কাল অনেক দিন পর রুমিদির সাথে দেখা। হঠাৎই, মেট্রো স্টেশনে। আমি শোভাবাজার থেকে, আর রুমিদি উঠলো রবীন্দ্রসদন থেকে। প্রথমে রুমিদিকে দেখে কয়েকবার ভাবলাম এটা রুমিদিই তো, তারপর চোখে চোখ পড়ায় রুমিদি নিজেই এগিয়ে এলো। চেহারা আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে, চোখের তলার কালি কমেছে, প্রাণ খোলা একটা হাসি, সব মিলিয়ে একটা ফ্রেশনেস। আমার হাত দুটো চেপে ধরে বললো কেমন আছিস? তোর ফোন নম্বরটা হারিয়ে ফেলেছি। আর তুই তো জানিস, ফেসবুকে আমি নেই। তোর খোঁজ করেছিলাম নেহার কাছে, কিন্তু ও বলেছিল তুই বাইরে গেছিস, তাই আর চেষ্টা করিনি। বল্, কেমন আছিস।
আমি বললাম, ভালো আছি। অফিস থেকে আবার ট্রেনিং এ পাঠিয়ে ছিলো, এখন ব্যাক টু কলকাতা। তুমি কেমন আছো?
একগাল হেসে বললো, ভালো আছি রে, আগের চেয়ে অনেক ভালো। আর আমার ভালো থাকার জন্য তোর হেল্প অনেকটা, ভাগ্যিস তুই আমায় তারিখের মারপ্যাঁচের সন্দেহটা মনে ঢুকিয়েছিলি। তাই জন্যই না আমি ক্যালেন্ডারে দাগ দিতে শুরু করলাম, তারপরেই না ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। নাহলে তো ওইভাবেই চলতো! এখন আমি, বা বলতে পারিস আমরা ভালো আছি, জানিস। আর সমস্যাটা বুঝতে পারায়, আন্ডারস্ট্যান্ডিং অ্যাডজাস্টমেন্ট এগুলোর সাথে সাথে কেরিংনেসটাও বেড়েছে। থ্যাঙ্ক ইউ রে। এই বলতে বলতে টালিগঞ্জ এসে গেলো। রুমিদির নামার সময়ে। ফোন নম্বর দেওয়া নেওয়া করে কথা হবে এই বলে রুমিদি নেমে গেল। গেটের দিকে যেতে যেতে সেই একই ভাবে হাত নেড়ে বাই করলো। অনেক দিন পর রুমিদিকে আবার সেভাবে হাসতে দেখলাম।
রুমিদি আর আমি অফিস পাড়ার বন্ধু, একসাথে যাওয়া আসা রেস্তোরাঁ উইন্ডো শপিং সবই হতো। বেশ মিষ্টি মিসুখে একটি মেয়ে, সবেতেই বেশ উৎসাহ, অফিসেও বেশ নামডাক। কিন্তু মাঝে মাঝে কিরকম ঝিমিয়ে পড়তো, অল্পেতে বিরক্ত হয়ে যেতো আবার কখনো কখনো সাধারণ কথায় এমন মন খারাপ করতো যে মনে হতো ফুলের ঘায়ে মূর্চ্ছা যায়। আবার কয়েকদিন পরে আগের মতন হয়ে যায়। আমরা মজাও করতাম এইরে, রুমিদি খেপেছে আবার। একদিন এরকমই আমরা পেছনে লাগছি, ওমা, দেখি রুমিদি কাঁদছে। সকলে চুপ করে গিয়ে জানতে চাইলাম কি হয়েছে। প্রথমে অনেকক্ষণ কাঁদল তারপর বললো বাড়িতে সমস্যা হচ্ছে। সবাই বলছে “ও সবেতেই ওভার রিয়্যাক্ট করে”। এই বলে আবার কাঁদতে শুরু করল। কয়েকটা ঘটনাও বললো, শুনে আমারও একটু বাড়াবাড়ি মনে হলো। কিন্তু সেই মুহূর্তে কি আর বলি দু চারটে পরামর্শ দিলাম। তারপর একসাথে বাড়ি ফিরলাম। তার কয়েকদিন পর আবার সব আগের মতন। রুমিদি হাসছে মজা করছে। কিন্তু আবার কয়েকদিন পরে সেই একই ঘটনা।
