চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নতি হোক বা যুগান্তকারী আবিষ্কার– এশিয়ার প্রাচীনতম চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মেডিক্যাল কলেজ কলকাতা, সবদিক থেকেই সবসময় প্রথম সারিতে থেকে এসেছে। এর প্রাক্তনীরা দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে আছেন।
কোভিড-১৯ অতিমারীর মোকাবিলার প্রস্তুতিপর্বে মে, ২০২০ থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই টার্শিয়ারি স্তরের হাসপাতালকে ‘কোভিড এক্সক্লুসিভ হাসপাতাল’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। এই ঘোষণার ফলে কিছু ঘটনা ঘটেছে, যেগুলো জনসাধারণের স্বার্থে তুলে ধরা দরকারঃ
- দৈনন্দিন আউটডোর পরিষেবা, স্পেশালিটি ক্লিনিক, কেমোথেরাপি, ডে কেয়ার সার্ভিস, অপারেশন, ডায়ালিসিস ইউনিট, ব্লাড ব্যাঙ্ক পরিষেবা, ফার্মাসি, সিটি, ইউএসজি, ব্রঙ্কোস্কোপি ও অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা গুলি এবং রোগী ভর্তির ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হয়, করোনা-সাসপেক্ট এবং করোনা-পজিটিভ রোগীদের ভর্তি করার জন্য।
- কলেজের বিভিন্ন স্পেশালিটি/সুপারস্পেশালিটির রেসিডেন্টরা কর্তব্যের ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসেন এবং যাবতীয় লোকবল ও পরিকাঠামোর পুনর্বিন্যাসের মতো বৃহদাকার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিয়ে উপযুক্ত চিকিৎসা পরিচালনা ব্যবস্থা গড়ে তোলেন, কলেজ কর্তৃপক্ষকে পূর্ণ সহযোগিতার মধ্যে দিয়ে, যার মাধ্যমে কোভিড রোগী ভর্তি এবং তাঁদের চিকিৎসার দায়িত্বে তাঁরা নিজেদের সঁপে দিতে পারেন।
- বর্তমানে এই হাসপাতালে কোভিড রোগীদের চিকিৎসার জন্য ৫০০টি শয্যা অনুমোদিত হয়েছে, এবং নির্দিষ্ট বিল্ডিংগুলিতে ২৪ ঘন্টাই রেসিডেন্ট-ইন্টার্ন-প্রফেসরদের ডিউটি থাকছে— ভবিষ্যতে অনুমোদিত শয্যা সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
কিন্তু এর ফলে, আমাদের সবচেয়ে ক্রূর আশঙ্কা সত্যে পরিণত হয়েছে। প্রতিনিয়ত দেখা যাচ্ছে, এই টার্শিয়ারি হাসপাতালের দৈনন্দিন পরিষেবা বন্ধ হয়ে যাবার জন্য সেইসব রোগীরা যথেষ্ট অসুবিধায় পড়েছেন, যাঁরা পরীক্ষানিরীক্ষা এবং চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। ডাক্তার এবং রোগীর মধ্যেকার সম্পর্কগুলো ছিন্ন হয়েছে।
দৈনন্দিন অপারেশন, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, আউটডোর পরিষেবা, বিনামূল্যের এক্সরে/এমআরআই/ইউএসজি পরিষেবা, ব্লাড ব্যাঙ্ক ও প্যাথোলজি পরিষেবা, এমার্জেন্সি পরিষেবা, স্পেশালিস্টের দ্বারা চিকিৎসা, সবকিছুই প্রচণ্ডভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। কতগুলি উদাহরণ তুলে ধরা যাকঃ
