সম্প্রতি একটি সরকারি বিজ্ঞাপনে অমিতাভ বচ্চনকে দেশের প্রতিটি শিশুর প্রথম হাজার দিনের যত্ন নেওয়ার উপদেশ দিতে দেখা গিয়েছে । গর্ভাবস্থা থেকে প্রথম হাজার দিন পর্যন্ত বিশেষ কিছু পদ্ধতিতে শিশুর যত্ন নেওয়ার এই তত্ত্বের জনক ডা অরুণ সিংহ। তিনি গত চার-পাঁচ বছর ধরে প্রচলিত পথে প্রসবের পরিবর্তে সাবেক দাইদের পদ্ধতিতে প্রসব করানাের পক্ষে সওয়াল করে আসছিলেন । তাঁর লেখা বই ‘জার্নি অফ দি ফার্স্ট থাউজেন্ড ডেজঃ ফাউন্ডেশন ফর আ ব্রাইটার ফিউচার’ প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক । এবং এই বইয়ে লেখা পদ্ধতি মেনে তা বাস্তবায়নের জন্য রাজ্যের স্বাস্থ্যদপ্তরগুলিতে নির্দেশিকাও পাঠানো হয়েছে।
ডা অরুণ সিংহ সম্পর্কে একদা রাজ্যের প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছিলেন– অরুণ সিংহের মত ডাক্তার যদি এ রাজ্যে আরও কয়েকজন থাকতেন তবে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাল বদলে যেত। বিশিষ্ট এই চিকিৎসক দীর্ঘদিন এ রাজ্যের একাধিক মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তিনি ভারত সরকারের রাষ্ট্রীয় বাল স্বাস্থ্য কার্যক্রমের প্রধান পরামর্শ দাতা । তাঁর সঙ্গে কথা বললেন পিয়ালী দে বিশ্বাস প্রসবের এই নতুন পদ্ধতির বিষয়ে ।
প্রশ্নঃ আপনি তাে গত চার পাঁচ বছর ধরেই প্রসবের প্রচলিত পদ্ধতির বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলে আসছেন । আপনার মতে কি ভাবে প্রসব হওয়া উচিত ?
উত্তরঃ বর্তমানে চিকিৎসকরা প্রসবের পরে গর্ভফুল বেরােনোর আগেই শিশুর নাড়ি কেটে ফেলেন । আমার অভিজ্ঞতা হল, প্রসবের পরে গর্ভফুল বেরােনাের পর নাড়ি কাটলে শিশুর রক্তাল্পতা হওয়ার সম্ভাবনা কমে । আমাদের দীর্ঘ গবেষণায় এটা প্রমাণিত যে এই পদ্ধতিতে প্রসব হলে প্রতি মিনিটে প্রায় ১০ শতাংশ বেশি অক্সিজেন যাচ্ছে শিশুর শরীরে । অক্সিজেন গেলে শিশুর মস্তিস্কের বিকাশ ভাল করে হয় । সেই কারণেই আগেকার দিনের দাইদের পদ্ধতি মেনে গর্ভফুল বেরােনাের পরই শিশুর নাড়ি কাটা উচিত ।
প্রশ্নঃ কেন আপনি দেরিতে নাড়ি কাটার কথা বলছেন?
উত্তরঃ কখন নবজাতকের নাড়িতে ক্ল্যাম্প করা হবে বা নাড়ি কাটা হবে তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। আমাদের দেশে সাধারণভাবে নবজাতক প্রসবের পরপরই নাড়ি কাটা হয়। কিন্তু এখনো বেশ কিছু আদিবাসী গোষ্ঠী সন্তান প্রসবের পর গর্ভফুল বেরিয়ে আসার পরে নাড়ী কাটেন।ইতিহাসে দেখা যায় প্রাচীন গ্রীক দাইরা গর্ভফুল বার হওয়ার পর নাড়ি কাটতেন । সপ্তদশ শতকের সময় থেকে যখন সম্ভবত পুরুষরা ধাত্রীবিদ হিসেবে কাজ শুরু করলেন তখন থেকেই শিশু প্রসবের সঙ্গে সঙ্গে নাড়ি কাটা প্রচলন শুরু হল। সম্ভবত ডাক্তারদের হাতে কম সময় থাকার জন্য এই পদ্ধতির প্রচলন হয়েছিল। এর পেছনে যুক্তি হিসেবে বলা হতে লাগলো এই পদ্ধতিতে নাকি মায়ের সুবিধা আর শিশুর কোনো অসুবিধা হয় না কিন্তু এই পদ্ধতির পেছনে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ও ছিলনা।
প্রশ্নঃ আপনারা পরীক্ষায় কি পেয়েছেন যাতে আপনি পরে নাড়ি কাটার কথা বলছেন?
