[উইলিয়াম সিডনি পোর্টারের গল্প অনুকরণে লেখা। কোন গল্পটি মনে নেই- এই মুহূর্তে আমার বইয়ের সঞ্চয় পাঠভবন আমার থেকে দূরে আছে।
হ্যাঁ যাকে সবাই ও’ হেনরি বলে জানেন। মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে ছ’শো গল্পের লেখক। প্রথম জীবনে ব্যাঙ্ক তছরূপের দায়ে তাড়া খেয়ে পালানো উইলিয়াম সিডনি পোর্টার- ছদ্মনাম ও’ হেনরি। এটাকে বলা যায় দেশীয় আত্তীকরণ]
ডুয়ার্সের বনভূমি দিয়ে ছুটে চলেছে ট্রেন। নববিবাহিত দম্পতি চলেছে মধুচন্দ্রিমায়। জানালা দিয়ে ঝিঁঝিঁর শব্দে ট্রেনের শব্দ ঢাকা পড়ে যায়। নববধূর মুখে একটু যেন উদ্বেগ, একটু আশঙ্কার ছাপ।যেন সে প্রহর গুনছে।
হতেই পারে। ফুলশয্যাও হয় নি। নববধূর শর্ত মধুচন্দ্রিমায় গিয়ে হবে মিলন।
কামরার দরজায় হেলান দিয়ে ছেলেটা সিগারেট টানছে। সে ঐ মেয়েটার স্বামী। কিছুটা গর্বোদ্ধত। এমন একটা মেয়েকে রাজি করাতে পেরেছে।
মেয়েটি সত্যিই সুন্দরী। বাঙালি শ্যামলা গায়ের রঙ। পানের ডৌল মুখখানায়। ডাগর দুটি চোখ। জানালায় হাত রেখেছে।হাতের ওপরে মুখখানি। চূর্ণ কুন্তল এলো হাওয়ায় ওড়ে। আর ওড়ে নববধূর সিঁদুরের গুঁড়ো। শাল পিয়াল গাছ আর গুল্মের দল সোঁ সোঁ করে’পেরিয়ে যায়। দূরে ট্রেনের বাঁশি শোনা যায়।
মেয়েটার নাম ধরা যাক ছন্দা। স্বামী হয়তো বরেন্দ্র। সে এসে দ্রুত হাতে মালপত্র দরজার সামনে নিয়ে যায়। একটা লাল সুরকি ঢাকা, ছোট্ট নিঃসঙ্গ স্টেশনে তারা নেমে পড়ে। একটা মাত্র রিকশা দাঁড়িয়ে ছিলো। একটা মাত্র চায়ের দোকানের সামনে। সেই একটা মাত্র ছোট্ট স্টেশনে। বরেন্দ্র রিকশাওয়ালাকে ডেকে জিনিসপত্র তুলে ছন্দাকে রিকশায় তুলে’, নিজেও বসলো।
একটা সুন্দর সাজানো গোছানো কটেজ তাদের আস্তানা।
কটেজ মালিক ফুল দিয়ে ঘর সাজিয়ে রেখেছে। চমৎকার সব খাবার।কিন্তু ছন্দা খুঁটে খুঁটে খায়। নববধূর লজ্জায়। বিকেলে হাঁটতে যাওয়ার কথা। তারপর ওয়াইনের বোতল। ফুলশয্যা।
ছন্দা বিছানায় হাতে মাথা গুঁজে ছটফট করছে। “অসম্ভব মাথা ব্যথা” চোখ বেয়ে জল পড়ে। বরেন্দ্র মাথায় হাত বুলিয়ে দ্যায়।চুল এলোমেলো হয়ে যায়। “ওগো তুমি একটা ডাক্তার ডাকো নাহলে আমি মরেই যাবো….অসহ্য ব্যথা…..মনে হচ্ছে মাথাটা ছিঁড়ে যাবে….কিছু একটা করো…”
বরেন্দ্র পাগলের মতো ছুটে যায় রিকশাওয়ালার বাড়ি। সেখান থেকে হাসপাতাল। হাসপাতালের আউটডোর বন্ধ। একটা দ্বারোয়ান দেশী মদ খেয়ে, কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে।
