বছর ছয়েক আগে থিয়েটারের কাজে বার্মিংহামে অর্ধমাসেরও বেশি থাকতে হয়েছিল। এর আগেও বার্মিংহাম গিয়েছি ওখানকার নাট্যসংস্থার দ্বারা আমন্ত্রিত হয়ে৷ কিন্তু দ্বিতীয়বার বেশিদিন থাকার ফলে সেখানকার ভারতীয় ছাত্রদের সঙ্গে মেশবার সুযোগ পেয়েছি অনেক বেশি৷ মিশতে ভীষণভাবে চাইছিলামও৷ বারবার দেখতে চাইছিলাম –বিদ্যাশিক্ষাকে ওঁরা কতটা পেশাঅর্জন আর কতটা আনন্দ উপভোগের মাধ্যম হিসেবে দেখে৷ কোন দেখাটা তুল্যমূল্যভাবে বেশি৷ যে বিষয়টি আমার সবার আগে ও সবচেয়ে নজরে পড়ে, তা হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পঠনব্যবস্থা ও প্রায় প্রতিটি বিভাগে ছাত্রছাত্রীদের নিজস্ব একটি থিয়েটার ইউনিট৷ এক রবিবারের ভীষণ এক ভোরে একটি ছাত্রীকে দেখলাম, পিঠের ওপর বইয়ের পেটিকা নিয়ে স্নানে ভেজা চুল নিয়ে প্রায় দৌড়াচ্ছেন অক্সফোর্ডের ট্রেন ধরতে৷ জিজ্ঞেস করলাম, রবিবার এমন অলস ভোরে কীসের এত পড়া রে? আজ — থেকেই যা আমার সাথে৷ মিষ্টি হাসি দিয়ে উত্তর এল —এখানে মাসের তিরিশ দিন চব্বিশ ঘন্টা ডিপার্টমেন্টাল লাইব্রেরি খোলা৷ অবাক হলাম৷ লোভীর মত জিজ্ঞেস করলাম — ভোর রাতে পড়তে ইচ্ছে হয় কারোর? উত্তর –ওই সময়ই তো বেশি পড়তে ভালো লাগে৷ চারদিক কুল আন্টি! গাছপালা চুপ –মানুষও চুপ৷ ওই সময়েই তো বইয়ে মন লাগে বেশি৷
ওই সামান্য কথালাপে মনে হয়েছিল, পাঠ্যবই পড়ায় এত আনন্দ এদের, বোধহয় নিজেদের পছন্দমত সময়ে পড়তে পায় বলে ৷ ঘাড়ের ওপর সময় শ্বাস ফেলে না ৷ পাঠ্যে প্রানের আনন্দ থাকে ৷ এই আনন্দ বাহিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্রিয় উদ্যোগে এঁদের পাঠ্যবহির্ভূত শিল্পচর্চায়ও ৷ শিল্পের চর্চায় এঁরা যে কী সাধক তা না দেখলে কল্পনাও করতে পারবেন না ৷ বই ও বইয়ের বাইরে অনন্ত প্রকৃতিতে এঁরা যে সমান সমান শ্রম ও সমান মেধা দেন তা বুঝেছিলাম এঁদেরই একটি পরীক্ষামূলক থিয়েটার দেখে ৷ দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল –পাঠ্য অপাঠ্যের চাপিয়ে দেয়া দেয়ালটা ক্রমেই দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন এই বিশ্বচরাচরেরই একদল ছাত্র ৷ সে গল্প আরেকসময় ৷
আপাতত আমাদের মহান দেশ ভারতবর্ষে মাত্র আধঘন্টা আগে দেখা একটা ঘটনা বলে লেখাটা শেষ করব৷ স্কুলে আসছি৷ ইচ্ছে করেই গলিগলি পথ ধরেছি –যাতে আসাযাওয়ার পথের মাঝে রাস্তার ধারের বাড়িগুলোতে ছোট বাচ্চাগুলোর কাণ্ড দেখতে পাই৷ আমার এহেন পাগলামিতে আমিও জেরবার –আমার টার্গেট শিশুও হেসে কুটোপাটি৷ ফলে অচেনা শিশু দেখা –চোখ দিয়ে খানিক তাদের সঙ্গে মজা করা আমার নেশা হয়ে গিয়েছে৷ আজ দেখলাম –রোদ ভরা বারান্দায় মা বাচ্চাকে লেখাচ্ছেন –lip অর্থাৎ ঠোঁট৷ আর বাচ্চা সব বুঝতে পেরেও ফিকফিক হাসছে আর লিখছে –leaf অর্থাৎ পাতা৷ চোখের সামনে মারে মারে পিঠ লাল হল৷ রেলিংয়ের এপার থেকে যতদূর সম্ভব অশৈল্পিক গালাগাল দিতে শুরু করেছি৷ হঠাৎ হনু লাফ৷ হনুমানের মতো লাফ দিয়ে বাচ্চা এসে দাঁড়ালে দাওয়ায়৷ দাওয়ায় গজানো গাছের একটি পাতা তুলে নিজের ঠোঁটের দুপাশে মেলে ধরে সে বললে –এই তো পাতার lip. কী আশ্চর্য –গাছের পাতাটার ওপরের মাঝের অংশ ঠিক মানুষের ঠোঁটের মতোই বাঁকানো৷ আমার সামনে এখন দুই জোড়া ঠোঁট৷ একজোড়া লাল –সেটা এক মানবকন্যের৷ আরেকজোড়া সবুজ –সেটা?
মার খাওয়া পিঠে লাফাতে লাফাতে মানবসন্তান বললে –ও দুটো আমার বন্ধু গাছের মেয়ের৷ তার নাম leaf৷
ঝলমলে রোদ অবশ্য দুজোড়া ঠোঁটেই সমান খেলছে৷ রোদ মনের আনন্দে আলো ঝরাবার কাজ করে৷ জীবের তফাৎ সে করে না৷