আমাদের পারসোনালিটি (personality) বা ব্যক্তিত্বের চারটে মূল স্তম্ভ। এই চারটি জিনিসের কম-বেশি থাকা নিয়ে একজনের ব্যক্তিত্বের ছাঁচ (mould) গঠিত হয়। প্রথমে হল- Harm Avoidance অর্থাৎ যেকোনো রকম ক্ষতি থেকে দূরে থাকার প্রবণতা, তারপর Novelty Seeking অর্থাৎ নতুনত্বের সন্ধান করা, তিন Reward Dependence অর্থাৎ পুরস্কারের বা কোনও কিছু আনন্দকর পাওয়ার উপর নির্ভরতা চার, Persistence অর্থাৎ অটল্ভাবে কোনও কিছু চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার শক্তি।
ধরুন কারোর harm avoidance অনেক বেশি অর্থাৎ তার আচরণে অনেক বাধা-কুণ্ঠা-জড়তা থাকবে। সে অনেক বেশি লাজুক হবে, খুব সহজে ক্লান্ত হয়ে পড়া, সামাজিক জড়তা, সামান্য রিস্ক বা বিপদ দেখলেই ঝুঁকি না নিতে চাওয়া, দুঃখবাদী হতাশাপূর্ণ থাকা। যার কম সে চিন্তাজনক পরিস্থিতিতেও অনেক বেশি ভাবনাহীন, সাহসী, আত্মবিশ্বাসী, আশাবাদী থাকবে। এইবার কম বা বেশি থাকা দুটোরই কিছু সুবিধা আর অসুবিধা রয়েছে। যাঁদের এই harm avoidance বেশি তাঁরা অনেক সময় বিপদ না থাকলেও তার আশঙ্কা করে খুব দুশ্চিন্তায় ভোগেন আবার বিপদ সঠিক ভাবে বুঝে তাঁরাই হয়তো সময় নিয়ে বাস্তবিক ও সচেতন হয়ে খুব সুন্দর একটা প্ল্যান বানিয়ে সঙ্কটের সময় উতরে যেতে পারেন। আবার যাঁদের এই harm avoidance কম তাঁরা জটিল পরিস্থিতিতে ভরসাযোগ্য হয়ে ওঠেন কিম্বা অনেকসময় ঝুঁকির মাত্রা না বুঝে অবাস্তবিক আত্মবিশ্বাস এঁদের ক্ষতিও করতে পারে।
যাঁর novelty seeking বেশি, তিনি অনেক কৌতূহলী, অনুসন্ধিৎসু, অগোছালো থাকবেন মাঝে মাঝে হঠকারী ও অসংযত হয়ে উঠতে পারেন, খুব সহজে কোনওকিছু একঘেঁয়ে লাগতে পারে। যাঁর novelty seeking কম তিনি নির্বিকার, নিরুৎসাহী, সংযত, সল্প-ভাষী, ধীর, মিতব্যয়ী, সুনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করবেন। অনেক সময়ই দেখা যায় যাঁদের novelty seeking বেশি তাঁরা নতুন জিনিসের খোঁজে উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে বিভিন্ন কিছু আবিষ্কার করেন, নতুন নতুন জায়গা ঘুরে দেখেন, কিন্তু অনেক সময়ই এঁদের হঠকারিতা, রাগ প্রকাশ, সম্পর্কে অস্থিরতা জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। আবার যাঁর novelty seeking কম তিনি ধীর স্থির হয়ে নিয়ম মেনে কাজ করে সফল হতে পারেন অথবা নিরুৎসাহী একঘেঁয়ে এক বিরক্তিকর এক লোক হয়ে উঠতে পারেন।
এবার reward dependence যাঁর বেশি তিনি অনেক বেশি সামাজিক যোগাযোগে থাকবেন- খোলা মনের, আবেগপূর্ণ, অনুভূতিশীল, অনুরক্ত, স্নেহশীল, নিবেদিত, নির্ভরযোগ্য এক ব্যক্তি হবেন। যাঁর reward dependence কম তিনি সামাজিক ভাবে বিচ্ছিন্ন, রুঢ় বাস্তববাদী, নির্লিপ্ত হয়ে থাকবেন। প্রথম অংশের মানুষেরা সামাজিক ভাবে খুব সাহায্যকারী হয়ে ওঠেন এবং আন্তরিক ভাবেই পাশের লোকটিকে সাহায্য করতে চান,কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এনাদের নিজস্ব স্বাভাবিক বিকাশ খর্ব হতে পারে। দ্বিতীয় অংশের অর্থাৎ যাঁদের reward dependence কম তাঁদের সুবিধা হল তাঁরা নিজেদের ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব করেন না, অন্যকে খুশি করতে গিয়ে নিজেদের দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলেন না, কিন্ত সামাজিক ক্রাইসিসের মুহূর্তে এনারা বিচ্ছিন্ন থাকেন।
সব শেষে যাঁদের persistence বেশি তাঁরা উচ্চাকাঙ্ক্ষী, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, পরিশ্রমী ব্যক্তি৷ উল্টোদিকে যাঁদের persistence কম তাঁরা অল্প বাধা-বিপত্তি দেখলেই উদ্যম হারিয়ে ফেলেন, লক্ষ্যভ্রষ্ট সিদ্ধান্ত নেন, অনিশ্চিত অলস জীবন কাটান। যাঁদের persistence অনেক উঁচুতে বাঁধা তাঁরা ক্রমাগত নিজেদের কাজের মাত্রা বাড়িয়ে নিয়ে যেতে থাকেন পুরস্কারের আশায় অর্থাৎ কোনও কিছু লাভের আশায়- যেখানে অল্প হলেও কোনও কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, যতই সামনে দ্বন্দ্ব বা প্রতিবন্ধকতা আসুক না কেন তাকে এনারা চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেন। জীবনে নিজের ক্ষমতার চেয়েও অনেক বড় কিছু অর্জন করতে পারেন কিন্তু যখন এই লাভের বা কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা কমে আসে তখনই এনারা অস্থির হয়ে ওঠেন, তাঁদের পরিশ্রমী, লেগে থাকার অভ্যাসে বিঘ্ন ঘটে। যাঁদের persistence নিচুর দিকে তাঁরা সামাজিক বা পেশাগত কোনও কিছু হবার সম্ভাবনা না থাকলে খুব শান্ত ও সুস্থির থাকেন অন্যদিকে সম্ভাবনার সুযোগ থাকলেও এনারা তার দিকে নিজেকে নিয়োজিত করেন না।
উপরের এই চারটি স্তম্ভ বা বৈশিষ্ট্যকে বলে Temperament যা মূলত আমাদের জীনগত (genetic) অর্থাৎ উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত (heritable) যার লক্ষণ ছোটবেলা থেকে শুরু হয় আর বয়স বাড়তে বাড়তে পাকাপোক্ত হয়ে ওঠে। যার মূল নির্ণায়ক আমাদের জৈবিক গঠন (biological) যেমন ধরুন harm avoidance-এর প্রধান নিউরোমডুলেটার (মস্তিষ্কের রাসায়নিক উপাদান) হল GABA (গাবা)। ঠিক এরকম novelty seeking এর প্রধান নিউরোমডুলেটার হল Dopamine (ডোপামিন) ইত্যাদি।
অর্থাৎ temperament অনেক বেশি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে, আমরা একে খুব কাটাছেঁড়া করে খুব পরিবর্তন করতে পারি না।
তাহলে আমাদের ব্যক্তিত্ব (personality)-এর কোন জিনিসটা আমরা পরিবর্তন করতে সক্ষম??
