শরৎবাবু তখন সবে আসবো আসবো করছেন। দু একটা সাদা মেঘ মাঝে মাঝেই আকাশ আলো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাস্তার ধারে ধারে কাশফুলেরাও মুখ তুলে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। সেদিন আধবুড়ো হাতুড়ে একটা লম্বা ঝুলোচুল হাড় ডিগডিগে সদ্য যুবকের সঙ্গে বসে বিমলবাবুর দোকানে চা আর ডিম ভাজা খাচ্ছিলেন।
ছেলেটার মুখের সঙ্গে হাতুড়ের মুখের বেশ একটা মিল আছে। দেখলে মনে হবে কপি পেস্ট করা। ঘোড়ানিম গাছে তখন একটা কাঠঠোকরা ট্টি ট্টি ট্টি টুকড়ুম বলে প্রাণপণে চ্যাঁচাচ্ছে – পাশের খালে একটা গো বক তার লম্বা ঠ্যাং তুলে তুলে প্রাতরাশের জন্যে জলে ঠোঁট ডুবিয়ে জলজ জন্তুদের খুঁজে ফিরছে। কাকেদের কাকিমা নেই তাই ওরা বিজলি তারে বসে কাকা কাকা বলে ডাকছে। পাশেই মেছো বাজার-নীল লাল হলুদ সবুজ সব পলিথিন টাঙানো এক ছোট্ট প্রভাতী বাজার। সেখান থেকে চমৎকার একটা সামুদ্রিক মেছো গন্ধ আসছে। আলু পেঁয়াজের পাশে পুজোর ফুল বিল্বপত্র – একটু দূরে সুন্দরবন থেকে আসা বৌটি কুমড়ো চিচিঙ্গা ঢ্যাড়শ পাতিলেবু সাজিয়ে বসে আয়েশ করে পাঁউরুটি খাচ্ছে। গিজিগিজি ভীড় – সকলেই সমস্বরে কথা বলছে। এমন সময় এক্কেবারে কানের গোড়ায় এক মাছওয়ালা ভয়ানক জোরে চেঁচিয়ে উঠলো “পচা পচা ….পচা ল্লিয়ে যাও ল্লিয়ে যাও”
চিৎকারে আঁৎকে উঠে হাতুড়ের আট টাকার ভাঁড় থেকে একটু খানি চরম গরম চা চলকে আঙ্গুলে গিয়ে পড়লো। আপাত গম্ভীর স্বল্পভাষী ঝুলোচুলো ছেলেটা ব্যাপারটা দেখে একটু মৃদু হাসলো। কেননা হাতুড়ে কোনও কাজই না ফেলে ছড়িয়ে ঠিকঠাক মতো করতে পারেন না। এমন সময় ধ্যাবড়ানো লিপস্টিক – নিশিমাখা নাইটির ওপর হাউসকোট চাপানো এক বাজাড়ু মহিলা এপাশ দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। অভ্যাসবশতঃ থলি বোঁচকা নামিয়ে বিমলবাবুর দোকানে দাঁড়ালেন। বিমলবাবুও চটপট ফুটন্ত বড় মগ থেকে ছোটো মগে করে চা নিয়ে পাঁচ টাকার ছোটো ভাঁড়ে ঢেলে বললেন “দিদি বিশকুট?”
দীর্ঘাঙ্গী খর্বনাসা ভদ্রমহিলা হাত তুলে বিমলবাবুকে একটা আঙ্গুল দেখালেন। বিমলবাবুও বৈয়াম থেকে একখানা প্রজাপতি বিস্কুট বার করে হাতবদল করলেন। বিস্কুটে কামড় দিয়ে ভদ্রমহিলা চাপানান্তে ধোঁয়া উদগীরণ করা হাতুড়ের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকালেন। বলা বাহুল্য অত্যন্ত সঙ্কুচিত হয়ে এলোমেলো বুড়ো শশব্যস্তে পাজামা থেকে দড়ি টড়ি কিছু ঝুলছে কিনা খুঁটিয়ে দেখে নিশ্চিন্ত হলেন।
ভদ্রমহিলা প্রশ্ন করলেন “আপনিই আমাদের হাতুড়েবাবু না?”
