জীবন কখনো সমস্যাহীন হয় না। তেমনি সমস্যাহীন হয় না ব্যক্তি মানুষও। প্রতিটি মানুষের নিজস্ব দোষ গুণ থাকে, সেগুলো নিয়েই তারা মানুষ হয়ে ওঠেন, মনুষ্যত্বের অধিকারী হন। মৃত্যুর আগে অবধি মানুষ এই সব মিলিয়ে মিশিয়ে সমস্ত দোষ গুণের ছাপ নিজের জীবনে ফেলে রেখে যায়। তাই প্রথমেই কোনও মানুষকে তার নেতিবাচক দিক দিয়ে বা দুর্বলতা দিয়ে বিচার করতে যাওয়ার প্রবণতা সেই মানুষের প্রতি আমাদের চূড়ান্ত অবিচার এবং নিজেদের ক্ষমতার আস্ফালন ছাড়া আর কিছু নয়!
মোটামুটিভাবে আমরা ধরে নেই যে প্রথাগত সাইকোলজি (Classical Psychology) মানুষের ব্যবহারের সমস্যাজনক দিকগুলোকে খুঁজে বের করে এবং সেই অনুযায়ী তাকে কমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু এর একটি সীমাবদ্ধতা রয়েছে। শেষ কয়েক দশক ধরে এটি অনেকবেশি পরিমাণে অবহেলা করেছে মানুষের নিজস্ব চারিত্রিক গুণকে, মানুষের ভালো থাকার ইচ্ছেকে, একটা সুন্দর প্রাণোচ্ছল ভালো জীবন সম্পর্কে সে প্রায় কিছুই বলে উঠতে পারেনি!
আরও সূক্ষ্মভাবে বলতে গেলে, মনোবিজ্ঞানের অন্তর্নিহিত অনুমানগুলি আসলে সংকুচিত হয়েছে মানুষের ডিসিজ (Disease) মডেলের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থাৎ রোগ-অসুখের বিচারে। প্রথাগত সাইকোলজি অনেক বেশির পরিমাণে ল্যাবরটরিতে জৈব প্রাণীদের উপর পরীক্ষা, তাদের প্রতিক্রিয়া আচরণ, মানুষের ব্যবহার পরিমাপ করার উপায় এইসব নিয়ে গবেষণা করত তার মাধ্যমে চিকিৎসা খোঁজার চেষ্টা করেছে। মানুষকে দেখা হয়েছে ত্রুটিপূর্ণ এবং ভঙ্গুর, এক নিষ্ঠুর পরিবেশের শিকার কিম্বা কোনও বদ জেনেটিক্সের (Genetics) প্রতিচ্ছবি হিসেবে। এই বিশ্বদর্শন আজ আমাদের সাধারণ জীবন-সংস্কৃতিতেও প্রবেশ করেছে গভীরভাবে। উদাহরণ স্বরপ বলা যায় কিছু মানুষ নিজের খণ্ডিত আত্মপরিচয় নিয়ে স্ব-ঘোষিত ভাবে সারাক্ষণ সারভাইভর (Survivor) মোড অন করে রয়েছে অর্থাৎ নিজেকে যেন বাঁচিয়ে নিয়ে রাখার চেষ্টা করছে আজকের প্রতিযোগিতার দুনিয়ায়, কিন্তু এই মনোভাব যেমন তার নিজের জীবনের উন্নতির জন্য বাঞ্ছনীয় নয় তেমনি সামাজিক সমষ্টিগত ভাবেও এক প্রতিবন্ধকতা।
প্রথাগত সাইকোলজির বিকাশে উল্লেখযোগ্যভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মনোবিজ্ঞান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে একটা ভারসাম্য বজায় রেখে চলছিল। তার মূলত তিনটি প্রধান ভরকেন্দ্র ছিল-
(১) মানসিক রোগ সারানো।
(২) প্রত্যেকের জীবন আরও গভীর ভরাট আর প্রাণবন্ত করে তোলা।