উত্তরঃ বেশ কয়েক বছর হল প্রচলিত পদ্ধতির বিরুদ্ধে মত আসতে থাকে। সন্তান জন্মের 30 থেকে 60 সেকেন্ড পর নাড়ি কাটা ও নাড়ির স্পন্দন বন্ধ হওয়ার পরে নাড়ি কাটার পক্ষে বলতে থাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং কিছু ধাত্রীবিদ্যাসংস্থা। এর প্রমাণ হিসেবে ডপলার আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষা করে দেখা গেছে নাড়ির স্পন্দন থামার পরেও তার মধ্যেকার ধমনী ও শিরায় রক্ত প্রবাহিত হতে থাকে।
প্রশ্নঃ তাহলে আপনি বলছেন অপ্রশিক্ষিত দাইদের পদ্ধতিই ঠিক ছিল চিকিৎসকদের পদ্ধতি নয় ?
উত্তরঃ আগে হাসপাতাল ছিল না। বাড়িতেই শিশুর জন্ম হত, এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে প্রাকৃতিক পদ্ধতি মেনে দাইয়েরা সফল ভাবে প্রসব করাতেন। আঠারােশ শতাব্দীর পর দেখা গেল চিকিৎসকরা, প্রধানত পুরুষ চিকিৎসকরা প্রসব করাতে আসছেন । কিন্তু একজন চিকিৎসকের পক্ষে অনেক সময় ধরে একজন প্রসূতিকে সময় দেওয়াটা সমস্যার, অর্থনৈতিক কারণেই। আমার ধারণা সময় কম লাগে বলে গর্ভফুল বেরােনাের জন্য অপেক্ষা না করেই নাড়ি কাটার নিয়ম শুরু করা হয় ।
প্রশ্নঃ আপনি বললেন, দাইরা প্রাকৃতিক পদ্ধতি মেনে প্রসব করাতেন। প্রাকৃতিক পদ্ধতি বলতে আপনি কি বোঝাচ্ছেন?
উত্তরঃ শিম্পাঞ্জি, ওরাংওটাং অর্থাৎ হােমোসেপিয়েন্স গােত্রের কোনও প্রাণীই এমন সােজা ভাবে শুয়ে প্রসব করে না। একমাত্র মানুষেরাই চিত হয়ে শুয়ে লিথােটমি অবস্থানে শিশুর জন্ম দেয়। আমি মনে করি এই পদ্ধতি অনেকটাই প্রকৃতিবিরোধী। এই পদ্ধতির পরিবর্তন করে প্রসবের জন্য একটু অন্যরকম পরিবেশ তৈরি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি আমরা । সাধারণ ভাবে প্রসবের আগে চিকিৎসকেরা প্রসূতিকে লেবার টেবিলে শুইয়ে দিয়ে নীচের দিকে পুস করার অর্থাৎ চাপ দেওয়ার নির্দেশ দেন । আমরা লেবার রুমে যে পরিবর্তন করার কথা বলেছি তাতে মায়ের উপর তেমন কোন বিধি-নিষেধ চাপানো হয় না। মা নিজের পছন্দ মত যে কোন অবস্থানে শিশুর জন্ম দিতে পারেন। চার হাত পায়ে ভর দিয়ে, হাটু মুড়ে বসে, চিৎ হয়ে বা কাত হয়ে শুয়ে । প্রসবের সুবিধার জন্য মাকে প্রয়োজনমতো জিম বল বা দড়ির সিঁড়িতে ভর দিতে বলা হয়। প্রসবের আগে মায়ের কোমরে হালকা মালিশ করে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে মায়ের মন ভালো রাখতে প্রসবের সময় মায়ের পছন্দের হালকা গান চালানো হয়। অর্থাৎ যাতে প্রসবের সময় মা স্বস্তিতে থাকেন। এরপর প্রসব ব্যথা শুরু হলে মায়ের সুবিধামতো পজিশনে তাকে রাখা হয়।
প্রসবের সময় শিশুর মাথা বেরিয়ে আসে প্রথমে। শিশু নতুন জগতে পাড়ি দেয় একেবারে স্কুবা ডাইভারের মত। তার পিঠে অক্সিজেন সিলিন্ডার–গর্ভফুল। নবজাতক মুখ খুলে তার নতুন ফুসফুসের সাহায্যে শ্বাস নেওয়া শুরু করে। পরিপূরক হিসেবে মায়ের রক্তের অক্সিজেন আসে নাড়ি দিয়ে। শিশু এবার মায়ের পেট থেকে এগিয়ে চলে সামনের দিকে। স্তনবৃন্তে শিশু মুখ ছোয়ালে মায়ের শরীরে আপনা থেকেই অক্সিটোসিন নিঃসৃত হয়, যা প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ কমায় এবং জরায়ুকে সংকুচিত করে স্বাভাবিকভাবে গর্ভফুলকে বাইরে ঠেলে দেয়।
প্রশ্নঃ জন্মের পর শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারে কিছু বলবেন?
