বছর আটেক হয়ে গেল। টালিগঞ্জের এম.আর.বাঙ্গুর হাসপাতালে তখন মেডিসিন বিভাগের এইচ.এম.ও আমি। এমারজেন্সিতে উপচে পড়া ভিড়। হাসপাতাল তখন এতো সাজানো ছিলো না। তিনটি ফ্লোরে রোগী ভর্তি। এক বেডে দুজন। মেঝেতেও ঠাঁই নাই। প্রাণান্তকর খাটুনি। কিন্তু তার মধ্যে থেকে প্রতিদিন নতুন নতুন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধি।
এমনই এক গ্রীষ্মের দুপুর। হঠাৎ হাসপাতালের বাইরে চিৎকার। “খুন,খুন,ডাক্তার সাব, জলদি আইয়ে”। বাঙালী কর্ণে এ শব্দবন্ধের অযাচিত প্রবেশ প্রাথমিক ভাবে থমকে দেওয়া অস্বাভাবিক বলে মনে হয় না। কিন্তু সম্বিত ফিরিয়ে তৎক্ষণাৎ আবার বেলাইন মনকে লাগাম পরানো ও পরার্থে সঠিক সিদ্ধান্তে ফেরার চারিত্রিক দৃঢ়তা এ পেশার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বারান্দা দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখি লুঙ্গি পরে একজন মাঝবয়েসী ভদ্রলোক গামছা দিয়ে নাক ঢেকে আছেন। গামছা ভিজে টপটপ করে “খুন” অর্থাৎ কিনা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে মেঝেতে। সত্যিই সাধারনের চোখে ভয়াবহ এক দৃশ্য।
ভদ্রলোককে আশ্বস্ত করে বিছানায় বসিয়ে দিলাম। মাথাটিকে সামনের দিকে কাত করে নিচে ঝুলিয়ে দিলাম। ফ্রিজ থেকে বরফের টুকরো বের করে রক্ত বেরোনো দিকের নাকে চেপে ধরলাম। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে খুন বন্ধ হলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো পরিজনকুল। ঘটনাচক্রে “এপিস্ট্যাক্সিস” অর্থাৎ নাক দিয়ে রক্তক্ষরণের প্রাথমিক চিকিৎসা এটাই। এতেই অধিকাংশ রোগীর রক্তক্ষরণ বন্ধ হবে।
আসলে নাক থেকে রক্ত পড়ার কারণ বহুমাত্রিক। সাধারণ ভাবে নাক খুঁটে রক্ত বের করা থেকে শুরু করে, উচ্চরক্তচাপ, লিটল’স এরিয়ার আঘাত, নাসিকাপথের বিভিন্ন রোগ, রক্তপাতজনিত রোগসমূহ, মায় কিছু ওষুধের ব্যবহারও অনভিপ্রেত এ ঘটনার উৎপত্তি করাতে সক্ষম। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে নাসাপথে কিছু ঢুকিয়ে ফেলা ও অবশেষে রক্তক্ষরণ এমারজেন্সি মেডিক্যালের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
রক্ত বেরোলে প্রাথমিক ভাবে নাক চেপে পাঁচ থেকে বিশ মিনিট ধরে রাখুন। বরফের ব্যবহার রক্তপাত দ্রুত বন্ধ করতে পারে। এই সময় মুখ দিয়ে ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিন। মাথাটিকে সামনের দিকে ঝুলিয়ে রাখলে রক্ত শ্বাসনালির দিকে গিয়ে শ্বাসপথের বাধা সৃষ্টি করবে না। অথবা খাদ্যনালীতে গিয়ে বমির উদ্রেকও করবে না। প্রাথমিক ভাবে রক্ত বন্ধ হোক বা না হোক, চিকিৎসকের কাছে গিয়ে এর কারণ অনুসন্ধান অত্যন্ত জরুরি। চিকিৎসক ওষুধ মাখানো রিবন গজের ব্যবহার করে বা সিলভার নাইট্রেটের মাধ্যমে কেমিক্যাল কটারী করে রক্তবন্ধ করবেন। খুব বেশি রক্ত বেরিয়ে গেলে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
আবার ফিরে আসি দক্ষিন চব্বিশ পরগনার “ভাঙড়” হাসপাতালের গল্পে।
রক্ত বন্ধের পর প্রাথমিক রোগ অনুসন্ধানে জানতে পারলাম রোগী উচ্চরক্তচাপ জনিত সমস্যায় দীর্ঘদিন ভুগছেন। ইদানীং সমস্ত ওষুধ বন্ধ করে প্রতিবেশীর পরামর্শে মর্নিং ওয়াক শুরু করেছেন ও কি এক দৈব পুরিয়া সেবন করে চলেছেন। শুনেই করুণা হলো। হায় মোর হতভাগা ভারতবর্ষ! প্রেসার মেপে দেখলাম ২০০/১০০। অর্থাৎ কিনা উচ্চরক্তচাপ ও তার সুচিকিৎসার ঘাটতি এবং প্রতিবেশীর “সু”পরামর্শ, ভদ্রলোকের অকালে প্রায় ‘খুন’ হতে বসার সম্ভাব্য কারণ।
তবে আমার সৌভাগ্য, ভদ্রলোককে বোঝাতে পেরেছিলাম। চিকিৎসক–রোগীর সন্দেহের কুজ্ঝটিকার গোলকধাঁধায় পড়েন নি তিনি।
মাসকয়েক আগে এস এস কে এম হাসপাতাল চত্বরে হঠাৎ পেছন থেকে কেউ যেন ডাকলেন “ডাক্তারসাব, পেহেচানা? আপ ভাঙ্গড় মে থা না ?”
আট বছর অন্তে চিকিৎসক জীবনে রোগীর ভিড়ে কাঊকে মনে রাখা সত্যিই একপ্রকার অসম্ভব। কিন্তু রোগীর মুখে সেদিনের ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা ও পরিশেষে “জান বাঁচানেকে লিয়ে শুক্রিয়া” আমার কানে মধু ঢেলেছিল। সত্যিই বোধহয় দিনান্তিকে এই-ই আমাদের প্রাপ্তি। পরিষেবা ক্লান্ত নিদ্রাহীন শরীরে এই-ই আমাদের পরিতৃপ্তি।
তোমরা থেকো নিদ্রাভরে,
জেগে মোরা রইবো।
দিনের শেষে ভালোবেসো,,
তোমার ব্যথা সইবো।