আমি যেহেতু একজন চিকিৎসক তাই আমাকে আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের বৈশিষ্ট ও ক্ষমতা সবসময় অবাক করে। তিনি একজন বিজ্ঞানী হোন বা শিল্পী, কবি হোন বা লেখক কিংবা নিদেনপক্ষে আমার আপনার মত একজন সাধারণ মানুষ সকলেই এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই তাদের সব সৃষ্টিকর্ম করে চলেছেন। যোগী বলছেন এইসব ইন্দ্রিয়ের মোহ ত্যাগ করে বৈরাগী হতে। এ জগত মায়াপ্রপঞ্চময়। এই মায়া থেকে মুক্তিলাভ করে ঈশ্বরের জগতে পৌঁছতে হলে জিতেন্দ্রিয় হতে হবে। কবি বলছেন, ‘বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি সে আমার নয়। অসংখ্য বন্ধন-মাঝে মহানন্দময়/ লভিব মুক্তির স্বাদ। … ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করি যোগাসনে সে নহে আমার’।
ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করে যোগাসনে বসে অন্তরের দ্বার উন্মুক্ত করে দেবার যে কথা যোগী বলেছেন আমার কাছে তাও একরকম ইন্দ্রিয়ের চর্চা। ধ্যানের মাধ্যমে জ্ঞানী লাভ করেন অন্তর্দৃষ্টি। ভিসন। এও একরকম দৃষ্টি। আমি বহিরঙ্গের সাথে অন্তরঙ্গের এই দৃষ্টিকে আলাদা করতে পারি না। আমার মতে দুইই সত্য। দুইই অভ্রান্ত। আমার কিছু অন্ধ রুগি আছেন। যারা অনেকদিন আমাকে দেখাচ্ছেন। তাদের দেখে তাদের দুর্ভাগ্যের প্রতি আমার করুণা হয়। নিজেকে অসম্ভব ভাগ্যবান মনে হয় যে প্রকৃতির দেয়া এই অপূর্ব অনুভূতি থেকে আমি বঞ্চিত হই নি। আমি শব্দ, ঘ্রাণ নিয়ে ভীষণ উত্তেজিত থাকি। পরে নিশ্চই আপনাদের সাথে সেসব নিয়ে আমার অনুভূতি ভাগ করে নেব, কিন্তু আমার সবসময় মনে হয় এই দৃষ্টির অনুভূতি অতুল। অন্য চারটির সাথে এর কোনো তুলনাই হতে পারে না।
আগেই যেমন বললাম এই বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গের দৃষ্টি দুটিকেই আমার একই বলে মনে হয়, মনে হয় একই আধুলির দুটো পিঠ মাত্র- তেমনি কখনও কখনও শব্দকেও আমার দৃষ্টির প্রতিরূপ বলে মনে হয়। আমাদের প্রকৃতিতেও এমন উদাহরণ আছে। আমার এক বন্ধু আছে যিনি লেখক ও খুব সুন্দর বেহালা বাজান। সে এক জায়গায় বলেছিল, ভগবান আমার দৃষ্টি শক্তি কেড়ে নিলেও আমার শ্রবণ ক্ষমতা যেন দীর্ঘদিন আমার সাথে রাখেন। আমি কানে শুনে সঙ্গীতের মিড়, নোটেশন যেন বুঝতে পারি। আমি কিন্তু এমন জানি যে এই সঙ্গীত আস্বাদনের এই তীব্র ক্ষমতাও এক অর্থে অর্জিত দৃষ্টি।
অসামান্য গণিত প্রতিভা রামানুজনের কথা আপনারা সকলেই জানেন। রামানুজন ইংল্যান্ডের ঠান্ডায় কাহিল হয়ে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছেন হাসপাতালে। তার মেন্টর তখনকার দিনের আরেক বিখ্যাত গণিত প্রতিভা হার্ডি তাকে দেখতে এসেছেন। হার্ডি তাকে বললেন, তিনি যে ট্যাক্সিতে এসেছেন তার নম্বরটি ভীষণ বোরিং। 1729। রামানুজন সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন, না হার্ডি সংখ্যাটা মোটেই বোরিং নয়। এটা হল সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম সংখ্যা যাকে দুইভাবে দুইজোড়া বিভিন্ন সংখ্যার কিউবের যোগফলরূপে প্রকাশ করা যায়। যেমন, (1³ + 12³ = 1 + 1,728 = 1,729), (9³ + 10³ = 729 + 1,000 = 1,729)। এর পর থেকে গণিতজ্ঞরা এই 1729 সংখ্যাটিকে ‘রামানুজন-হার্ডি সংখ্যা’ বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন।
জীবনের শেষদিকে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে রামানুজন হার্ডিকে তার শেষ চিঠি লেখেন। যেখানে তিনি তাকে একটা নম্বরের ধাঁধাঁ পাঠান। ১৯২০ সালে পাঠানো সেই ধাঁধাঁ গণিতজ্ঞরা অনুধাবন করেছেন ২০০২ সালে। রামানুজন বলেছিলেন, সেই সংখ্যার ধাঁধাঁ স্বপ্নে তিনি দেখেছেন। পাঠিয়েছেন তার আরাধ্য দেবতা। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন সেই ধাঁধাঁয় তিনি যে থিটা ফাংশন ব্যাখ্যা করেছেন তা দিয়ে স্ট্রিং থিওরি বা ব্ল্যাক হোলের তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে। আজ থেকে নব্বই বছর আগে এক জিনিয়াসের স্বপ্নে দেখা কিছু সংখ্যা, যেসময় স্ট্রিং থিওরি বা ব্ল্যাক হোলের কথাও কেউ শোনে নি, অর্থপূর্ণ হতে প্রায় একযুগ সময় লেগে গেল। আপনি এই দৃষ্টিকে কী বলবেন? এ অন্তর্দৃষ্টি। আরও সঠিকভাবে বললে এ স্বপ্নের দৃষ্টি- তাই অবধারিতভাবে অর্থহীন। আজ যখন এই দৃষ্টি বিজ্ঞান্সম্মত রূপ পেল তখন তাকে আপনার অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে না। এই অন্তরঙ্গের দৃষ্টি আমাদের কাছে বহিরঙ্গের দৃষ্টিতে প্রতিভাত হচ্ছে। আমাদের বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয় যে যখন হার্ডি এসে তার গাড়ির নম্বর রামানুজনকে বলেছিলেন সঙ্গে সঙ্গেই সেই সংখ্যাটির বিশেষ ধর্ম তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল।
কেউ কেউ এমন দেখতে পান। এই দৃষ্টি বাইরের ও ভেতরের উভয়ের পক্ষেই সত্যি।
আপনারা কেউ কেউ হয়ত অলিভার স্যাক্সের নাম শুনে থাকবেন। উনি একজন জনপ্রিয় লেখক। পেশায় তিনি একজন স্বনামধন্য নিউরোলজিস্ট। তার নিউরোলজির বিভিন্ন অদ্ভুত কেসগুলোকে নিয়ে তিনি অনেক বই লিখেছেন। তার এমনই একটি জনপ্রিয় বইয়ের নাম “দ্য ম্যান হু মিসটুক হিজ ওয়াইফ ফর আ হ্যাট”।
সেই বইটিতে অনেক আকর্ষণীয় কেসের মধ্যে শেষে যেটি আছে তার নাম “দ্য টুইন্স”। সেই কেসটিতে দুইজন যমজ ছেলের কথা বলা আছে। তাদের নাম জন ও মাইকেল। দুজনেই অটিস্টিক। তাদের আই কিউ বা বুদ্ধিমত্তার মান মাত্র ৬০। দুজনে কোনো যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ সাধারণ গণিত সমাধান করতে অক্ষম। খেনো গলায় কথা বলে। নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে। বিভিন্ন রকম তাদের উদ্ভট ম্যানারিজম। যেমনটি কোনো অটিস্টিক বাচ্চাদের হয় আর কি! কিন্তু তাদের এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। এর জন্য তারা তখনকার দিনে সেলিব্রিটি হয়ে উঠেছিল।
প্রচুর রেডিও শো, টেলিভিশন শোতে তারা উপস্থিত হত। আপনি যদি তাদের যে কোনো বছরের কোনো তারিখ বলেন তারা সেদিন সপ্তাহের কী বার ছিল আপনাকে বলে দেবে। আক্ষরিক অর্থেই যে কোনো বছর। আপনি যদি জিজ্ঞাসা করেন ১৩৮৩ সালের ২২ শে নভেম্বর কি বার ছিল তারা সঙ্গে সঙ্গে বলে দেবে। ধরুন রবি কি বুধবার কি মঙ্গলবার। সঠিক বার যদিও আমি জানি না। এটা যে কোনো সাল হোক না কেন, হোক সেটা খ্রীষ্টপূর্বাব্দ বা ভবিষ্যতের কোনো তারিখ। তারা দুজনে এক মুহুর্তে একটু হাসবে, হেসে সেই বারটা বলে দেবে।
