গ্রীষ্মের খরদুপুরে যখন রাস্তা জনশূন্য তখন আমাদের কুকুর বাঁদরী ঘরের ভেতর ছটফট করে উঠতো। বাঁকুড়ায় তখন লোডশেডিং নামটা আসে নি। শুধু কারেন্ট চলে যেতো। কুকুররা বোঝে কখন বাড়ির মানুষ বাড়ি ফিরবে। ঘরের ভেতরে চেনা গন্ধ কমতে কমতে যে বিশেষ জায়গায় এলে তার ভালবাসার মানুষটি ফেরে সেটা ওর জানা। রোদ্দুরে লাল হয়ে আমার ছোট্ট খাট্টো মা হাসপাতালে আউটডোর সেরে ফিরতো। তারপর আমাকে খাওয়াতে খাওয়াতে নিজে খেতো। বাঁদরী জুলজুল চোখে টেবিলের নিচে বসে থাকতো।
একেবারে উল্টোপাল্টা শুরু হয়ে গেলো। আমার জীবনে তো অনেক অনেক শেকড় ছড়ানো। যদিও আমি খুব সাধারণ বাড়ির সন্তান- তবু অনেক গর্ব আমার। তাহলে প্রথম থেকেই শুরু করি।
আমার মা ইস্কুলে পড়েনি। বার্মা থেকে সম্ভবতঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়– আমাদের স্বাধীনতার সময়– ভারত ভাগের সময় রক্তাক্ত দাঙ্গা দেখতে দেখতে আমার দোদোর হাত ধরে পায়ে হেঁটে একটি চট্টগ্রামের পরিবার কলকাতায় আসে। যুদ্ধ দাঙ্গা আর হিংস্রতা আমার দিদুর সব হিসেব গন্ডগোল করে দ্যায়। দিদু পাগল হয়ে যায়। আমার মা– যে মা বিকেলের ট্রেনটা চলে গেলেই দোদোর কাছে হাজির হতো গরু দুইয়ে ঘন দুধ খাবে বলে– সেই তখন সংসারের হাল ধরে। আমার মা ইস্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। মানে ইস্কুলে পড়ে নি। আমার মা ডাক্তার।
আশ্চর্য না? অতোগুলো ভাই বোন দিদু – দেশ ছেড়ে আসা দোদো – সবাইকার রান্না বান্না করে সন্ধ্যার আলোয় বই নিয়ে বসতো। মায়ের দাদু আর আমার দোদো পড়াতো। প্রাইভেটে ম্যাট্রিক আর ইন্টার – আইএসসি পাশ করে (রেজাল্ট আমার থেকে ভালো) ডাক্তারি পড়ার জেদে মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস হয়- ঘরের সব কাজ করেই– ভাইবোনদের খাইয়ে– ইস্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করে হাসপাতালে যেতে হতো। সব দিন হয়তো খাওয়াও হতো না। তখন মা নানা জায়গায় কাজ করে – মাড়ওয়ারি বাড়ি, আরও কতো জায়গায় সে সব আমি জানি না– পেটে বাঁধালো টিবি। এবারে চললো সিকিম। সিকিমের প্রথম মহিলা ডাক্তার। সেই সুবাদে ছোটোবেলায় আমি সিকিমের রাজার সঙ্গে বসে চা খেয়েছি। তখনও সিকিম স্বাধীন দেশ।
সেখানে হয়তো পাহাড়ে জ্যোৎস্নায় অথবা পাইনের বনে ইন্টার পাস একটা ছেলের সঙ্গে দ্যাখা হয়। অমল। শিবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পড়তে সে তার বাবাকে হারিয়েছে। পড়া ছেড়ে কখনও সিনেমা হলের ম্যানেজারি– কখনও বাড়িতে বাচ্চা পড়িয়ে সাইকেলে চাপিয়ে ভাইবোনদের ইস্কুলে পৌঁছে দিতো। এভাবে দিন আর চলে না। তাই ওভারসিয়ারের চাকরি নিয়ে রাস্তা মাপতে সিকিম। ঘোড়ায় চেপে চাকরি। তাঁবু খাটিয়ে থাকা। অমল ভালো কবিতা লিখতো– আড় বাঁশি বাজাতো। (এখানে আমি একটা অন্যায় করেছি। আমি ভদ্রলোকের ঐ সময়ের ডায়েরি পড়েছি– কিন্তু সে খবর বড় ব্যক্তিগত– গোপন থাকাই ভালো।)
যাই হোক সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে অমল গায়ত্রীর বিয়ে হয়ে গেল। অমল তখন প্রাইভেটে বি.এ. আর এম.এ. করে চাকরির লড়াইয়ে। এরপর গঙ্গাজলহাটি। সেখানে তাদের প্রথম সন্তান। সুন্দর ছিলো তার নাম। অমল তাকে এক বসন্তের ভোরে দোলের দিনে- রংয়ের দিনে পরম যত্নে এক শিমুল গাছের শিকড়ের কাছে গচ্ছিত রাখে। দুজনে হয়তো বলে আসে “হে শিমুল আমাদের প্রথম সন্তানকে রেখে গেলাম– খেয়াল রেখো।” সেদিন থেকে ওদের দুজনের সব রং ঐ শিমুলকে দিয়ে এসেছে। আর কোনোদিন তারা দোল খেলে নি। আমৃত্যু।
তারপর সেখান থেকে দন্ডকারণ্যেরই পথে। তখন ওরা আমার মা বাবা। আমি এসে গেছি। সেজমামা এসে সদ্যজাত আমাকে বড়ো করে। ওরা কোথায় যেতো – কি করতো তার কোনও তথ্য আমার কাছে নেই।
সেখান থেকে অনেক ঘুরে বাঁকুড়া। এখানে একটা ঘটনা ঘটে। যেটা আমি তখন বুঝি নি। আজও হয়তো পুরোটা বুঝতে পারি না। নকশাল আন্দোলনের সময়– বড়ো অস্থির সময়। প্রতিদিনই একটা তরুণের মৃত্যুর খবর। এনকাউন্টার। আমি শব্দটাকে ঘেন্না করি। ছোট্ট থেকে। একদিন কিছু ছাত্র এসে বাবার অফিসে আগুন দ্যায়। বাবা ছাত্রদের চিনতো। আমি জানি। তারা পরে রাতে গোপনে বাবার সঙ্গে দেখা করে যেতো। পুলিশ বাবাকে ধরে। “আইডেন্টিফাই দেম”। না। অমল নাম বলে নি। গায়ত্রী জানতো তার অমল কোনও ছাত্রের নাম বলবে না। আর কোনও এনকাউন্টার নয়। আর মৃত্যু নয়। দীর্ঘদিন অমল এক দূরের ছোট্ট শহরে বদলি থাকে।
এখানেই শেষ করি। আমার জীবনের শেকড় বহু বিস্তৃত। বাকিদের কাছে ক্ষমা চাই। এটা কেবল মাতৃপিতৃতর্পণ।