(একটি অবান্তর উত্তর-আধুনিক ফ্যান্টাসি)
_________________
হইহই কাণ্ড বেধে গেছে। কী ব্যাপার? না, এক জোড়া ছেলেমেয়ে চুমু খেয়েছে পরস্পরকে।
সে তো বহুকাল ধরেই ছেলেমেয়েরা চুমু খাচ্ছে। এই নির্বোধ আচরণ তো সৃষ্টির আদি থেকেই চলছে। এই নিয়ে হট্টগোলের কী আছে?
আছে, মশাই আছে। নিউরাল নেটওয়ার্কের কেন্দ্রীয় সেন্সরে মনের ভাব লুকিয়ে এই চুমু খাওয়ার ঘটনা ধরা পড়েছে। সেই মত অ্যালার্মও বেজেছে নিরাপত্তা রক্ষীদের পেজারে।
চুমু-আসামী অরূপ নাকি সেই অনন্ত চুম্বন-মুহূর্তে ভাবছিল, এই বারও যদি চাকরির প্যানেল ক্যানসেলড্ হয় তবে সংসার বাঁধবে কী করে।
অন্য আসামীটি মহিলা। মা মরা মেয়ে সরস্বতী যার ডাকনাম সরো, সে ভাবছিল, অরূপ চাকরি পেয়ে ওকে বিয়ে করলে তো নতুন বাসা। বাড়িতে সরোর রোগাভোগা বাবাটাকে দুবেলা ভাত কে বেড়ে দেবে আর ওষুধই বা কে দেবে? ইশ্, মা যে কেন সাততাড়াতাড়ি চলে গেল!
আপাতত হেফাজতে আছে আসামী দু’জন। বহিষ্কারের অর্ডার বেরোল বলে। কলোনি থেকে বহিষ্কার মানে মৃত্যুদণ্ডই একরকম।
আমাদের এই কলোনিতে নিয়মকানুন খুব কঠিন। এখানে মনের ভাব লুকিয়ে কোনও কাজ করা যাবে না। একেবারে সর্বোচ্চ নির্দেশ। ধরা পড়লে, সমস্ত স্মৃতি মুছে দেওয়া তো হবেই। তার পর কলোনি থেকে বহিষ্কার।
বুঝিয়ে বলি।
ছাত্র একটা জিনিস বুঝতে পারেনি ক্লাসে। মাস্টারমশাইকে জিজ্ঞেস করেছে। হতেই পারে, তিনিও জানেন না। জ্ঞানের অভাব ঢাকা দেওয়া চলবে না। বলতে হবে, – আমিও ঠিক জানি না। ক্লাসের শেষে লাইব্রেরি যাব, বই সিডি ইন্টারনেট খুঁজে উত্তরটা বার করব। দরকারে আমার চেয়ে বেশি জানতে পারে এমন কাউকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেব। সে তোমাদের মত কোনও ছাত্রও হতে পারে। যদি জানতে পারি, বুঝতে পারি, তোমাকে বুঝিয়ে দেব।
কিম্বা ধরো, অসুখ করেছে। ডাক্তারের কাছে গিয়েছ। তো সে যে সব রোগ ধরে ফেলবে এমন তো না। কিন্তু না ধরেও ওষুধ দিতে হয়। অসুখ সেরেও যায়। আগেকার দিনে ডাক্তারেরা অসুখ ধরতে না পারলেও ভাব দেখাতো রোগ ধরে ফেলেছে ঠিকঠাক। এখন আর সেটি হবার উপায় নেই। আগেই বলে দিতে হবে, – বাপু হে, আমি এই অবধি বুঝেছি। সেই মত ওষুধ। বাকিটা বুঝিনি। বুঝবার চেষ্টা করছি।
কোর্টে খুব গণ্ডগোল হয়েছিল এই নিয়ে প্রথমদিকে। সেখানে তো আসামি ফরিয়াদি জজ উকিল পেশকার সবাই মনের ভাব লুকোতে ব্যস্ত। আদালত উঠে যাবার জোগাড়। তারপরে বাধ্য হয়েই মানিয়ে নিল সবাই। সেন্ট্রাল কাউন্সিলের নির্দেশ বলে কথা। এখন আদাললতে যদি যাও, নো পেন্ডিং কেস। ঝপাঝপ বিচার হয়ে যাচ্ছে পাঁচমিনিটের মধ্যে। লুকোনোর কোনও ব্যাপার নেই তো।
