দু’বছর পর এবার দোলে দ্বিগুণ আনন্দ করতে গিয়ে দ্বিগুণ বিপদ ডেকে না আনাই ভাল।
দখিন দুয়ার খোলা।
অতিমারীর অভিশপ্ত দিনগুলো পেরিয়ে ফের রঙের উৎসব। স্থলে জলে বনতলে সবাই উৎসুক হয়ে আছে গত দু’বছরের ধূসর বিষন্নতাকে মুছে ফেলে রঙে রঙে রাঙিয়ে তুলতে এ ঘরদুয়ার, ও বিশ্বচরাচর।
কিন্তু অতিরিক্ত উৎসাহে রঙের উৎসবে মেতে গিয়ে আমরা যেন কোনো বিপদে না পড়ি।
আজকাল একটা জিনিসের খুব হুজুগ চোখে পড়ে।
একটা শব্দ।
হার্বাল বা ভেষজ।
আমাদের অনেক রোগী/রোগিনী নিশ্চিন্তে ব্যবহার করে চলেন বাজারচলতি, বহুবিজ্ঞাপনের ঢক্কানিনাদিত, তথাকথিত হার্বাল শ্যাম্পু/ক্রিম/সানস্ক্রিন/ময়েশ্চারাইজার, তেল ইত্যাদি। তাদের কোনো কোনোটিতে আবার গৈরিক বসনধারী, মিডিয়া সমর্থিত কোনো বিশেষ কর্পোরেট বাবাজির শ্মশ্রুগুম্ফমন্ডিত, চোখ ছোট করে, দুষ্টুমিভরা হাসিমুখের ছবি, যেন ছবি ও সই মিলিয়ে নেওয়া দুলালের তাল মিছরি!
সেই ব্যাপারটাই সুনামির মত আছড়ে পড়ে এই দোলের আগে। অত্যুৎসাহী ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতে শহরের বাজার ছেয়ে যায় এমনই ‘ভেষজ আবিরে’। ক্রেতাদের আশ্বস্ত করতে রঙের বহু প্যাকেটে লেখাও থাকে ‘১০০ শতাংশ ভেষজ’।
কিন্তু ওই সব কি সত্যিই ভেষজ?
কোন পদ্ধতিতে তৈরি করা হলে বা ঠিক কোন ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার না-করলে আবির ও রংকে ‘ভেষজ’ বলে গণ্য করা হবে, সেই বিষয়ে স্বীকৃতি বা শংসাপত্র দেওয়ার কোনও ব্যবস্থা রাজ্যে কি আদৌ আছে?
বিজ্ঞাপনের চটকের আড়ালে বহু রাসায়নিক রংকেও ভেষজ বলে বিক্রি করে দিচ্ছেন না তো কোনো কোনো অসাধু ব্যবসায়ী? ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের সদ্যপ্রয়াত মন্ত্রীমশাই বছর কয়েক আগে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, মনে পড়ে। কিন্তু তার ফল কি হয়েছিল, তা জানা নেই।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ প্রায় বছর কুড়ি বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে ভেষজ রং তৈরি করেছিলেন।
দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এই ব্যাপারটা নিয়ে ওয়াকিবহাল অবশ্যই। তাঁরা এটাও জানেন দেশে যত মানুষ দোল খেলেন, সেই অনুপাতে ভেষজ আবির ও রং তৈরির পরিকাঠামো নেই।
রং থেকে কেন ক্ষতি হয়?
লাল্ রঙে থাকে রেড অক্সাইড, কঙ্গো রেড, ক্রোসিন স্কারলেট, বা রোজামিন।
হলুদ রঙে থাকে মেটানিল ইয়েলো, লেড ক্রোমেট।
সবুজে থাকতে পারে ম্যালাকাইট গ্রিন।
বাঁদুরে মেটালিক রঙ মারাত্মক। এতে থাকে নানারকম ধাতুচুর্ণ। এর থেকে কিডনি বা লিভারের অসুখ এমনকি ক্যানসারের সম্ভাবনাও থাকে।
আবির কিংবা রঙের গুঁড়ো সহজেই শ্বাসনালীতে ঢুকে সমস্যা তৈরি করে।
সীসা ও ক্যাডমিয়ামের মতো রাসায়নিক আবিরও রঙে ব্যবহার কখনোই করা উচিত নয়।
রং বা গ্লিটারে যে রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়, চোখ তার সংস্পর্শে এলে অ্যালার্জিক কনজাংটিভাইটিস থেকে কর্নিয়ার ক্ষতি পর্যন্ত হতে পারে।’
তেল রং, বাঁদুরে আর মেটালিক রং না হয় এড়িয়ে যাওয়া গেল, কিন্তু আবির থেকেও তো বিপদ হতে পারে!
তাহলে উপায়?