রিকশাওয়ালা বললো “ঐ ছোটো গ্রামটার পেছন দিকে একটা বুড়ো ডাক্তার থাকে, মনটা ভালো, ডাকলে আসে”
গ্রাম মানে কয়েক ঘর মানুষ। উত্তরবঙ্গের বাঁশ আর লতাপাতার ভেতর দিয়ে পথ। রিকশাওয়ালার বাড়ি এই গ্রামে। সে আর যাবে না। তার বাড়ির নেশা আর তাড়ির নেশা চেপেছে।
বরেন্দ্র হাঁটতে লাগলো। একটা জানালায় এক জন মানুষ বসে আছে। একটা ম্লান আলো জ্বলছে। মনে হচ্ছে ভেতর থেকে একটা গোঙানির শব্দ আসছে। মাঝে মাঝে। বরেন্দ্র সব কথা গুছিয়ে বললো।
বুড়ো মাছি তাড়ানোর মতো করে হাত নেড়ে জানালো যাবো না।তারপরও বরেন্দ্র দরজায় আওয়াজ করছে, দেখে দরজা খুলে দিলেন। মুখে বেশ ক’দিনের না কামানো দাড়ি, বিষণ্ণ মুখের এক বৃদ্ধ ডাক্তার। সে রোগী দেখতে যেতে রাজি নয়। বরেন্দ্র নানাভাবে কাকুতি মিনতি করলো। শেষে বুড়োকে পবিত্র ডাক্তারি শপথের কথা মনে করিয়ে দিলো।
উশকো খুশকো চুলের ঈষৎ পৃথুল বুড়ো কোটটা গায়ে গলিয়ে নিলেন। পুরোনো রংচটা হয়তো, পাশ করার বছরে কেনা, ডাক্তারি ব্যাগটা হাতে তুললেন। তারপর দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে’ দুজনে হাঁটা দিলেন বন্ধুর পথে। বরেন্দ্র বারবার এগিয়ে যাচ্ছে, বুড়ো মোটা সোটা ডাক্তার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পেছনে পেছনে।
কটেজের দরজাটা হাট করে’ খোলা। বরেন্দ্র দৌড়ে গিয়ে ঘরে ঢুকলো। শূন্য ঘর। ডাক্তার হাঁফাতে হাঁফাতে ঘরে ঢুকে দেখে ও ফুলে সাজানো বিছানায় বসে’ আছে, হাতে একটা চিঠি। বুড়ো ভেতরে এসে বলে “রোগী কোথায়?”
বরেন্দ্র চিঠিখানা এগিয়ে দ্যায়। “বরেন্দ্র, আমি যাকে ভালবাসি, যে আমাকে ভালবাসে- তার সঙ্গে চললাম। দুঃখিত। নাহলে আমিও সুখী হতাম না। তুমিও না। ভালো থেকো।”
ডাক্তার ক্ষোভে ফেটে পড়লেন “আপনাদের লজ্জা হওয়া উচিত।ছি ছি ছি ছি ছি। একটা জঘন্য, নোংরা,পারিবারিক ব্যাপারে আপনারা…….আপনাদের কোনও লঘুগুরু জ্ঞান নিয়ে…..অমানুষ সব…..ইতর…..ছোটোলোক…”
বরেন্দ্র বিষ্মিত হয়ে বলে “এ আপনি কি বলছেন? এই আপনার মানবতা? আমি কতো কষ্টে ছন্দাকে ওর পরিবারকে রাজি করিয়ে….একটা সংসার পাতবো বলে….আপনার কোথাও এ কথাগুলো বলতে আটকাচ্ছে না? আমার এই শোকের সময়…”
ডাক্তার বিরস মুখে বলেন “শোক? আমি একটু আগে আমার একমাত্র সন্তানকে দাহ করে’ এসেছি… ঘরে আমার স্ত্রী এখনও মূর্ছাহত….”
ডাক্তার ধীরপায়ে অন্ধকার, শেয়াল ডাকা পথে ব্যাগ হাতে ফিরে চলেন।