(৩) আর মানুষের নিজস্ব ভাল দিকগুলো চিহ্নিত করা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক কিছুর পরিবর্তন আনে। অনেক কিছুরই বাস্তবতা বদলে যায় এইসময়। অর্থনৈতিক সংকট থেকে শুরু করে বিশ্ব রাজনীতির অক্ষ অনেকটাই পরিবর্তিত হতে শুরু করে, যুদ্ধের পরবর্তীকালীন মানসিক স্বাস্থ্য এবং মানসিক রোগের বহিঃপ্রকাশে বিভিন্ন ধরণের পরিবর্তন আস্তে শুরু করে। PTSD (Post Traumatic Stress Disorder) ফোবিয়া (Phobia) আরও বিভিন্ন সমস্যা এই সময় বৃদ্ধি পায়।
তাই মনোবিজ্ঞান ১৯৫০ এর পর থেকেই তার অনেকটা বেশি মানুষের সমস্যা খুঁজতে এবং কীভাবে তাদের প্রতিকার করা যায় সেই দিকে বেশি ঝুঁকে গিয়েছিল। ক্লিনিকাল সাইকোলজির প্রভাব অনেক বেশি বৃদ্ধি লাভ করে। শুধুমাত্র রোগ সারানো এই ভূমিকাটি প্রধান হয়ে ওঠে!
পজিটিভ সাইকোলজির যাত্রা ঠিক এখান থেকেই, যা প্রস্তাবনা দেয় এই ভারসাম্যহীনতা সংশোধনের, মারটিন সেলিগম্যান (Martin Seilgman) যার অন্যতম পথিকৃৎ। ১৯৯৮ সালে এবং তাঁর সঙ্গীরা পজিটিভ সাইকোলজি নিয়ে সুস্পষ্টভাবে ভাবে বলতে শুরু করেন। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি কোনও না কোনও ভালো কাজ বা বৈশিষ্ট্য মানুষকে বড় করে তোলে।
নিজের যা খারাপ আছে, তা আছে তাকে নিয়ে বেশি না ভেবে, কম গুরুত্ব দিয়ে নিজের যা ভাল তাকে আরও শক্তিশালী করে তোলা, দুর্বলতা কমানোর বদলে চেয়ে নিজের গুণগুলো নিয়ে আরও সুন্দর হয়ে ওঠাই শ্রেয়। শুধুমাত্র খারাপ জিনিস বাদ দেওয়াই নয় একজন মানুষের সার্বিক ভাবে ভালো রাখা যায় তার চেষ্টাই হচ্ছে পজিটিভ সাইকোলজির কাজ! মানুষকে তার সঠিক অবস্থান, সঠিক সময় ও পরিচর্যা দিলে সে আরও সুন্দর হয়ে উঠবে।
সেলিগম্যান বললেন আমাদের সবার কিছু স্পেশাল বৈশিষ্ট্য বা শক্তি আছে যাকে উনি বললেন সিগনেচার স্ট্রেনথ (Signature Strength) যেমন মানবিক, সংবেদশীল হওয়া। ইতিবাচক মানসিক স্বাস্থ্য এবং ভালো থাকা বলতে মানুষের নিজস্ব স্বাধীনতা ও চারিত্রিক দৃঢ়তা, নিজের আশেপাশের পরিবেশকে গুছিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা, নিজেকে সৎ ভাবে গ্রহণ করা, ক্রমাগত সৃষ্টিশীল এবং নিজের কাজের মধ্যে থাকা একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এই ইতিবাচক দিকগুলো জীবনে বিকশিত করাই পজিটিভ সাইকোলজির অন্যতম প্রস্তাবনা । আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পজিটিভ সাইকোলজির তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে-
আনন্দময় জীবন (Pleasant Life) – অনেক বেশি পরিমাণে অতীত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমানের মধ্যে ইতিবাচক অনুভূতি খুঁজে বের করা, নতুন নতুন জিনিসে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা যা আপনার ভালো অনুভুতিকে আরও বেশিক্ষন স্থায়ী করবে। জীবনে ছোট ছোট অভিজ্ঞতায় সুখ বা খুশি থাকা নিজেকে পরিতৃপ্তি, ও পরিপূর্ণতার মধ্যে রাখা।