আসুন, বাড়িতেই বানিয়ে ফেলুন প্রাকৃতিক রং, আর রং খেলার বন্ধুদের এই রং ব্যবহার করতে উৎসাহিত করুন :
১। আবিরের বেস তৈরী করুন ট্যালকম পাউডার, আটা, ময়দা, বেসন বা এরারুট দিয়ে। এবার
এক কাপ বেসে এক চামচ হলুদ গুঁড়ো মেশালেই হয়ে যাবে হলুদ আবির।
এক চামচ হেনা পাউডার মেশালে পাওয়া যাবে সবুজ আবির।
রক্তচন্দন গুঁড়ো মেশালে লাল আবির তৈরী।
২। বিভিন্ন ফুলের পাপড়ি শুকিয়ে গুঁড়ো করেও আবির বানানো যায়।
গাঁদা, অমলতাস, চন্দ্রমল্লিকা আনবে হলুদ রং,
শিমুল বা পলাশ দেবে গেরুয়া,
লাল জবা বা মাদার ফুলের পাপড়ি থেকে লাল রং,
নীল জবা, জ্যাকারান্ডা বা অপরাজিতা ফুলের পাপড়ি থেকে নীল রং।
৩। সুগন্ধী আবির চাই, সে ব্যবস্থাও হয়ে যাবে?
বেশ হিসেবে সেই ট্যালকম পাউডার ব্যবহার করা যেতে পারে আর সুগন্ধে এলার্জি না থাকলে পছন্দের সুগন্ধী একটু মিশিয়ে নেয়া যায়।
৪। জল রং চাই? সে ব্যবস্থাও হয়ে যাবে।
আমলা সারা রাত জলে ভিজিয়ে রাখুন কালো রং পাবেন।
বিট কেটে ভিজিয়ে রাখলে ম্যাজেন্টা রং।
টোম্যাটো বা গাজর সেদ্ধ করে জলে মেশালে তৈরী হবে লাল রং।
পুদিনা, পালং শাক , ধনেপাতানমিহি করে বেটে জলে মেশালে পাওয়া যায় সবুজ রং।
পলাশ বা শিমুল ফুল জলে ফুটিয়ে বা গিরিমাটি জলে গুলে তৈরী করা যাযা গেরুয়া রং।
জ্যাকারান্ডা, নীল জবা বা নীল অপরাজিতা জলে ফুটিয়ে নিলে পাওয়া যায় নীল রং।
৫। তেল রং? বাড়িতে? হলুদগুঁড়ো, রক্তচন্দন বা হেনা পাউডার বা ভুষো কালি তেলে গুলে তৈরী করে দেখতে পারেন। চমকে দেয়া যাবে বন্ধুদের।
রং খেলার আগে, পরে :
দুধের শিশুদের নিয়ে রং খেলা উচিত নয়, তাদের কোমল ত্বকে, চোখে রঙের প্রভাব ভয়ঙ্কর হতে পারে।
বাজার চলতি দোলের রঙে থাকে নানা রকমের রাসায়নিক। তার কোনটায় কার এলার্জি বলা মুশকিল। যদি তীব্র অম্ল বা ক্ষার জাতীয রাসায়নিক থাকে তাহলে সাথে সাথে বোঝা যাবে। একে বলে ইরিট্যান্ট কন্টাক্ট ডার্মাটাইটিস। আবার কারো যদি রঙের কোনো উপাদান থেকে এলার্জি থাকে যেমন পারফিউম বা সুগন্ধি থেকে বা রং থেকে তাহলে হতে পারে এলার্জিক কন্টাক্ট ডার্মাটাইটিস। এটা যে সবার হবেই তার কোনো মানে নেই। যার যে উপাদানে এলার্জি রঙে যদি সেই উপাদানটি থাকে তাহলে হবে।
কন্টাক্ট টাইমটাও জরুরি।যেমন আপাত নিরীহ রং চামড়ায় অনেকক্ষণ লেগে থেকে বিপদ ডেকে আনতে পারে। জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন চট করে।
খুব বেশি ঘষাঘষি নয়। তাতেও ত্বকের ক্ষতি হতে পারে।
কড়া সাবান, স্পিরিট বা কেরোসিন দিয়ে রং তুলতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনবেন না।
একবারে রং না উঠলে ক্রিম বা লোশন লাগিয়ে রাখুন। দু-এক ঘন্টা পরে আবার ধুয়ে ফেলুন।
রং খেলার পর ব্রণ বের হবার প্রবণতা থাকলে, তেল রং এড়িয়ে চলাই উচিত।
মেয়েরা রং খেলার আগে মাথায় তেল মেখে নিলে আর নেল পালিশ লাগিয়ে নিলে চুল আর নখ কিছুটা রক্ষা পাবে।
রং খেলার পরে চুলে ভালো করে শ্যাম্পু দিতেই হবে। তবে গায়ে মাখার সাবান দিয়ে চুল ধোবেন না। কন্ডিশানার লাগান।
রং খেলার পর স্কিনে চুলকানি বা ফুস্কুড়ি বেরোলে রোদে বেরোবেন না। তেলবিহীন ক্যালামাইন লোশন লাগাতে পারেন, অ্যান্টি অ্যাল্যার্জিক ট্যাবলেট খেয়ে দেখতে পারেন। না কমলে চিকিৎসকের পরামর্শ তো আছেই।
সুন্দর। আমার মনের কথা লিখেছেন।