প্রাককথন
২০১১ সালে রবীন্দ্রনাথের ১৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে একক মাত্রা পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আমার একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। দশ বছর পরে ফিরে দেখতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, জনস্বাস্থ্য নিয়ে তাঁর বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা একটুও কমেনি। অন্য কথায় বলা যায়, আমরা রবীন্দ্র-পূজার বহুতর আয়োজনের মাঝে তাঁকে ভুলে থাকার অভ্যাস রপ্ত করেছি। রোগ হবার পরে হাসপাতাল ডাক্তারখানায় চিকিৎসা নিয়ে আমাদের যেটুকু হইচই, জনস্বাস্থ্য নিয়ে সেটুকুও নেই। ফলে কর্পোরেট আমাদের জন্যে স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করে দেবে, আমরা স্রেফ টাকার থলিটা জোগাড় করতে পারলেই ভূরিভোজে বসে যাব, নানাবিধ চিকিৎসা-বিভ্রাট সত্ত্বেও এমন ভাবনা আমাদের এখনও ছাড়েনি।
তাই পুরনো লেখাটি কিঞ্চিৎ ঘষামাজা করে এখানে রাখছি। দীর্ঘ লেখায় ফেসবুকে পাঠক জোটে না। তাই লেখাটি ভেঙ্গে নিয়েছি চারটি পর্বে। প্রতিটি পর্ব স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, কিন্তু এক-একটি পর্ব পড়লে তার বিষয় আলাদা করে পড়ে বুঝতে অসুবিধা হবার কথাও নয়।
পর্ব ৪
(তৃতীয় পর্বের পরে)
জনস্বাস্থ্যের আধুনিক ধারণা ও রবীন্দ্রনাথ
১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বরে আলমা-আটা শহরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষণা করেছিল ‘২০০০ সালের মধ্যে সকলের জন্য স্বাস্থ্য’ আনা হবে। রাষ্ট্রসংঘের এক শাখা সংগঠন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তার সেদিনের ঘোষণাপত্রের ভাষা অতীব সাহসী ছিল বলা যায়। কিছু মানুষের সন্দেহ তাতে ঘোচেনি। কিন্তু মোটের ওপর সারা পৃথিবী জুড়ে এই (অধুনা নিহত!) উজ্জ্বল প্রতিশ্রুতি অনেক আশা আর চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। আজ তার তেতাল্লিশ বছর পেরিয়ে গেছে। কেউ কথা রাখেনি। তবু ওই অধিবেশনের ঘোষণাটি জনস্বাস্থ্য বলতে আধুনিক কালে কী বোঝায় তার মাপকাঠি দিয়েছে। এ-ঘোষণাকে এযুগের মানুষের ন্যায়বোধের এক ধারণার প্রকাশ হিসেবে ধরা যেতে পারে। স্বাস্থ্য অর্জনের জন্য ঠিক কী কী করতে হবে, এবং কারা সেটা করবে, তার সম্পর্কে একটা স্পষ্ট দিশা ঘোষণাপত্রে পাওয়া যায়।
সকলের জন্য স্বাস্থ্য – ঘোষণাপত্র
“স্বাস্থ্য কেবলমাত্র অসুখ বা বিকলাঙ্গতার অনুপস্থিতি নয়, বরং শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক ভাবে সম্পূর্ণ ভালো থাকা এবং তা মানুষের মৌলিক অধিকার।’’
“জনগণের নিজস্ব স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিকল্পনা ও রূপায়ণে তাদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত ভাবে অংশগ্রহণের অধিকার ও দায়িত্ব রয়েছে।’’
