১.
আমরা মুঠো আলগা করে দিয়েছিলাম। কোভিডের ভয় ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলাম- “ছ্যাঃ! ওসব আবার রোগ নাকি? ওগুলো সব ন্যাকাচন্ডি বড়লোক আর ভয় বেচে খাওয়া ডাক্তারগুলোর বানানো গল্প। আমাদেরকে ভাই কোভিড-ফোভিড নিয়ে জ্ঞান দিতে আসবেন না।” তারপর পুচ করে পানের পিক ফেলে পাড়ার চায়ের দোকানের মজলিসে চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিলাম- “আর এক রাউন্ড চা দাও দেখি হরেন দা। এসব ভাটের করোনার গল্প শুনতে শুনতে মাথাটা ধরে গেল।” তারপর ধীরে ধীরে সব ভয়টয় ভ্যানিশ! রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছোটালেন। মিটিংয়ে-মিছিলে কাতারে কাতারে মানুষ ভিড় জমালেন। মাস্কহীন। স্বাস্থ্য-সচেতনতাহীন। বাজার-হাট-ট্রেন-বাস সব জায়গাতেই এক ছবি।
শিকারী বেড়ালের মতো ওঁৎ পেতে ছিল মারণ ভাইরাস। যথারীতি দ্বিতীয় ছোবল এসে পড়েছে। ঠিক একমাস আগে দেশের দৈনিক সংক্রমণ ছিল ন’-দশ হাজার। সেটাই এখন পঞ্চাশ হাজার ছাড়িয়েছে। আমার হাসপাতালেও তার প্রভাব পড়েছে। অনেকদিন ধরেই কোনও নতুন রোগী ছিল না বললেই চলে। আইসোলেশন ওয়ার্ডে ধূ ধূ মরু। সেখানেই আবার নতুন রোগীর ঢল নামছে। একদিনেই খান কুড়ি করে পজিটিভ আসছে। জানি না, নতুন ঢেউ কদ্দূর বিপজ্জনক হবে। জানি না, আবার সেই পিপিই-র অসহ্য কষ্ট আর স্বজন হারানোর কান্নার দিন ফিরে আসবে কিনা। কোভিড পজিটিভ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে বাড়ির কারো সাথে দেখা হবে না। মৃত্যুশয্যায় প্রিয় মানুষের মুখ মনে পড়লেও দেখা করার সুযোগ মিলবে না। শীতল শরীরটাও সবার অগোচরে কোনও এক অন্ধকারে হারিয়ে যাবে। নতুন ঢেউ কতখানি ঘা দেবে কেউ জানে না। তবু ঘরপোড়া গরু তো… সিঁদুরে মেঘ দেখলেই বুক কেঁপে ওঠে। চিৎকার করে বলি, ‘তফাৎ যাও’!
২.
বড় হওয়ার কালে ধর্ম কোনোদিন গলার ওপরে চেপে বসে নি। দেবদেবীরা বরাবরই বাড়ির ছেলেমেয়ে। বাড়ির কাছে রেলস্টেশনের ধারে শিবদূর্গার মেলা হয়। এই সেদিনও মেলায় গিয়ে শিবঠাকুর দেখেছি। নধর ভুঁড়ি, সরু গোঁফ, লুঙ্গির মতো আলগোছে জড়ানো বাঘছাল। ঠিক যেন আমাদের পরিচিত কোনও প্রৌঢ় ভদ্রলোক। আজ হঠাৎ করে আমাদের শিবঠাকুরের জিম করা বাইসেপস আর ভুঁড়ি সরে গিয়ে সিক্স-প্যাক এলে আমি শুধু অবাক হবো না, ভয় পাবো।
সরস্বতী পুজোর আগে লুকিয়ে টক কুল খেয়ে ফেললে একটুখানি ভয় হয়েছে- ঠাকুর পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ করিয়ে দেবে না তো? এবং, এইটুকুই। দিব্যি খেয়েদেয়ে পুষ্পাঞ্জলি দিয়েছি। কেউ কান ধরে বের করে দেয় নি। বড় হয়ে যখন নিজের বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী ভাবতে গিয়ে পুজোর আচারে বিশ্বাস হারিয়েছি তাতেও কেউ বাধা দেয় নি। আমি পুজোর প্রদীপ জ্বালি। মালা গাঁথি। প্রসাদ পেলে নির্বিকার ভাবে পেটে চালান করে দিই। পুজোর আনন্দটা আজও আমার। কেউ আমাকে চোখ রাঙিয়ে বলে নি ঠাকুর-দেবতার অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস না থাকলে উৎসবে অংশ নেওয়া যাবে না।