তা হল- character অর্থাৎ চরিত্র, আমাদের ব্যক্তিত্বের মানসিক অন্তঃসার। উপরে বর্ণিত temperament-এর সাথে আমাদের প্রাথমিক অনুভুতি (basic emotion)-র সম্পর্ক রয়েছে যেমন ভয়, রাগ, কিন্তু character-এর সাথে আমাদের আনুসাঙ্গিক অনুভূতি (secondary emotion)-র সম্পর্ক রয়েছে- ধৈর্য, ভালোবাসা, সহমর্মিতা, আশা এইসবের। এই চরিত্র আমরা তৈরি করি নিজেরা। যা নিজেদের কাছে অনেক বেশি যৌক্তিক ও ইচ্ছাকৃত। আমাদের চরিত্র তাই চিন্তাভাবনার বিমূর্তন (abstraction) যুক্তি, ব্যাখ্যা কার্য-কারণ সম্পর্ক নিয়ে অনেক বেশি জড়িত। Character বা চরিত্র তাই একজনের নিজস্ব-পরিচালনা (self-government) সংস্থার মত, যার এই তিনটে দিক রয়েছে
- এক, self-directedness অর্থাৎ নিজের সত্ত্বার প্রতি অন্তর্দৃষ্টি। যাঁদের self-directedness অনেক বেশি মাত্রায় তাঁরা দায়িত্বশীল, করিৎকর্মা, স্বতঃস্ফূর্ত ব্যক্তি হয়ে ওঠেন যাঁদের কম মাত্রায় তাঁরা অন্যকে দোষ দেওয়া, ছন্নছাড়া, নিস্ক্রিয়, নিরর্থক থাকেন।
- দুই, cooperativeness অর্থাৎ সহযোগিতা-এটি চরিত্রে সামাজিক দিক। যাঁদের এই ভাগটা বেশি তাঁরা সহনশীল, সমব্যথী, সাহায্যকারী, নীতি-আদর্শবান ব্যক্তির মত কাজ করেন যাঁদের কম তাঁরা অসংবেদনশীল, স্বার্থপর, প্রতিশোধপরায়ণ, সুবিধাবাদী ব্যক্তি।
- তিন, self-transcendence অর্থাৎ নিজেকে নিয়ে সর্বোৎকৃষ্ট চেতনা। যিনি নিজেকে সমস্ত কিছুর বাইরে বেরিয়ে ভাবতে পারেন-আদর্শগত ভাবে আধ্যাত্মিক চিন্তা করার প্রবণতা। যাঁদের self-transcendence বেশি তাঁরা ধ্যানপরায়ণ, চিন্তাশীল, অধ্যয়নশীল, কল্পনাধর্মী হয়ে ওঠেন, সমস্ত বিশ্বকে নিজের মনে করতে পারেন, সেই ধারণায় কাজ করতে থাকেন। এনারা বৈষয়িক জীবনের বাইরে জীবনের মানে খোঁজার চেষ্টা করেন। উল্টোদিকে যাঁদের self-transcendence কম তাঁরা ব্যক্তিকেন্দ্রিক, সন্দেহবাদী, বিষয়গত হয়ে ওঠেন, অর্থ-সম্পদ ক্ষমতা এঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
কিন্তু চরিত্রের এই দিকগুলো পরিবর্তনশীল হলেও খুব সুবিধাজনক কিছু নয় কারণ এগুলো temperament-এর তুলনায় অনেক কম পরিণত,অনেক কম সামাজিক প্রেক্ষিতে প্রযোজ্য।
উপরে বর্ণিত এই চারটে temperament এবং তিনটি character নিয়ে personality বা ব্যক্তিত্বের এই মডেলটি সর্বাধুনিক যা TCI-(Temperament and Character Inventory) বলে খ্যাত, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিস্ট রবার্ট ক্লোনিঞ্জার (Robert Cloninger) এর প্রবক্তা।
Temperament-এর স্বয়ংক্রিয়, অসচতেন, স্বতঃস্ফূর্ত, পূর্বনির্ধারিত প্রতিক্রিয়া এবং character-এর সচেতন, ব্যক্তি চিন্তার উপলদ্ধি – এই দুইয়ের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া ও বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে একজনের বা ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
আপানারা কি উপরের লেখাটি পড়ে নিজের personality সম্পর্কে আঁচ করতে পারেন??? কোন temperament কম, কোন character বেশি???
চমৎকার