- শ্রীমতী তিথি (নাম পরিবর্তিত) SLE এর রোগী, যিনি মেডিসিন ওপিডিতে নিয়মিত আসতেন এবং ‘ডে কেয়ার’ এর মাধ্যমে প্রতিমাসে ইঞ্জেকশন নিয়ে যেতেন, অতীতে ওষুধ বন্ধ করলেই তাঁর রোগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে প্রতিবার। বর্তমানে তাঁর সঙ্গে তাঁর মেডিসিনের ডাক্তারবাবুর কোনো যোগাযোগ নেই।
- শ্রী মনোজ (নাম পরিবর্তিত) ক্রনিক কিডনির রোগী, এবং মধুমেহ ও উচ্চ রক্তচাপও আছে — ফার্মাসি থেকে বিনামূল্যে পাওয়া ওষুধের ওপরই তিনি নির্ভরশীল ছিলেন। এই পরিষেবা বন্ধ হয়ে যাবার পর তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে।
- শ্রীমান সানি (নাম পরিবর্তিত) অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়ার রোগী, তার প্রায়ই বিশেষ ধরণের রক্ত চালানোর দরকার হয়, যেটা সে এখন পাচ্ছে না।
- মিসেস সরকার (নাম পরিবর্তিত) ব্রেস্ট ক্যান্সারের রোগী, তাঁর ম্যাস্টেকটমি অপারেশন হবার কথা ছিল যেটা এই পরিস্থিতিতে সম্ভব হয়ে ওঠেনি— শেষপর্যন্ত তাঁর অসহায় চিকিৎসকের কাছে তাঁর দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর খবর আসে।
হাজারে হাজারে রোগী যাঁরা রেডিওথেরাপি, প্রসূতি পরিষেবা, লিউকেমিয়া-লিম্ফোমার চিকিৎসা, বিশেষ ধরণের সার্জারি, হার্টের চিকিৎসা, এইডসের চিকিৎসা, টিবির ওষুধ, টীকা, চোখের অস্ত্রোপচারের জন্য মেডিক্যাল কলেজের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন, তাঁরা এখন অসহায়।
প্রত্যেকটি মেডিক্যাল কলেজই প্রাত্যহিকভাবে বিপুল সংখ্যক রোগীকে পরিষেবা দেয়। মেডিক্যাল কলেজকে যখন শুধুমাত্র কোভিড রোগীদের জন্য নিবেদিত একটি টার্শিয়ারি পরিষেবা কেন্দ্রে পরিণত করা হল, তখন এর নিয়মিত পেশেন্টদের ভার বাকি মেডিক্যাল কলেজগুলোর ওপর গিয়ে পড়ল, যারা আগে থেকেই রোগীদের ভারে জর্জরিত। এর ফলাফলস্বরূপ, রাজ্যে চলা এই লকডাউন পরিস্থিতির মধ্যে এই পেশেন্টদের ফলো আপ চিকিৎসা এবং পরিষেবা পেতে যথেষ্ট অসুবিধা ভোগ করতে হচ্ছে।
কিছু পেশেন্ট মেডিক্যাল কলেজে বেড পাবার জন্য হন্যে হয়ে ছুটে বেড়িয়েও কোভিড টেস্টের ভিত্তিতে বেড পেতেন না, এবং শেষমেষ ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন হয়রানির পর মৃতপ্রায় অবস্থায় মেডিক্যাল কলেজে আসতে বাধ্য হতেন।
কোভিড-১৯ একটা সমস্যা, কিন্তু মধুমেহ, উচ্চ রক্তচাপ, ক্রনিক কিডনির রোগ, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, ক্যান্সার, লিউকেমিয়া, জটিল প্রেগন্যান্সিও তাই — এবং এই সবগুলোর কারণেই এই হাসপাতালে মৃত্যুহার ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
জনসাধারণের কাছে এই খবর তুলে ধরা দুঃখজনক, কিন্তু কলেজের রেসিডেন্ট ডাক্তারদের ক্ষেত্রেও এই ঘটনা অনেকটাই মনোবল কমিয়ে দিয়েছে, যাঁরা এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বেশিরভাগটাই অসহায় থেকেছেন।