উত্তরঃ জন্মের ঠিক পরেই মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো বাচ্চার প্রথম টিকাকরণ। রোগ জীবাণু নিবারণকারী অ্যান্টিবডি মায়ের শরীর থেকে বাচ্চার শরীরে যায়। জন্মের পরে জন্মের বুকের দুধ খাওয়ালে এবং তারপরে ছয় মাস পর্যন্ত শিশুকে কেবল মায়ের বুকের দুধ খাওয়ালে পাঁচ বছরের কম বেশি কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হার 21 শতাংশ কমে যায় । মায়ের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি কমে, শিশুর স্নায়বিক রোগ হওয়ার প্রবণতা কমে।
প্রশ্নঃ আপনি কিভাবে এই নতুন তত্ত্ব নিয়ে পরীক্ষা করে সরকারকে বোঝাতে পারলেন?
উত্তরঃ 2018-এ এক বছর ধরে মহারাষ্ট্রের সীমান্তবর্তী গুজরাতের প্রান্তিক এলাকা ধরমপুরের শ্রী রামচন্দ্র হাসপাতাল ও কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে গবেষণা চালিয়ে আমরা দেখেছি যে প্রসবের সময় এই সাবেকি পদ্ধতি অবলম্বন করার ফলে মা ও শিশুর শরীরে রক্তাল্পতা সহ অনেকগুলো জটিলতা কম হচ্ছে এবং এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে শিশুর মানসিক ও বৌদ্ধিক বিকাশে । 2018 ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত চার মাস ধরে কলকাতা ও ধরমপুরের হাসপাতালে সাবেক পদ্ধতিতে প্রসব করানো শুরু হয়। তবে কলকাতার তুলনায় গুজরাতে ভালো ফল পাওয়া গেছিল, কারণ ধরমপুর 100% আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল হওয়ায় সেখানে স্বাভাবিক প্রসব বেশি হয়,সে তুলনায় কলকাতায় সিজারিয়ান পদ্ধতিতে অনেক বেশি প্রসব করানো হয়। আমেরিকান জার্নাল অব নিওনেটোললজিতে এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। তারপর সরকারকে বোঝানোর পালা। শুরুতে বাধার সম্মুখীন হতে হলেও শেষ অবধি দু’জন সরকারি স্বাস্থ্য আধিকারিকের উদ্যোগ কেন্দ্রীয় সরকার আমাদের তত্ত্বটি প্রয়োগের জন্য গ্রহণ করেছে।
প্রশ্নঃ প্রথম হাজার দিন বলতে কি বোঝাচ্ছেন?
উত্তরঃ প্রথম হাজার দিন মানে শিশুর জীবনে মায়ের গর্ভে থাকার সময়কার নয় মাস এবং জীবনের প্রথম দুই বছর। শিশুর শারীরিক এবং বৌদ্ধিক বিকাশের ক্ষেত্রে এই সময় যত্ন নেওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম।
প্রশ্নঃ প্রসবের পদ্ধতিতে নাকি লুকিয়ে থাকে শিশুর মেধা বা বুদ্ধির বিকাশে চাবিকাঠি?
উত্তরঃ হ্যাঁ। কৃত্রিম ভাবে সময়ের আগে সিজার করে শিশুর জন্ম দিলে মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্তুগুলোর পরিপূর্ণ বিকাশ হয় না। সময়ের আগে জন্মানো শিশুদের মধ্যে অটিজম ও অন্যান্য মানসিক সমস্যা বেশি দেখা যায়। তাই একান্ত প্রয়োজন ছাড়া প্রকৃতির ওপর কারিকুরি না দেখানোই ভালো।
স্যার আমি আপনার মস্তিস্ক প্রসূত rbsk প্রোগ্রাম এর এক সাধারণ কর্মী.আপনার নাম অনেক শুনেছি.আজ আপনার ছবি দেখলাম লেখা পড়লাম.লেখা সম্মন্ধে বলা আমার দ্বারা মানায় না.অনেক অনেক ধন্যবাদ স্যার
আজকাল ত বেশিরভাগ C-section, সেখানে placenta বেরনোর পরে clamping: এটা কিভাবে সম্ভব বোঝাতে পারেন?
এর আগেও আপনার নাম শুনেছি। sskm এ থাকাকালীন। ডঃ বিশ্বনাথ মুখার্জীর(Ped Surgeon) কাছ থেকে। Covid এ আপনার বক্তব্য ভিডিও তে শুনে, অভিভূত। আপনার bsnl নাম্বার এ sms ও করে ছিলাম কিন্তু sms যাচ্ছে না। অসাধারন বক্তব্যে রাখছেন। ইতিহাস ও সমাজ দুটির ই স্বচ্ছ ধারণা পেতে পারি। ভালো থাকবেন।