‘পাতি’ বাংলা মিডিয়ামের ছাত্র ছিলাম। তখনও বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলোর এরকম চালচুলোহীন অবস্থা হয় নি। বিভিন্ন অফিসের কাজে সই করার দরকার হ’লে কখনও বাংলা, কখনও ইংরেজিতে করেছি। কেউ কোনোদিন বলে নি, কখনও ভাবিও নি- অফিসের কাজে হিন্দি জানা আবশ্যক হয়ে দাঁড়াবে ধীরে ধীরে। আমার মায়ের ভাষা আমারই মায়ের দেশে কোনঠাসা হয়ে যাবে।
জড়িবুটি-গোমূত্র-পাথর-তাবিজ-হোমিওপ্যাথির বিরোধিতা করেছি গলা ফাটিয়ে। কোনোদিন ভাবিনি একসময় অপবিজ্ঞানের অন্ধকার আমাদের চেতনাকে গ্রাস করে ফেলবে। আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার বদলে পাড়ার মোড়ে মোড়ে গড়ে উঠবে আয়ুশ সেন্টার। গণেশের শুঁড় আসলে প্লাস্টিক সার্জারি, গোমূত্র-জড়িবুটি ক্কাথে করোনা সারে কিংবা পুষ্পকরথ মানেই আধুনিক এরোপ্লেন; এ জাতীয় দাবী উঠবে এবং সেগুলো মানুষ নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করবেন- ভাবিনি। সত্যি ভাবিনি।
শুধুমাত্র নিজেদের আজন্মকালের সংস্কৃতি, নিজেদের ভাষা, নিজেদের বিজ্ঞানচেতনাকে বজায় রাখতে চাওয়াও যে ধীরে ধীরে রাজনীতি হয়ে উঠবে সেটাই বা কবে বুঝতে পেরেছিলাম?
৩.
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সব আবার ছারখার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কার মাঝেই এরাজ্যের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভোট এসে পড়েছে। সবাই বেশ জানি- আমাদের প্রতিদিনের লড়াই, আমাদের ঘাম, আমাদের ভালোবাসা, আমাদের চিৎকার, আমাদের আশ্লেষ চুম্বন, আমাদের সকালের রবি ঠাকুর আর রাত্রির জীবনানন্দের সাথে কোনও রাজনৈতিক দলের দূর দূর অব্দি কোনও সম্পর্ক নেই। দিনের শেষে খাবারটা নিজেদেরই খুঁটে জোগাড় করতে হয়। আমার প্রবল মাথাব্যথায় কোনও রাজনৈতিক দল এসে কফির কাপ আর প্যারাসিটামল নিয়ে হাজির হবে না। তবুও লড়াইগুলো চালাতে গেলে নিজের একখন্ড মাটির অধিকার লাগে। ভারতবর্ষ নামের শেষে প্রাইভেট লিমিটেড জুড়ে গেলে লড়াই করার অধিকারটুকুও আর থাকবে না যে…
ভোটের সং বেরিয়েছে রাস্তায় রাস্তায়। কোন সং কোন দলের সেটা জার্সিতে না লেখা থাকলে বোঝা ভার। তবে তাদের মধ্যে একটাই মিল- কেউই আসন্ন করোনা পরিস্থিতি নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবিত নয়। রাজনৈতিক দলগুলো নয়, মানুষের ওপরে এখনও বিশ্বাস রাখি। ভোট দেওয়া আমাদের অধিকার। ভোট দেবো কিন্তু সতর্কতা মেনে। বোতাম টেপার সময়েও মাথায় রাখবো-
মাস্ক পরবো। দূরত্ব বজায় রাখবো।
হিন্দি ভারতের রাষ্ট্রভাষা নয়।
দেশটা আমার। দেশটা সবার।
গরম বাড়ছে। এখনই দুপুরে বাইরে বেরোতে গেলে কষ্ট হচ্ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মারীর আতঙ্ক এবং ভোট ঘিরে হানাহানির ভয়। তবু আশা আছে। আমাদের একজন রবীন্দ্রনাথ আছেন-
যা-কিছু জীর্ণ আমার, দীর্ণ আমার, জীবনহারা,
তাহারি স্তরে স্তরে পড়ুক ঝরে সুরের ধারা।
নিশিদিন এই জীবনের তৃষার ‘পরে, ভুখের ‘পরে
শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে