১৬ জুন, ২০২০
-“হেমন্তকাল কাকে বলে দাদু ?”
-“যখন ধান কেটে নেওয়ার পর খাঁ খাঁ পড়ে থাকে ক্ষেত , কুয়াশায় মুড়ে যায় রাত্তির। বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে তখন। সেই বিষণ্ণতার মধ্যে একটা করুণ সুর বাজতে থাকে।”
-“কেন ?”
-“তুমি বুঝবে না দাদুভাই। চৌদ্দ বছর বয়সে হেমন্ত আর কী বুঝবে। বছরটা যা যাচ্ছে । এক এক করে কত মানুষ চলে গেল।”
-“দাঁড়াও তোমার চা এনে দিই। আজ বাবা চা বানাচ্ছে।”
-“তুমি বরং এক কাজ কর নাতিবাবু। আগে চশমাটা দাও।”
নাতি দৌড়িয়ে চশমা আনতে গিয়ে দেখল বাবা একহাতে চা অন্যহাতে মোবাইল ফোন নিয়ে দাদুর কানে দিচ্ছেন।
-“কে রে ?” দাদুর চোখে প্রশ্ন ।
-“ধরো বাবা। আকাশবাণী থেকে তোমার এক বন্ধু ফোন করেছেন।”
-“কে বলতো ?”
কথা বলতে বলতে দাদুর চোখমুখ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। অর্ঘ্য শুনতে পেল দাদুর খোলা গলার হাসি।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে অর্ঘ্য। আজ তিন মাস স্কুল বন্ধ। বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট, ফুটবল কিছুই হচ্ছে না। মাঝেমধ্যে দাদু লুডো আর দাবা নিয়ে তাকে ডাকেন। মা সারাদিন রান্নাবান্না, ঘরের কাজ সেরে আর গল্প করার সময় পান না। অর্ঘ্য দেখতে পায়, মা ঘুমিয়ে পড়েছে তার আগে। অনলাইন ক্লাস করতে আর কত ভাল লাগে? বেশিক্ষণ ডেস্কটপের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখ কটকট করে।
ঘর থেকে দাদু মোবাইল হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। শেষের কথাটুকু শুনতে পাচ্ছে অর্ঘ্য ।
– “এখনই লাইভ হবে? এই শোনো, আমার কিন্তু লজ্জা করছে।”
দাদুর ইশারাতে দৌড়িয়ে রেডিও আনল অর্ঘ্য। চ্যানেল অন করতেই একটা গমগমে গলা শোনা গেল – ‘আজ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিন। বাঙালির স্বর্ণযুগের এই গায়কের গান আমরা সারাদিন ধরে চ্যানেলে শোনাতে থাকব আপনাদের। এখন আমাদের মধ্যে উপস্থিত হচ্ছেন শ্রী সুশান্ত সিংহ। আশি বছর বয়স্ক এই মানুষটি সাতচল্লিশের দেশভাগ দেখেছেন, এমনকি সেসময় যে নিদারুণ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল তাও দেখেছেন ।আজকের মহামারীর থেকেও ভয়ানক কঠিন ছিল সেই পরিস্থিতি।’
অর্ঘ্য চটজলদি দাদুর দিকে তাকাল। আরে, শ্রী সুশান্ত সিংহ তো অর্ঘ্যর ঠাকুরদা। তবে কি দাদুই গাইবেন এখন?
বাবা মাকে একদৌড়ে ডেকে নিয়ে এল অর্ঘ্য।
দাদু মোবাইল কানে নিয়ে বললেন, -“আপনাদের সবাইকে নমস্কার। শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে বলার ধৃষ্টতা আমার নেই। উনি তো প্রবাদপ্রতিম গায়ক। আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন না যে হেমন্তবাবু কত বড় মনের মানুষ ছিলেন। মৃত্যুর পর ওঁর স্ত্রী বেলাদেবী জানতে পেরেছিলেন যে কত কত মানুষকে উনি টাকা পাঠিয়ে সাহায্য করতেন। অথচ কোনো প্রচার ছিল না। প্রচন্ড সংবেদনশীল মানুষ ছিলেন হেমন্তবাবু।
আপনারাই বলুন, একজন শিল্পী যদি বড় মনের মানুষ না হন, তবে তাঁর শিল্প কি অমরত্ব পেতে পারে?”
বাবা ফিসফিস করে মায়ের কানে কানে বলল, “বাবা কিন্তু ইমোশনাল হয়ে গেছেন। গান আদৌ গাইতে পারলে হয়।”
কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে দাদু ফের বলে উঠলেন, “আমি নিরাশার কিছু দেখছি না। মহামারী কিংবা মন্দা, একটু ধৈর্য ধরলে ঠিক জয় করতে পারব। মনে সাহস রাখুন। লড়াই করতে হবে। ঝড় সামলাতে হবে। জীবন একটাই। ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ হেমন্ত।”
হঠাৎ দাদুর গলায় সেই গানটা রেডিওতে শুনতে পেল অর্ঘ্য –
‘আমি আবার কাঁদব হাসব
এই জীবনজোয়ারে ভাসব
আমি বজ্রের কাছে মৃত্যুর মাঝে রেখে যাব নিশানা।
আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা।’
অর্ঘ্য দেখল বাবা মা দুজনেই হাসিমুখে ঠোঁট মেলাচ্ছে। পাশের বাড়ির দীপুজেঠু, রীনা আন্টি সবাই উঁকিঝুঁকি মারছে রেডিওতে দাদুর গান শুনে।
অর্ঘ্য জিভ কাটল মনে মনে। ইস, আগে যদি এই গানটা সে তুলে রাখত গিটারে, তাহলে এখন দাদুর সঙ্গে বাজাতে পারত। দাদু প্রায়ই বলেন, শিকড় ভুলো না দাদুভাই। যতই পপ রক শোনো, বাংলাগানের চর্চা রাখতেই হবে।
নাহ্ ফের গিটারটা নিয়ে বসতে হবে। গুলি মারো মনখারাপে। পাত্তাই দেব না একদম। মনে মনে বলল অর্ঘ্য।
-“ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ হেমন্ত। ঠিক বলিনি খোকা বল?”
দাদু উঁকি মেরে দেখলেন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। অন্যদিন নাতি চুপচাপ বসে থাকে। আজ কিন্তু গিটারের তারে ঝংকার তুলেছে।
দাদুর চোখে জল। মুখে হাসি।