এই অসম্ভব ক্ষমতাটা তাদের রাতারাতি জনপ্রিয় করে দিয়েছিল। ভেবে দেখুন দুই যমজ অটিস্টিক ছেলে যারা পড়াশুনো দূরে থাক ভালো করে কথা বলতে পারে না তারা অবলীলায় এই সাঙ্ঘাতিক কাজটা মুহুর্তের মধ্যে করে দিচ্ছিল। এমন একটা ব্যাপার যেন এ তে অবাক হবার কী আছে? এ তো সাধারণ ব্যাপার।
এতেই কেবল অবাক হবেন না। আরো শুনুন। এইরকম কোনো ইন্টারভিউয়ের সময় কেউ যদি তাদের জন্মের চার বছর পর থেকে যে কোন দিনে কোনো বিশেষ কিছু ঘটেছিল কিনা জিজ্ঞাসা করেন, তাদের দুজনের চোখ একবার গোল হয়ে ঘুরবে তারপর নাকি গলায় জবাব দেবে সেদিনের আবহাওয়া কেমন ছিল? কোনো বিশেষ কিছু রাজনৈতিক বা অন্য কোনো খবর তারা তাদের বাবামায়ের কাছে শুনেছিল কিনা? কিংবা তাদের কেউ মেরেছিল বা তাদের শরীর খারাপ হয়েছিল বা তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কিনা- অবলীলায় তারা সেসব বলে দিতে পারত। যেন এইসব স্মৃতি তাদের কাছে ফোটোগ্রাফিক মেমরির মত জমে আছে। চোখকে একবার অক্ষিকোটরে ঘুরিয়ে নিয়ে তারা স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনছে।
সকলের কাছেই সেই ছেলেদুটি ছিল বিস্ময়ের। বিজ্ঞানীরা, চিকিৎসকেরা বোঝার চেষ্টা করতেন তাদের এই অভূতপূর্ব ক্ষমতার কারণ কি? অনেকেই বলেছিলেন এই সবগুলোই যেন একরকমের মানসিক অ্যালগরিদম। যদিও তাদের ক্ষেত্রে পুরোটাই ভীষণ রকমের অচেতনভাবে আসছে। তাই সেটা বিস্ময়ের। শ্রীনিবাস রামানুজনের কাছে সংখ্যারা, গণিতেরা যেভাবে আসত যেভাবে তিনি তাদের দেখতে পেতেন এরাও সেভাবেই পাচ্ছে। তাদের অচেতন মানসিক অ্যালগরিদমে। তারা যেহেতু অঙ্ক জানে না, অটিজমে আক্রান্ত তাই তাদের ক্ষেত্রে আমরা অবাক হয়ে যাচ্ছি। রামানুজনের ক্ষেত্রে আমরা হতবাক হলেও তাকে আমরা জিনিয়াস বলে জাস্টিফাই করেছি কিন্তু এই অটিস্টিক যমজ বাচ্চাদুটোকে আমরা কি বলব?
এ কোন অ্যালগরিদম যা মনের মধ্যে গড়ে ওঠে, চোখের সামনে ভেসে ওঠে আমাদের মত পন্ডিতেরা তার ধারেকাছেও পৌঁছতে পারি না? বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীদের মধ্যেও নাম্বার সেন্স বা সংখ্যার ধারণা থাকে। মৌমাছি বিশেষভাবে অন্যদের মধ্যে কোন ফুলে কত মধু আছে সেই ‘পরিমাণ বোধের’ সিগন্যাল দিতে পারে। মৌমাছি তার যে মধুর চাক তৈরি করে তার প্রকোষ্ঠগুলোর সবকটি সুষম ষড়ভুজ। এটিও একটি প্রাকৃতিক কোড। একাধিক ষড়ভুজ যদি পাশাপাশি থাকে তবে সবচেয়ে কম ক্ষেত্র নিয়ে সবচেয়ে বেশি স্থান দখল করা যায়। আপনি যদি সাবানের অনেকগুলো বুদবুদকে পরপর যুক্ত করেন ধীরে ধীরে তারা কয়েকটি সুষম ষড়ভুজ হয়ে যাবে। একে বলা যেতেই পারে ‘ইকোনমি অফ স্পেস’।
কিন্তু মৌমাছি জানল কিভাবে এই কথা? তাদেরও কি পুঞ্জাক্ষির সামনে কিছু ভেসে ওঠে? কোনো সংখ্যা কোনো গণিত চেতনা? আমরা জানি না। তেমনই জানি না জন আর মাইকেলের মাথার ভেতর কি চলে? তাদের এই ডকুমেন্টারি স্মৃতিরই বা উৎস কী? আমরা জানি না।
আমরা বহিরঙ্গের দৃষ্টিকেই জানি না অন্তরঙ্গের দৃষ্টিকে কোন যুক্তিকে অবহেলা করি বলুন?
(চলবে)