দিস।’
বুকে স্টেথো বসালাম। বেশ সাঁই সাঁই করছে। বললাম, ‘ঠিক আছে, কাল আসো।’
বুড়ি উঠে দাড়াল। তারপর সব স্টেরিলিটির পিণ্ডি চটকে আমার মাথায় হাত রাখল। ‘দীর্ঘজীবী হ বাপ।’
সঞ্জয়দা বলল, ‘একি ঠাকুমা, তুমি কাশি নিয়ে ডাক্তারবাবুর মাথায় হাত দিচ্ছো কেন? তোমার যদি করোনা থাকে?’
বুড়ি থতমত খেয়ে বলল, ‘আমারে যমেও ছোয় নে, আমার কি করে করোনা হবে?’
সঞ্জয়দা গজগজ করছে, ‘নাকটা ভালো করে ঢাকো। নাকটাই তো বেড়িয়ে আছে। তাহলে মাস্ক পরে লাভ কি।’
ইদানীং আবার চেম্বার আর রোগীদের বসার জায়গা দিনে দুবার হাইপোক্লোরাইট সলিউশন দিয়ে স্যানিটাইজ করা হচ্ছে। চেম্বার শুরুর আগে আমি ফাঁকি বাজি করে কাজ সারছি। চেম্বার শেষের পর সঞ্জয়দা স্যানিটাইজ করার দায়িত্বে। সঞ্জয়দা অত্যন্ত সিরিয়াস। টেবিলের তলা, দরজার কোন কিছুই বাদ দিচ্ছে না। বলছে, ‘আহা, এ যন্ত্র দিয়ে স্যানিটাইজ করতে গিয়ে চাষ আবাদের স্মৃতি আবার ফিরে আসছে।’
ছবির দুই ব্যক্তি সঞ্জয়দা ও গৌড়। আমার দুই বডি গার্ড।