আজকের দিনের মত ফেবু-হোয়ার পৃথিবীতেও একজন মানুষের জীবন কতখানি ব্যক্তিগত হতে পারে তার নিজের কাছে সাগরিকাদিকে দেখে আমি বুঝেছি। শিখিনি কারণ আমি চরিত্রগতভাবে সম্পূর্ণ তার বিপরীত। যেসময় দিদির ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়ল আমাদের ডিপার্টমেন্টে হেড ছাড়া কেউ জানতেন না। তাকেও বলা ছিল তিনি যেন ঘুণাক্ষরেও কাউকে কিছু না জানান। এদিকে আমাদের দিদির ক্লাসগুলো নিতে হচ্ছে। দিদি কাউকে না জানিয়ে অনেকদিন আসছে না। হেডকে কিছু বলতে গেলে উনি চুপ করে আছেন। আমরা অনেকেই দিদির ওপর বিরক্ত। পরে দিদি অপারেশন করিয়ে ফিরে আসার পরে যখন জানতে পারলাম তখন সবাই হতবাক।
নিজের সমস্যা ও বিপদ নিয়ে সবসময় একা লড়াই চালিয়ে গেছে। খুব খুব ঘনিষ্ঠ ছাড়া কাউকে পাশে চায় নি কোনোদিন। ব্যক্তিত্বের এমন একটা পরাকাষ্ঠা ছিল যে চারপাশে একটা সহজ বিকর্ষণ ছিল। কারোর জন্যই সহজ ছিল না, নিজেও সহজ হয়ে উঠত না কারো কাছে। যে কাজটা একটা ছেলে করতে পারে সেটা আমিও একাই পারি। পুরুষদের প্রতি যে প্রবল বিদ্বেষ ছিল এমনটা নয় তবে পুরুষদের স্বাভাবিক অগভীরতা ও সুবিধাবাদিতার প্রতি অবজ্ঞা ছিল প্রবল।
আমার সাথে ছিল দিদি ভাইয়ের সম্পর্ক। কলেজে আমার এক ব্যাচ সিনিওর। সাত বছর একসাথে কাজ করেছি ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের ফিজিওলজি ডিপার্টমেন্টে। প্রতিদিন একবার দিদির ঘরের পাশের চেয়ারে বসে আড্ডা দেবোই। বা দিদি আসবে আমার ঘরে। আমাদের অল্প বয়সের কলেজ, আমাদের অল্প বয়স, আমাদের হারিয়ে যাওয়া সময়, আমাদের ফেলে আসা সময়ের ইতিবৃত্তগুলো রিং হয়ে ঘুরে বেড়াতো আমাদের মাথার ওপর।
আমি কলেজতুতো ভাই বলে আমাকে বাঁচিয়ে রাখার একটা প্রবণতা ছিল। দিদি যেহেতু ঠোঁটকাটা। ঠিক কথাটা ঠিক বা বেঠিক জায়গায় বলতে এক মুহূর্ত ভাবে না, তাই অনেকেরই ভীষণ অপছন্দের মানুষ। অনেক অভিযোগের মানুষ। তাই অনেকে তার সম্পর্কে অনেক কিছু বলতে চাইলেও আমাকে সহজে বলতে পারত না। কারণ বুঝত আমার জবাব তার মনোমত নাও হতে পারে।
এভাবেই আমরা সাত বছরে সহকর্মী হিসেবে বন্ধু হিসেবে দুজনের অনেক কাছে চলে এসেছিলাম। সাত বছর আগে আমরা দিদিদের সাথে অরুণাচলে বেড়াতে গিয়েছিলাম। দিদি, দিদির দাদা আর মা গেছিলেন। তারপর কতবার একসাথে যাবার কথা হয়েছে। আর হয় নি। নিজে শেষ কয়েক বছর কাকিমাকে নিয়ে ইউরোপ, শ্রীলঙ্কা ঘুরে এসেছিল। কিছু বললেই বলত, আমি আর কতদিন আছি বল? কদিনে একটু ঘুরে নিই। মাকে ঘুরিয়ে আনি।
সপ্তাহে ছ-দিন ছয়রকম সালোয়ার বা শাড়ি পরে আসত। যদিও শাড়িতেই দিদিকে আমার সবচেয়ে বেশি সুন্দরী লাগত। প্রসাধনী খুব কমই করত। কিন্তু সৌন্দর্যের মধ্যে একটা স্বাভাবিকতা ছিল যা সহজেই আমাদের চোখ টানত। নিজে বলত আরেকজন ম্যাডামের থেকে ও শিখেছে কিভাবে কলেজে এলে পোশাক-আশাক পরতে হয়।