কর্পোরেট আপিস, রিয়াল এস্টেট শুদ্ধ সমস্ত ব্যবসা, মায় চোরা চালান অবধি জব্দ। ওই যে, মনের ভাব লুকোনো যাবে না।
অনেক আগেকার দিনে সিসিটিভি বলে এক বস্তু ছিল বলে নথিতে আছে। সমস্ত সন্দেহজনক জায়গায় নাকি যান্ত্রিক চোখ বসানো থাকত। সে মেশিন উঠে গেছে কবেই। নতুন টেকনোলজি বেরিয়েছে। এখন কোনও জায়গায় গত একশ দেড়শ বছরে কী ঘটেছে, মেশিনে সেই কো-অর্ডিনেট ফেলে সেখানের টাইম লেয়ারড্ ইমেজ চেক করলেই বোঝা যায়। একে বলে স্থানিক স্মৃতি। যে কোনও কো-অর্ডিনেটেই সেখানের স্মৃতি রয়ে যায়। যাক, সে কথা।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম! সেই সিসিটিভি গোছেরই এক মেশিন বসানো হয়েছে। সর্বত্র। ডিটেক্টর সিস্টেমটার নাম উচ্চৈঃশ্রবা। অফিস, কাছারি, ব্যবসার জায়গা, রাস্তা, পার্ক, বাড়ি। কেউ কোথাও মনের ভাব লুকোচ্ছে জানতে পারলেই সেন্ট্রাল রিসেপ্টর অ্যানালাইজারে সিগন্যাল চলে যাবে।
তো সেই মনিটরিংএ ধরা পড়েছে অরূপ আর সরো মনের ভাব লুকিয়েছে দুজনেই, ওই চুমু খাবার সময়ে। বিচার শুরু হয়েছে। কিন্তু এই বিচার পাঁচ মিনিটে হবে না। সময় বেশি লাগবে।
পুরোনো নথিতে পাওয়া গেছে, চুমুর সময়ে বিচার্য হচ্ছে যারা চুমু খেয়েছে তাদের মধ্যে সত্যিই ভালোবাসা ছিল কিনা। ভালোবাসা যদি থেকে থাকে, তবে সেই সময়ে মনে অন্য যাই ভাবনা থেকে থাকুক সেটা ওভাররাইট করে ভালোবাসাই রেকর্ডেড বলে ধরতে হবে।
এই ভালোবাসা ছিল কি ছিল না, সেটা নির্ধারণ করার পদ্ধতি জটিল ও গাণিতিক। নানান স্কেলার ও ভেক্টর রাশিকে ইকোয়েশনে ফেলে এই প্রায় অনির্ণেয় ভালোবাসার মান বার করতে হয়।
রেটিনা স্ক্যান, পুরো শরীর ও ব্রেনের থেকে পাওয়া সঙ্কেত, পারিবারিক ও সামাজিক ইতিহাস, স্কুলের রেকর্ড, লোকেশন, স্থানীয় চৌম্বকমান, হিউমিডিটি, তাপমাত্রা আরও লক্ষ লক্ষ অন্যান্য ডেটা যাদের যোগসূত্র সাধারণ মানুষ বুঝবেই না, সেগুলি জোগাড় করা হয়েছে।
প্যারালালি সংযুক্ত দু’টো সুপার কমপিউটার অঙ্কটা কষছে। জটিল হিসেব। যন্ত্রদুটো, ব্যবস্থা নেওয়া আছে যদিও, বিপজ্জনক ভাবে গরম হয়ে উঠেছে।
অনেক পরে হিসেবের ফলাফল জানা গেল। পাশাপাশি দুই গণকের দুই মনিটরে মায়াবী রঙের ব্যাকগ্রাউন্ডে রেজাল্ট ভেসে উঠেছে,
প্রথম মনিটরটায় লেখা,
ভালোবাসা ছিল… আছে… থাকবে!
দ্বিতীয়টা একটু কবি প্রকৃতির যন্ত্র গণক। তার মনিটরেও রায় ভেসে উঠেছে, তাতে লেখা…
প্রেমে না পড়েই ওরা খেয়েছিল কিস্ কি?
ব্যাকরণ মতে সে’টা নিদারুণ রিস্কি।
মিথ্যা ডিটেক্টর
স্কেলার আর ভেক্টর
মেপে ঝুপে বলে,না হে, ব্যাপারটা ইশক্ই!