ফিরতেই সব মনে পড়ল। রোগের অ্যাটাক যখন হয়, আমি যেন অন্য একটা পৃথিবীতে হাজির হই।
আমার অসুখ একটা না… অনেকগুলো। হাসপাতালে ডাক্তার ম্যাডামের কাছে এসে ধরা পড়ছে একে একে।
এই রোগের অ্যাটাকের সময় অজ্ঞান হই না। বেশিরভাগ সময় আশেপাশের কেউ বুঝতেই পারে না।
ম্যাডাম নিউরোলজিস্ট বন্ধুর কাছে পাঠিয়েছিলেন কনফার্ম করতে। রোগটার নাম অ্যাবসেন্ট সিজার। একধরণের মৃগী। রোগে অন্যদের কী হয় জানি না। আমার কেমন যেন মনে হয়, সমান্তরাল বিশ্বে গিয়ে হাজির হই ওই সময়টুকুতে। তার সবকিছুই এখানের মত। শুধু একটু একটুখানি আলাদা।
আমি ফিজিক্সে এমএসসির ফার্স্টইয়ার। বন্ধু আনোয়ারের মেসে থাকি। খাট শেয়ার করতাম। এখন অসুখের কারণে আনোয়ার আমাকে খাটে শুতে দেয় না। মেঝেতে শুই। কপাল ভালো, বের করে দেয়নি। কলকাতায় আমার থাকার জায়গা নেই।
প্যারালাল ইউনিভার্স ব্যাপারটা আমি জানি। আমার ধারণা নিম্ন বুদ্ধিবৃত্তির প্রাণীরা এই সমান্তরাল পৃথিবীগুলোতে যাতায়াত করতে পারে। যেমন নেড়ি কুকুররা। দিব্যি আছে আছে। হঠাৎই কিছুটা দৌড়ে গিয়ে, কেন গেল কার্য কারণ না বুঝেই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আবার ফিরে আসে, যেন এই মাত্র চেনা পৃথিবীতে ফিরল। আমার বুদ্ধিবৃত্তিও ওইরকম নিম্নমানের।
অবশ্য শেষ অসুখটার ব্যাপারেই এখানে এসেছিলাম। ম্যাডাম আর তাঁর স্যার রোগটা ধরলেন। আমার ফুসফুসে ক্যান্সার। যদিও আমার বয়স মাত্রই তেইশ। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, এই বয়সে এই অসুখ বিরল। এবং প্রাণঘাতী। সিটি স্ক্যান, ব্রঙ্কোস্কোপি, বায়োপসি কত শব্দ শিখে গেলাম গত এক বছরে।
চেস্ট ডিপার্টমেন্ট অঙ্কোলজিতে পাঠাল। এখন কেমো শেষ করে রেডিওথেরাপি। অঙ্কোলজির স্যারেরা একটুও আশা দিচ্ছেন না। ম্যাডাম বলেছেন অঙ্কোলজি যা বলে যেন অবশ্যই জানিয়ে আসি।
সেই কথা জানাতে এসে আজ জানলাম ম্যাডাম খুন হয়েছেন। গতকাল রাত্রে। হাসপাতালেই।
মেসে ফিরেই আমার ফের অ্যাটাক হল।
সমান্তরাল সেই জগতে ম্যাডামের সঙ্গে দেখা হল। ওই জগতে ম্যাডাম মারা যাননি। খুব যত্ন করে আমাকে দেখে বললেন, —- তাহের, তুমি সেরে যাচ্ছো। ভয় পেয়ো না। আমি তো আছি। থাকবও।
জানি, আমি খুব তাড়াতাড়ি মারা যাব। কিন্তু কোনও প্যারালাল ইউনিভার্সে আমি বেঁচে থাকব তারপরও। আর আমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই সেই জগতে বেঁচে থাকবেন মিতা ম্যাডাম।