সিগারেটটা ফেলু স্টাইলে টুশকি দিয়ে ফেলে হাতুড়ে জানালেন ওনার ধারণা অভ্রান্ত। তখন ভদ্রমহিলা বললেন “আপনার সাথে আমার কিছু গোপন কথা ছিলো” ভদ্রমহিলার গলাখানি যে তার সপ্তকে বাঁধা আছে তাতে বাজারের অর্ধেক লোকই চা পান দরদাম সব ছেড়ে সেই গোপন কথাটি শোনার জন্যে হাতুড়ের দিকে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইলো। এমন কি একটা ভোঁদড়মার্কা কুকুর পর্যন্ত এসে হাতুড়ের দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
হাতুড়ে অপ্রস্তুত হয়ে বললেন “আহা আপনার গোপন কথাটি বলেই ফেলুন না দেখি”
বাজাড়ু একটু খানি গলা নামিয়ে বললেন “সামনেই তো পুজো আসছে”
অত্যন্ত চিন্তিত হাতুড়ে বললেন “তা তো বটেই – মানে তা তো বটেই”
“আমাদের বাড়িতে পুজো হয়.…… একশো ছাব্বিশ বছরের পুজো – আমিই তো বাড়ির মেজ বৌ …. মানে বুঝতেই পারছেন আমার কতো দায়িত্ব ….”
লম্বাপারা ছেলেটা একটু অধৈর্য হয়ে ওঠে। কেননা সে কিম্বা তার পাশে বসা হাতুড়ে এখনও গোপন কথাটির আভাসমাত্রও পান নি।
বাজাড়ুদেবী হাতুড়ের পাশে একটা লাল রঙা প্লাস্টিকের টুল টেনে নিয়ে বসলেন। “বিমলদা আর তিনটে চা দাও তো… ভাই তোমার চা চলে?”
বিমলবাবু ভাঁড়ে চা ঢেলে এগিয়ে দিলেন। উনি বুড়োর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন “তারিখটা একটু পিছিয়ে দিতে হবে”
বুড়ো ভারি অবাক হয়ে বললেন “পুজোর তারিখ? পিছিয়ে দেবো?”
এবারে পাশের ঝুলোচুলো যুবকও কিঞ্চিৎ বিষ্মিত।
“না ঐ সময়ে আমার ইয়ে হবে .. নৈলে বুঝতেই তো পারছেন ….”
আধবুড়ো হাতুড়ে পকেট হাৎড়ে একটা লাল সাদা সিগারেটের প্যাকেট বার করে একটা সিগারেট ধরান। ব্যাপারটা এতোক্ষণে ওনার ঘিলুতে সেঁধিয়েছে। “কি পুজো ?”
ভদ্রমহিলা একটুক্ষণ অবাক হয়ে বলেন “এমা আপনি না ভীষণ দুষ্টু – জানেন না? মায়ের পুজো – মা আসবেন তো”
আধবুড়ো আঙ্গুলের টোকা দিয়ে ছাই ঝাড়েন “মা কোথায় আসবেন?”
এবার বাজারশ্রান্ত মহিলার মুখে একটা মিষ্টি হাসি খেলা করে “মা তো বাপের বাড়ি আসবেন … আপনি মজা করছেন …”
বুড়ো একটা রহস্যময় হাসি হাসেন “মা কি একাই আসেন? নাকি সঙ্গে কেউ থাকে?”
ভদ্রমহিলা শুনেছেন লোকটা একটু ছিটগ্রস্ত আজ নিঃসন্দেহ হয়ে হাসেন “সঙ্গে দুই ছেলে আর দুই মেয়ে থাকে … হয়েছে? আর হ্যাঁ একটা সিংহও থাকে। নিন এবার ওষুধটা বলুন তো আমি ঘরে যাই … সব কাজ পড়ে আছে…”
আধবুড়ো হাতুড়ে নীমিলিত নয়নে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলেন “চারটে ছেলে মেয়ে? সেই মা আবার বাপের বাড়িও আসে … আমাদের ঘরের মেয়ের মতো …”
ডাক্তার চায়ে চুমুক দ্যান “তা দিদিমণি আমাদের মায়ের কি পিরিয়ড হয় না? বিয়ে হয় শ্বশুরবাড়ি আছে … বাচ্চাও হয় … আমাদের জগজ্জননীরও তো তাহলে পিরিয়ড হওয়ার কথা….”
কপালে ঘাম জমে থাকা বাজার ফেরত মহিলা এই দিকটা ভাবেন নি। উনি শূন্য চায়ের ভাঁড় হাতে বসে থাকেন – বসেই থাকেন। হাতুড়ে ডাক্তার বলতে থাকেন “শুনুন দিদিমণি আমাদের পেটের ভেতরে সব সময় পায়খানা তৈরি হচ্ছে ….পেচ্ছাপের থলিতে পেচ্ছাপ জমা হচ্ছে … সব সময় – তার মানে পুরুৎ ঠাকুর যিনি চারঘন্টা ধরে নেচে নেচে আরতি করবেন – ঐ সময়ের মধ্যে তাঁরও শরীরে ঐ সব জমা হচ্ছে। পায়খানা পেচ্ছাপ দুটোই জমছে – তাছাড়া বয়স্ক হলে আর প্রোস্টেট গ্ল্যান্ড বড়ো হয়ে থাকলে ঘতো ট্যাঙ্কি ভর্তিই থাকবে। অর্শ থাকলে অল্প অল্প রক্তপাতের সম্ভাবনা অবশ্যই থাকে … তাই তো? তিনি পুরুষ বলে পবিত্র রইলেন আর আমাদের বাড়ির মেয়েটা ঋতুস্রাব হয়েছে বলে অপবিত্র? তাকে ক্ষতিকর ওষুধ খেয়ে দিন পেছোতে হবে? এ আপনার কেমন বিচার দিদিমণি?”
