রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১ – ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ)
“হে নূতন
দেখা দিক আর – বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ।।
তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন
সূর্যের মতন।
রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন।
ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,
ব্যক্ত হোক তোমামাঝে অসীমের চিরবিস্ময়।
উদয় দিগন্তে শঙ্খ বাজে, মোর চিত্ত মাঝে
চিরনূতনেরে দিল ডাক
পঁচিশে বৈশাখ।।”
বিশ্ব ও ভারতকে তিনি তাঁর শান্তির নিকেতনে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আর সমৃদ্ধিশীল ভারতীয় ঐতিহ্য এবং বৈচিত্র্যময় বাংলার প্রাণকে তিনি কাব্য, গল্প, গীতি, নাট্য, উপন্যাস, প্রবন্ধ, অঙ্কন, নৃত্যনাট্য বহুবিধ রূপ রসের অরূপ বাণীর মাধ্যমে আবিশ্ব ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। বিশ্বপ্রকৃতি ও প্রাণের প্রতি ছিল তাঁর অপার ভালবাসা ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী। প্রকৃতি, সৌন্দর্য, কর্ম ও সৃজনের মধ্যে সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজে পেয়েছিলেন। তাঁর জাতীয়তাবাদ ছিল বৃহত্তর। শিক্ষা বিশেষত শিশু শিক্ষা এবং বাংলা ভাষার উপর মৌলিক, চমকপ্রদ ও প্রকাণ্ড কাজ করে গেছেন।
তাঁর অনন্য বহুমুখী প্রতিভাধর মনন প্রকৃতি সংরক্ষণ, সার্বিক শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, বিবিধ শিল্প মাধ্যম, স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা, কৃষি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, পল্লী গঠন ও উন্নয়ন, সমবায়, দেশাত্মবোধ ও জাতীয় সংহতি, বিশ্ব ভাবনা এবং মুক্তির পথের সাধনায় ব্যাপৃত ছিল। যৌবনকালে শিলাইদহে কীর্তিনাশা পদ্মার উথালপাথাল স্রোত, বর্ষণসিক্ত উর্বর পূর্ব বাংলার কৃষিভিত্তিক শ্যামল শোভন গ্রামজীবন তাঁকে বিশ্ব সাহিত্যের অমূল্য সব সৃষ্টি রচনা করতে প্রাণিত করেছে। ব্রহ্মসঙ্গীত থেকে কীর্তনাঙ্গন, লালনগীতি থেকে বাউলরীতি তাঁর সৃজনকে করে তুলেছিল সংপৃক্ত। সায়াহ্নে রাঢ় বাংলার বর্ণময় ঋতুভরী প্রকৃতি ও জীবন বৈচিত্র্য তাঁকে জুগিয়ে গেছে প্রেরণা।
তাঁর দীর্ঘজীবন সঞ্চিত রেনেসাঁলব্ধ জোড়াসাঁকোর পরিবার – পরিবেশ, বিশ্বভ্রমণ বীক্ষা সহ বিভিন্ন অন্বেষণ জাত জ্ঞানধারার উন্মেষ মহীরূহের মত জাতির চিন্তা চেতনায় এক স্নিগ্ধ ছায়া সহ আনন্দ প্রবাহের সঞ্চার করেছে। তাঁর সর্বমঙ্গলবাদী নান্দনিক দর্শন ও কর্মযজ্ঞ দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে মানব সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছে। প্রাচ্যের প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিশ্বকবির বিশ্বসম্মান পরাধীন জাতিকে সাহস, শক্তি এবং উৎসাহ বর্ষণ করেছে।
“আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।
এ জীবন পুণ্য করো দহন – দানে।।
আমার এই দেহখানি তুলে ধরো,
তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো –
নিশিদিন আলোক – শিখা জ্বলুক গানে।।
আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব
সারারাত ফোটাক তারা নব নব।
নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো,
যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো –
ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊর্ধ্বপানে।।”
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪ – ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ)
“লেবু পাতায় করমচা
হে বিষ্টি ধরে যা -“
প্রকৃতি ও মানবপ্রেমী এই বরেণ্য কথা সাহিত্যিক তাঁর অনন্য অননুকরণীয় স্নিগ্ধ ভাষার পুষ্পমালায় গ্রাম বাংলার রূপসী প্রকৃতি ও তার সঙ্গে মিশে থাকা দরদী মানব সন্তানদের জীবনালেখ্যকে অমর সাহিত্যে রূপান্তরিত করেছেন।
চব্বিশ পরগণা – যশোর – নদীয়ার শ্যামল সজল নদী – খাল – বিল বিধৌত পল্লীগ্রাম থেকে তাঁর দারিদ্র্যপীড়িত পথ চলা শুরু। কখনও গৃহ শিক্ষক, কখনও শিক্ষক, কখনও বা উপোসী বিশুদ্ধ বেকার, কিংবা খেলাপচন্দ্র এস্টেটের সেক্রেটারি, তাঁর ভ্রমণের বিস্তার বাংলার কাশ মাদার ফণীমনসার বন ছাড়িয়ে ভাগলপুর – পূর্নিয়া – ঘাটশিলার সমতল – অরণ্য – পাহাড় – ঝর্না ছাপিয়ে বহুদূর। আর তাঁর কল্পনায় আমাদের আবিষ্ট রাখে কেনিয়ার জঙ্গল ছাড়িয়ে রোডেশিয়ার চাঁদের পাহাড়ে। প্রিয়তমা নদী ইচ্ছামতীর স্মৃতি তিনি খুঁজে পান সুবর্ণরেখার বর্ণচ্ছটায়।
গাঁ – গঞ্জের অনামী ভাটফুল, শেওড়া, বনকচু থেকে শীর্ণকায়া গ্রাম্য নদীটি তাঁর লেখার গুণে ধ্রুপদী সাহিত্যে স্থান পেয়েছে। তাঁর শান্ত সহজ শব্দমালা, অনাবিল নিরুচ্চার সব অভিব্যক্তি এবং অপূর্ব সব করুণরসের দৃশ্যায়ন সৃষ্টি করেছে। পথের পাঁচালী তাঁর সেরার সেরা। এছাড়াও অপরাজিত, আরণ্যক, আদর্শ হিন্দু হোটেল, অশনি সংকেত, অনুবর্তন, মেঘমল্লার, তালনবমী, দৃষ্টিপ্রদীপ, দেবযান, মৌরিফুল প্রভৃতি তাঁর অনুপম সৃষ্টি, একেকটি মানবতার দলিল। তাঁর রচিত অপু, দুর্গা, সর্বজয়া, ইন্দির ঠাকরুন – গ্রামের ক্ষয়িষ্ণু পরিবারের আটপৌরে চরিত্রগুলি সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় চলচ্চিত্রে জীবন্ত। বিভূতিভূষণের জীবন দর্শনের কেন্দ্রে অপরূপ অফুরন্ত নির্জন প্রকৃতির বুকে প্রকৃতির সন্তান মানুষ এবং দুইয়ের একাত্মতায় এক সহজ সরল অথচ অনির্বচনীয় আনন্দ, প্রশান্তি এবং উপলব্ধি।
“… মহালিখরূপের পাহাড়ের পাদদেশে বিশাল বন্যপ্রান্তরে বসন্ত নামিয়াছে, লবটুলিয়া – বইহারের সর্বত্র হলুদ রঙের গোলগোলি ফুলের মেলা, দ্বিপ্রহরে তাম্রাভ রৌদ্রদগ্ধ দিগন্ত বালির ঝড়ে ঝাপসা, রাত্রে দূরে মহালিখরূপের পাহাড়ে আগুনের মালা, শালবনে আগুন দিয়াছে। … “