“একটা গ্রহণযোগ্য স্বাস্থ্যব্যবস্থা…পাওয়া যেতে পারে…পৃথিবীর সম্পদের পুর্ণতর ও মহত্তর ব্যবহারের দ্বারা…যার বৃহৎ অংশ এখন অস্ত্রের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে…”
আলমা-আটা শহরে ঐ অধিবেশনে বলা হয়েছিল যে, “স্বাস্থ্য কেবলমাত্র অসুখ বা বিকলাঙ্গতার অনুপস্থিতি নয়, বরং শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক ভাবে সম্পূর্ণ ভালো থাকা এবং তা মানুষের মৌলিক অধিকার।’’ [অনুবাদ লেখকের]
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল, বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে মানুষের স্বাস্থ্যের অবস্থায় বিরাট পার্থক্য আছে। এমনকি একই রাষ্ট্রের ভিতরে বিভিন্ন মানুষের স্বাস্থ্য পাবার ব্যবস্থায় পার্থক্য কিছু কম নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এতদূর পর্যন্ত বলেছিল যে, মানুষের স্বাস্থ্যের প্রয়োজনেই স্বাস্থ্যের নিজস্ব ক্ষেত্র ছাড়াও সমাজ ও অর্থনীতিতে হস্তক্ষেপের প্রয়োজন আছে।
কথাটা কিঞ্চিৎ বিশদে বলার দরকার রয়েছে। এই ঘোষণায় বলা হয়েছিল যে, দেশের মানুষের স্বাস্থ্যের দায়িত্ব সরকারের, অন্যদিকে এ-কথাও বলা হয়েছিল, “জনগণের নিজস্ব স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিকল্পনা ও রূপায়ণে তাদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত ভাবে অংশগ্রহণের অধিকার ও দায়িত্ব রয়েছে।’’ এ যেন রবীন্দ্রনাথের চাইতেও এককাঠি বাড়া। তিনি বলেছিলেন, ভিক্ষার ওপরে শুধু জনসাধারণের কল্যাণ নির্ভর করবে না।
“আজ এই কথা পল্লীকে বুঝতেই হবে যে, তোমাদের অন্নদান জলদান বিদ্যাদান স্বাস্থ্যদান কেউ করবে না। ভিক্ষার উপরে তোমাদের কল্যাণ নির্ভর করবে এতবড়ো অভিশাপ তোমাদের উপর যেন না থাকে।” [রবীন্দ্রনাথ, ‘পল্লীর উন্নতি’, মার্চ, ১৯১৫]
আর আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলল, ভিক্ষার ওপর জনস্বাস্থ্য নির্ভর করবে না। শুধু তাই নয়, (জন) স্বাস্থ্যব্যবস্থা জনসাধারণের হকের কড়ি, আর সে কড়ি কীভাবে খরচা করা হবে সেটা দেখভাল করবার মধ্যে দিয়ে জনগণ নিজেই নিজেকে শিক্ষিত করে তুলবে, আপনার সবচেয়ে ভাল হয় কিসে সেটা আপনি ঠিক করবেন।
রবীন্দ্র-জনস্বাস্থ্য ভাবনার আধুনিক রূপায়ন
প্রশ্ন আসে আজকে সকলের জন্য স্বাস্থ্য’ – এ-নিয়ে কথা তুলছি কেন? আমার প্রবন্ধ তো রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, তাঁর চিন্তা তাঁর কর্মকে নিয়ে, জনস্বাস্থ্য নিয়ে তিনি কি ভেবেছিলেন আর করেছিলেন তাই নিয়ে। আজ থেকে আশি বছর আগে প্রয়াত হয়েছেন যে কবি ও কর্মী, তাঁর মানস তাঁর কর্ম নিয়ে আলোচনা করার জন্য তাঁর মৃত্যুর পরে সম্পূর্ণ আলাদা পরিস্থিতিতে এক আন্তর্জাতিক সংগঠন কী বলেছিল তার কোন প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে?
আধুনিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা তাত্ত্বিক দিক থেকে ক্রমশ রবীন্দ্রনাথের “… যাকে পল্লীসেবা বলা হয়েছে, তার অর্থ তোমরা একত্র সমবেত হয়ে তোমাদের নিজের চেষ্টায় তোমাদের দুঃখ দূর করো…” এই বক্তব্যের কাছাকাছি আসছে। তার সঙ্গে যেটা যোগ হয়েছে সেটা হল, দুঃখ দূর করাটা কোনো দয়ার দান নয়। পৃথিবীর সম্পদ সৃষ্টি করছে সাধারণ মানুষ, তাই তার ন্যায্য অধিকার হল স্বাস্থ্য। এ স্বাস্থ্য কেবল অসুখ থেকে মুক্তি নয়, বরং তা হল শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক ভাবে সম্পূর্ণ ভালো থাকা, ইহজাগতিক দুঃখ থেকে যতটা সম্ভব ততটাই মুক্ত থাকা। এবং তা মানুষের মৌলিক অধিকার।
স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনাকে স্মরণ করার একটা চলতি ধরণ হল স্রেফ রবি ঠাকুরকে জানার জন্যেই তাঁর চিন্তার হদিশ নেওয়া। এ এক ধরণের নিস্ক্রিয় ইতিহাস-চর্চা। ব্যক্তিগত কারণে, সামাজিক অবস্থানের জন্য এবং যুগের সীমাবদ্ধতার ফলে রবীন্দ্রনাথের মত অনন্যসাধারণ মানুষও আটকা পড়েছিলেন। আবার এই মানুষটিই সত্যিকারের ভবিষ্যতদ্রষ্টার চোখ দিয়ে ভবিষ্যতকে দেখেছিলেন, তাকে বরণও করেছিলেন। আজকে রবীন্দ্রনাথকে অনুধাবন করতে গেলে তাঁর ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দী জুড়ে চলে আসা চিন্তা ও কর্মকাণ্ডকে একটা প্রেক্ষিতে স্থাপন করতে হয়, আর বর্তমান পৃথিবীতে জনস্বাস্থ্য নিয়ে যে ভাবনা ও কাজ চলছে তার সঙ্গে তাঁর ভাবনাকে মিলিয়ে দেখতে হবে। তিনি তাঁর যুগের থেকে অনেক এগিয়ে ভাবতে পেরেছিলেন। জনগণের দ্বারাই কেবল জন-স্বাস্থ্যের প্রকৃত কাজ হওয়া সম্ভব, সে-সত্য রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় সেই সময়েই আসতে পেরেছিল।
জনস্বাস্থ্য নিয়ে তাঁর চিন্তার মূল জায়গাটাই ছিল ‘জন’-এর শিক্ষা। এমন শিক্ষা যা মানুষকে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে, নিজের ভালমন্দ নিজে বুঝে নিতে। এটুকু করা বড় সহজ ব্যপার নয়। এটি অধুনা চালু ‘এন জি ও’ মডেলের জনস্বাস্থ্যের, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ মডেলের মুনফাবাজীর, বিশ্ব-ব্যাঙ্কের আদেশে ‘কাঠামোগত সংস্কার’ করে জনস্বাস্থ্যের গঙ্গাযাত্রা-ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে অবস্থিত একটি চিন্তাপ্রক্রিয়া।
সত্যিই যদি ‘জন’-র হাতে চিন্তা করার ভার দেওয়া হয়, সত্যিই যদি তাদের জানতে দেওয়া হয় তাদের স্বাস্থ্য, যা তাদের জীবিকা তাদের পরিবেশের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে যুক্ত, সেসব নিয়ে কী কী হচ্ছে, সত্যি যদি “জনগণের নিজস্ব স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিকল্পনা ও রূপায়ণে তাদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত ভাবে অংশগ্রহণের অধিকার ও দায়িত্ব’’, যেমনটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, তা দেওয়া যায়, তা হলে জনগণের বহু প্রশ্নের উত্তর দেবার দায় এসে যায়, তাদের বহু অধিকার কেবল কথায় গ্রাহ্য নয়, বাস্তবেও মেনে নিতে হয়।
চিত্র পরিচিতি
আলমা আটা সম্মেলন
তথ্যসূত্র
লেখার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের রচনার সূত্র উল্লেখ করা আছে।