মেডিক্যাল কলেজ কলকাতা সবমিলিয়ে ১২০০ জন ডাক্তারি ছাত্র, ২৫০ জন ইন্টার্ন, ৫০ জন হাউসস্টাফ, ৬০০ পিজিটি, ৬০ জন পোস্ট ডক্টরাল ট্রেনির শিক্ষাক্ষেত্র। নন-কোভিড পরিষেবা স্তব্ধ করার মাধ্যমে একঝাঁক মেধাবী ডাক্তারি ছাত্রছাত্রীর যথাযথ প্রশিক্ষণ ব্যাহত হচ্ছে, যে প্রশিক্ষণ তাঁদের কোর্সে অতিপ্রয়োজনীয়, অতিমারী-পরবর্তী সমাজের বৃহত্তর স্বার্থেই। একদিকে দেশ যখন স্বাভাবিক অবস্থা ফেরানোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে তাঁরা তখন শুধুমাত্র কোভিড রোগীদের চিকিৎসাতেই আবদ্ধ থেকে বাকি সমস্ত রোগীদের চিকিৎসা না করতে পেরে এক পদক্ষেপ পিছিয়ে যাচ্ছেন। নিয়মিত নন-কোভিড রোগীদের ভর্তি পুনরায় শুরু না করার ফলে হাজার হাজার রোগীর ‘জীবনের অধিকার’ ব্যাহত হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের কাছে বারংবার করা আবেদন করলেও তা শোনা হয়নি–এমনটাই অভিযোগ। আরও অভিযোগ– নিয়মিত রোগীদের দুরবস্থা সম্পর্কে তাঁরা নির্বিকার থেকেছেন।
মেডিক্যাল কলেজ কলকাতার রেসিডেন্ট ও ইন্টার্নরা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানাচ্ছেন, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে কলেজ কর্তৃপক্ষের এই হাসপাতালকে ‘কোভিড এক্সক্লুসিভ হাসপাতাল’-এ পরিণত করে হাজার হাজার নন-কোভিড রোগীকে বিনামূল্যে সহজলভ্য চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করার অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের বদল ঘটানো হোক।
কোভিড-১৯ অতিমারীর চিকিৎসায় সামনে থেকে লড়াই করার সুযোগ পেয়ে তাঁরা গর্ববোধ করেন, এবং এই অতিমারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাঁরা সরকারের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, শেষপর্যন্তও তাই থাকবেন। কিন্তু তাঁরা চান অনুগ্রহ করে সরকার তাঁদের বক্তব্য শুনুন, কারণ তাঁরা রোগীদের অসুবিধা এবং দুর্দশার কথাই তুলে ধরছেন, যাঁরা স্বাস্থ্যের দিক দিয়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে একইরকম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
নিয়মিত আউটডোর-ইনডোর পরিষেবা, ল্যাবরেটরি, ইমেজিং পরিষেবা পুনরায় শুরু করার দিকে নেওয়া পদক্ষেপ, জনসাধারণের এই হাসপাতালের চিকিৎসা-পরিষেবা এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তনের ক্ষমতার ওপর বিশ্বাস বাড়িয়ে তোলা, এবং উন্নততর সমাজ গড়ে তোলায় অনেক সাহায্য করবে–এমনটাই মেডিক্যাল কলেজের রেসিডেন্ট ও ইন্টার্নদের বিশ্বাস।
আমি এইসব ব্যাপারে সহমত। আমি নিজে বিনে পয়সায় রুগী পরিষেবা দিতে গিয়ে এই সব অসুবিধা ও রোগীদের কষ্ট দেখছি, কিন্তু কিছুই করতে পারছিনা । তাই এর একটা সুষ্ঠ সমাধানের জন্য একটি বিশেষ বিবেচনায় অবশ্যই দরকার । ডাক্তার নিতাই ঘটক ।
জুনিয়র ডাক্তারদের প্রত্যেকটি প্রস্তাবনার সাথে আমি সহমত এবং অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে সমর্থন করছি ।