অপারেশন করেছিলেন কলকাতার এক নামজাদা সার্জেন। তাই কেমোথেরাপি শেষ হবার পর দিদি খুব আশাবাদী হয়ে উঠেছিল, অনেককে বলেছিল, আর হয়ত ভয় নেই। এর মধ্যেই আমার মালদায় ট্রান্সফার হয়ে গেল। পরে জানতে পারলাম ফুসফুসে অল্পস্বল্প মেটাস্টেসিস ধরা পড়েছে। তার মধ্যেই এল কোভিড। এর মধ্যেই চলল বারবার পরীক্ষানিরীক্ষা আর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া।
কারোর কাছে কোনো সাহায্যের আবেদন নেই। নিজের চরম কষ্টের দিনেও প্রায় একা-একা লড়াই করে গেছে। এরই মধ্যে জন্মদিনে হোয়াতে উইশ করেছে। পেপার পাবলিশ করার জন্য ফোন করেছে। আর কথায় কথায় উঠে এসেছে আবার ঘুরতে যাবার কথা। ট্রেকিং করার ছবি দেখে বলেছে, আমি তো আর যেতে পারব না। তোর ছবি আর লেখার সাথেই ঘুরে এলাম।
খুব ঘনিষ্ঠ এক সহকর্মী ‘সিঙ্গল মাদার’ হবার পর থেকেই বারবার বলত, জানিস তো ওর মেয়ে হয়েছে শুনে আমার এত আনন্দ হচ্ছে যেন মনে হচ্ছে বারবার ও আমারই মেয়ে। শেষ কয়েক বছর চেষ্টাও করেছিল একটা বাচ্চা অ্যাডপ্ট করার জন্য। এখন মনে হয় ভাগ্যিস করে নি!
প্রেমের কাছে প্রতিহত প্রতারিত হয়েছে। নিজের বৃত্তকে ক্রমাগত ছোট করে নিয়েছে। এক চরম নির্জন, বিষণ্ণ জীবন- যাকে শেষে ক্যান্সার এসে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়ে গেছে। কেউ কেউ জীবনে কেন এত কষ্ট পায়, আমাদের মত কেউ কেন হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াই- এই প্রশ্নের সত্যিই কোনো উত্তর হয় না। ঈশ্বর থাকুন না থাকুন মৃত্যু পরবর্তী একটা জায়গা নিশ্চই আছে। সে জায়গাটা নিশ্চই এই পৃথিবীর মত এতটা খারাপ নয়। সেখানে মানুষ তার পছন্দের জায়গায় ফিরে যায়। এটা ভেবে মনে আনন্দ পাই। সাগরিকাদিও আমার মত পাহাড় ভালো বাসত। আজ হয়ত সেখানেই কোথাও আছে।
মৃত্যু এক অর্থে মুক্তিও। পার্থিব শারীরিক ও মানসিক তীব্র যন্ত্রণা থেকে। যারা শেষ সময়ে ওকে দেখেছিল। তারা এমনটাই বলছিল। তবে এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া? এটা কিভাবে মেনে নিই? সামনেই প্রফেসর হবার ইন্টারভিউ ছিল। ছাত্র-ছাত্রীরাও তাদের প্রিয় একজন শিক্ষিকাকে হারাল। বয়স্ক কাকিমার রোগজীর্ণ শরীরে এত বড় মানসিক চাপ। কিভাবে কাটাবেন বাকি জীবন?
সবসময় বলত তুই ক্যামেরায় আমার একটা ছবি তুলে দিস। সে আর হলো না। চোখ বন্ধ করলেই এত স্মৃতি! সাগরিকাদি কলেজ করিডোরের পাশ ধরে বুকে বইখাতা চেপে মাথা নিচু করে ভাস্বতীদির পাশে হেঁটে লেকচার ক্লাসে ঢুকছে। আমরা তখন ফাস্ট ইয়ার। আর গত নয় বছরের স্মৃতি তো অগণিত। তবে এই শুরু হয়ে গেল। সাগরিকাদিই শুরু করে দিয়ে গেল। নিজের সমবয়েসিদের হারাবার অভিজ্ঞতা বয়ে বেড়ানো।
অসম্ভব রুচিশীল, সংবেদী, বাস্তববাদী ও প্রচন্ড মানসিক জোরের অধিকারী এক মানুষ। এক শিশুর মত তীব্র মানসিক আবেগ ও স্পষ্টবাদিতা। আমার জীবনে এমন মানুষ ও মহিলা আমি তেমন কাউকে দেখি নি। স্মৃতি এখনো দুর্ভার হয়ে আছে। ধীরে ধীরে তা মিলিয়েও যাবে। তেমনই যায়। সবই যায়। তবু কেন জানি মনে হয় কোথাও একদিন ঠিক আবার আমাদের দেখা হবে।