ভদ্রমহিলা স্তব্ধবাক। “ঐ জিনিসটা অপবিত্র নয়? নোংরা নয়?”
“আপনাকে বড়ো ক্লান্ত দেখাচ্ছে মা … সকালে তো খাওয়া হয়নি? হোক আজ সব কাজে দেরি .. বিমলবাবু ওনাকে একটা কেক আর ঘুঘনি দিন – আপনি খেতে থাকুন আমি গল্প বলি – আপনার শরীরেরই গল্প – কিন্তু আপনার অজানা গল্প …”
আধবুড়ো ডাক্তারের পাশে বসা হাড় ডিগডিগে ছোকরা বিমলবাবুকে বলে “কাকু আমাকে আর একটা ওমলেট দাও তো”
বিমলবাবু হাসেন “ইনি বকবক করতে শুরু করলে কখন থামবে ঠিক নেই – তোমায় একটা ডিমটোশ করে দেই?”
ছেলেটা হাসে “গোলমরিচ দিয়ো না কিন্তু কাকু”
ডাক্তার বলতে থাকেন “আসলে এটা অনাগত সন্তানের জন্য জরায়ুর কান্না”।
ভদ্রমহিলা ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মোছেন “কান্না ?”
ডাক্তার বলেন “শোন রে মা শোন- মেয়েদের শরীরে লক্ষ লক্ষ ডিম ভর্তি দুটো ডিম্বকোষ থাকে। ঋতুস্রাব শুরু হওয়ার পরে মেয়েদের শরীরে প্রতি মাসে একটা ডিম ম্যাচিওর হয়ে শুক্রাণুর জন্যে অপেক্ষা করে। শুক্রাণুর সঙ্গে ডিম্বাণুর মিলনে তৈরি হয় ভ্রূণ। শুক্রাণুর সঙ্গে মিলনের আগে জরায়ু মানে ইউটেরাসে কিছু কিছু পরিবর্তন হয় – একটা প্ল্যাসেন্টা বা ফুল তৈরি হতে থাকে। যাতে ভবিষ্যতে তৈরি হওয়া সন্তানের খাবারের কোনও অভাব না থাকে। তখন জরায়ু অনাগত সন্তানের খাদ্যের জন্য একটা ব্যবস্থা করে রাখে। তারপর যদি মেয়েটা গর্ভবতী না হয় তখন সেই ফুল বা সম্পূর্ণ না তৈরি হওয়া প্ল্যাসেন্টাটা রক্তের সঙ্গে যোনি দিয়ে বেরিয়ে আসে। আবার নতুন করে নতুন সন্তানের জন্য জরায়ুর ভেতরে ফুল তৈরি হওয়া শুরু হয়। গর্ভবতী না হলে প্রতি মাসে সেই ভ্রূণের খাবার যোগাড় দেওয়ার জন্যে তৈরি প্ল্যাসেন্টা বা ফুলটা ঝরে যায়। সেটাই মাসিক বা পিরিয়ড । তাই এটাকে অনাগত সন্তানের জন্যে জরায়ুর কান্না বলা হয়।” ডাক্তার চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে দিয়ে বলেন “মাসিক হয় বলেই দুর্গা মা হয়, আমাদের এই মেয়েটাও মা হয় – না হলে – মহামায়ার মায়ার খেলা থেমে যেতো …. যা মা দশভুজা বাড়ি যা। বলবি মা দুর্গারও মাসিক হয়। তাই দুগ্গা মা হতে পেরেছেন । আমি এই নিয়েই পুজো করবো”
ভদ্রমহিলা চায়ের গ্লাসটা রেখে দাম টাম না দিয়েই গটগট করে বাড়ির দিকে হাঁটা লাগান। হাতুড়ে মাথা টাথা চুলকে বিমলবাবুকে টাকা দিয়ে রোগা ছেলেটার হাত ধরে হাঁটা লাগান।
এত সুন্দর ও সহজ করে এই শরীরের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা… খুব ই ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ
ধন্য
ধন্যবাদ
Awesome explanation.
ধন্যবাদ
আহা
ধন্যবাদ
Like!! I blog frequently and I really thank you for your content. The article has truly peaked my interest.
ধন্যবাদ
I learn something new and challenging on blogs I stumbleupon everyday.
I always spent my half an hour to read this web site’s articles or reviews daily along with a mug of coffee.
These are actually great ideas in concerning blogging.
সবাইকে অফুরান ধন্যবাদ