বিভিন্ন বিষয়ে যুক্ত থাকা (Engagement)- যত বেশি সম্ভব কাজের মধ্যে নিজেকে জুড়ে দেওয়া, বিভিন্ন ধরনের ভালো লাগার কাজের মধ্যে নিজেকে নতুন ভাবে খুঁজে পাওয়া। নিজের ক্ষমতা ও দক্ষতাকে ছাপিয়ে যাওয়ার প্রবণতা। এই ভালোলাগার ব্যস্ততা সাধারণ একঘেয়েমি এবং দূর করে আপনাকে একটা প্রবাহ বা গতির মধ্যে রাখবে।
অর্থবহ জীবন (Meaningful Life) – এটি হল শেষতম ধাপ। অন্তরের প্রকৃত সুখ। পজিটিভ সাইকোলজির আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল সুখী হয়ে ওঠা! খুশিতে থাকা আর প্রকৃত সুখী মানুষ হয়ে ওঠা আলাদা জিনিস। পারস্পরিক ব্যক্তিগত সম্পর্কে -বন্ধুত্ব, সহযোগিতার সম্পর্ক, সম্পর্কের প্রতি কৃতজ্ঞতা, রোজ অল্প করে হলেও পাশের মানুষের সাহায্য করা, একসাথে থাকা একটা জরুরি পদক্ষেপ। ইতিবাচক প্রতিষ্ঠান (পরিবার, স্কুল, ব্যবসা, সম্প্রদায়, এবং সমাজ) কর্মক্ষেত্রে বা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সক্রিয়ভাবে কার্যকলাপ খোঁজা, শৈল্পিক, বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক বা ধর্মীয় চিন্তাভাবনা, সামাজিক বা পরিবেশগত সক্রিয়াতা অনেক প্রভাবশালী হয়ে ওঠে জীবনে। এই ছোট কাজের কাজের মাধ্যমেই ‘জীবনে কিছু অর্জন করেছি’ এই বোধ তৈরি হয় আমরা আমাদের ‘সিগনেচার স্ট্রেনথ’ খুঁজে পাই। সৃষ্টিশীল কোনও পন্থা উদ্ভাবন করা বা অনুসরণ করে প্রথাগত ধ্যান-ধারণাকে প্রশ্ন করার মাধ্যমেও জীবনের অর্থ ও উদ্দেশ্য অনেকসময় পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
দিনের শেষে সমস্ত মানুষ সুখী এবং পরিপূর্ণ এক জীবনযাপন করতে চায়। এটি প্রতিটি মানুষের মৌলিক ইচ্ছা এবং অধিকার। সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হল এরকম অনেক পরিস্থিতিই রয়েছে যা আমরা নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি নিজেদের কাজের মাধ্যমে, যদি আমরা ইচ্ছুক হই এইসব বৈশিষ্ট্য বা গুণ আরও শক্তিশালী করতে (এবং মনে রাখতে সচেতন কোনও প্রয়াস ছাড়া এই পরিবর্তন আসবে না) পজিটিভ সাইকোলজি এখানেই মূল্যবান হয়ে ওঠে জীবন ও মনস্তাত্ত্বিক স্বাস্থ্যের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে। পজিটিভ সাইকোলজি রোগ-অসুখ উপসর্গের বাইরেও মানুষকে নিজের জায়গায় দাঁড়তে সাহায্য করে এবং আশা দেখায় যে একটি সুস্থ, পরিপূর্ণ, এবং উত্পাদনশীল জীবন সবার পক্ষেই সম্ভব।