আগের বারের তারিখটা আমার মনে ছিল, এবার দেখলাম তার কাছাকাছি সময়ে সমস্যাটা হচ্ছে। মনে মনে ভাবলাম ইন্টারমিটেন্ট সাইক্লিক মুড সুইংগস তো প্রি মেনস্ট্রুয়াল ডিসফোরিয়ার একটা সিম্পটম। কিন্তু সরাসরি বলতেও পারছি না। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে প্রশ্ন করে বুঝলাম শুধু মুড সুইংগ নয়, লিথার্জি, ব্লোটিং, ব্যাক পেনের মতন আরও কিছু সমস্যা আছে। পরের মাসে আবার যখন দেখলাম সময় আসতেই কিরকম মুখ চোখ শুকিয়ে গেছে, ক্লান্ত চুপচাপ হয়েগেছে, মেজাজটাও অন্যরকম, তখন আমি বলেই ফেললাম। প্রথমে শুনছিলো না। তারপর বললাম তুমি এই মাসে কবে থেকে সমস্যা হচ্ছে ক্যালেন্ডারে দাগ দাও, পরের মাসেরটা দেখো। যদি না মেলে তো ঠিক আছে তবে একবার কথাটা শুনে তো দেখো, কোনো ক্ষতি তো নেই। রুমিদি আমাকে খুব স্নেহ করতো, খুব কথাও শুনতো আমার। তাই তর্ক না করে বললো আচ্ছা। তবে খুব একটা কনভিন্সড হয় নি যে বুঝলাম। আমি আর কথা বাড়ালাম না, বললাম চলো যাওয়ার যাক।
কয়েকদিন পরে আমার ট্রেনিং এ বাইরে যাওয়া ছিলো। ট্রেনিং এ থাকতে থাকতে পরের মাসে ফোন, রুমিদি বললো “শোন, তুই ঠিক বলেছিস মনে হচ্ছে। তারিখের একটা লিংক আছে”। তখন আমি পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম যে মেনস্ট্রুয়াল সাইকেলে হরমোনের সাথে সাথে ব্রেনের ডোপামিন আর সেরোটোনিনের লেভেল চেঞ্জ হয়। এর ফলে অনেকেরই মুড সুইংগসের সমস্যা হয়। অনেককেই এটা জানেন না, তাই সমস্যা হলেও সাইকেলের সাথে রিলেট করতে পারেন না। জানা থাকলে নিজের একটা মেন্টাল প্রিপ্রারেশন তৈরি হয়, নিজের ইমোশনাল সার্জ রেগুলেট করা একটু হলেও সহজ হয়। তুমি তো এখন সচেতন হলে, দেখো তুমি হয়তো নিজেই এই ক্রাইসিস থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।
“রোজ ঘাম ঝড়ানো এক্সারসাইজ করো, রাতে ভালো করে ঘুমাও, খাওয়ায় একটু কন্ট্রোল করে, খুব সল্টি বা খুব সুইট খাবার কিছু খেওনা। বিনজ ইটিং এর টেন্ডেন্সি হলে স্যালাড বা লো ক্যালোরি ফুড খাওয়ার চেষ্টা করো। আর বাড়ির লোককে জানাও, যাতে তারা তোমাকে এই সময়ে সাপোর্টটা দিতে পারে এবং তোমায় ভুল না বোঝে। এসব করেও যদি মনে হয় অসুবিধে থেকে যাচ্ছে, একজন ডাক্তারের সাথে কনসাল্ট করো”-এই এক ঝুড়ি পরামর্শ দিয়ে ফোন রাখলাম। তারপর প্রায় মাস তিনেক শুধু টুকটাক মেসেজ। আমি ট্রেনিং থেকে ফিরে অন্য ডিপারটমেন্ট জয়েন করেছি। ফলে দেখাও হয়নি। আজ দেখা হয়ে ভালো লাগলো। মুখের হাসি বলে দিচ্ছে সমস্যা একটু হলেও কমেছে। আসলে নিজের কাছে নিজের আচরণ যদি অজানা হয়, তাহলে অসহায় বোধ বেড়ে যায়। যে কথায় এমনি সময় বড়জোর একটু মন খারাপ হয়, সেই কথায় যদি হঠাৎ প্রচন্ড কষ্ট পাই, কিংবা প্রচন্ড রেগে যাই, নিজের কাছেই তো কিরকম অদ্ভুত লাগে। তার মধ্যে বাড়ির অশান্তি, ওয়ার্ক স্ট্রেস, সব মিলিয়ে সমস্যা বাড়তেই থাকে।
আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। আজকের যুগে নারী পুরুষের ডিসক্রিমিনেশনটা থাকা উচিত নয়। কিন্তু ফিজিওলজিকালি দুটো সত্ত্বা আলাদা, ফলে কিছু স্পেশাল অ্যাকনলেজমেন্টের প্রয়োজন সবার। সমীক্ষা বলে মহিলাদের মধ্যে অ্যাংজাইটি, মুড ডিসঅর্ডারের প্রবণতা বেশি। ফলে ফিজিওলজিকালি যার যেরকম কেয়ারের প্রয়োজন তাকে সেটা দিতে হবে। প্রকৃতির কাছে তো এগিয়ে পিছিয়ে থাকার কোন লড়াই নেই। তাই চলুন না, আজকের এই প্রযুক্তি বিঞ্জানের যুগে, প্রিমেনস্ট্রুয়াল ডিসফোরিয়া নিয়ে একটু সচেতন হই।