রোজ রোজ গান শোনাই। আজ একটু অসুর হয়ে ভয় দেখাই। ওই যে ছুঁচটা দেখছেন সাথে অ্যা বড় একটা সিরিঞ্জ। একটি বছর পঞ্চাশের বৃদ্ধা তখন আমাকে অসুরই ভাবে মশাই। বোন ম্যারো করতে গিয়ে হাড় ফুটো করে হাড়ের টুকরো বের করার পর লোকাল অ্যানাস্থেসিয়া চলে যাবার পর কোন রোগী আমাকে গাল না দিলে বুঝতে হবে আমার চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্য।
গোটা চিকিৎসক মহলে আমি খুব খুব ছোট্ট অসুর।
যে ছেলেটি প্রথম দিন রক্ত দেখে মাথা ঘুরে পড়ে গেছিলো, সে গাইনি ডাক্তার হয়ে রক্তের বন্যায় ভাসে রোজ। নেহাত দুবলা পাতলা ছেলেটি তালা খুলতে বেশী জোর দিতে পারতো না, সে দুটো ভাঙা হাড়কে টেনে, ঠুকে তার মধ্যে ইস্পাত পাত ভরে দেয়।আইসিইউ-তে গলার শিরা দিয়ে ছুঁচ ভরে স্যালাইন চালায় সামান্য অন্ধকারে ভয় পাওয়া কোন হাই পাওয়ার চশমা পরা তরুণী।
কয়েক সেকেন্ড এদিক ওদিকে জীবন আর মৃত্যু। প্রতিবার কোন পেশেন্টের শ্বাস নালীতে নল ঢোকানোর প্রক্রিয়ার যে স্নায়ু যুদ্ধ, স্নাইপার রাইফেল এ আরেক স্নাইপার বন্দুক ধরা মানুষকে ডাউন করার স্নায়ু যুদ্ধ তুলনীয় কেবল।
পেট কেটে বিষ্ঠা জমে ফুলে ওঠা নাড়িভুঁড়ি থেকে কেজি কেজি বিষ্ঠা বের করা, বোমায় উড়ে যাওয়া হাতের যত্ন নেওয়া, খুলি ফেটে ঘিলু দেখা যাচ্ছে এমন রোগীকে অপারেশন টেবিলে অসুর ছাড়া রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া মানুষ তুলবে?
জরায়ুর দশ কেজি টিউমার বের করে চেঞ্জ রুমে এসে সাইমা-র বিরিয়ানি অসুরই খোঁজ করতে পারে একমাত্র।
বস্তুত অসুর না হলে চিকিৎসক হওয়া যায় না। অসুররা আসলে সেই গোত্রের মানুষ যারা বিশাল খাটতে পারে, যারা ইস্পাতের ব্যবহার জেনেছিলো, সব থেকে বড় কথা যাদের হঠাৎই ভয়ানক মনের জোর আসে, যা সুস্থ মানুষের আসবে না।
মনের মধ্যে আসুরিক জোর না আসলে হার্ট বন্ধ হয়ে যাওয়া মানুষের বুকের ওপর চেপে হার্ট পাম্প করা যায় না।
বাচ্চা দেখলেই গাল টিপে আদর করতে যার ভালো লাগে মনের মধ্যে আসুরিক জোর না আসলে নবজাতকের হাতে চ্যানেল করতে পারে না।
দেবতাকে দেখতে পাচ্ছে এমন মানুষের আসলে দিনে কটা ওষুধের বড়ি দরকার এটা নিস্পৃহ ভাবে বলতে গেলে অসুর হতে হয়।
মুহূর্তের ভেতর হার্টের ছোট ছোট ধমনীতে নল ঢুকিয়ে নালা পরিষ্কার করে সেখানে নতুন নল লাগিয়ে দিলে আমরা বলি পাতি স্টেন্ট বসানো হয়েছে।
দিনের শেষে একটা বিষ্ঠা বহনকারী ম্যাথর আর ডাক্তারের মধ্যে পার্থক্যটা খুব কম। মিষ্টি কথা দরকার। কিন্তু মিষ্টি কথায় যেসব অসুখ সেরে যায় তা অসুখ না।
অসুখ সারাতে অসুর যেনো হতে পারি।
(We hold knife to heal not to kill)
পুনশ্চ: চিকিৎসা প্রত্যাখ্যান একটি ব্যক্তিগত অধিকার মানুষের। তার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা আছে আমার। Euthanasia গোটা পৃথিবীর একটি বিতর্কিত বিষয় যেখানে কোন একটি মানুষকে যখন পুরোটাই যন্ত্র নির্ভর বেঁচে থাকতে হয় তখন তার সেভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে স্বেচ্ছামৃত্যু দাবী জোরালো হয়।
ভারতীয় সংবিধানের আর্টিকেল 21 আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে আমাদের চিকিৎসা গ্রহণ এবং চিকিৎসা প্রত্যাখ্যানের। সেই জিনিসটা খুব কম মানুষ জানেন। সুস্থ মাথায় সেই প্রত্যাখ্যান অত সহজ না।
আইসিইউ-তে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের সারাদিনে প্রচুর এরকম অনুরোধ রাখতে হয়। Do not resuscitate এই কনসেন্ট নেওয়া মোটামোটি সব কর্পোরেট হাসপাতালেই চলে। এটা ওপেন সিক্রেট।
সত্যি এমন কনসেন্ট নেওয়া যায়? স্বেচ্ছামৃত্যু আইনি ভাবে স্বীকৃত না হলে চিকিৎসা প্রত্যাখ্যান একটি নির্দিষ্ট সীমানার পর কি করে স্বীকৃত হতে পারে?
যদিও এমারজেন্সী অবস্থায় কোন রোগীর এই চিকিৎসা প্রত্যাখানের ইচ্ছা কতটা গ্রাহ্য হতে পারে সেই নিয়েও কোর্ট চত্বরের টাইপিস্টরাও পাতার পর পাতা টাইপ করে গেছে ফুল স্পিডে। এমন কেসও দেখা গেছে যেখানে রোগীর কনসেন্ট না পাওয়ায় অপারেশন না করার জন্য রোগীর অবস্থা খারাপ হওয়ার জন্য ডাক্তার দায়ী হয়েছে।
বস্তুত এরকম অজস্র ইচ্ছাপত্র আইসিইউ-র পুরোনো ফাইলে থেকে যায়। রোগীর ইচ্ছা অনুযায়ী অনেক ক্ষেত্রে আর চিকিৎসা করা হয় না।
কোন ইচ্ছাপত্র এভাবে বাইরে প্রচারের আলোয় আসেনা।
প্রচারের আলোয় আসলেই প্রশংসা হবে। আবার বিতর্কও হবে।
স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার, চিকিৎসা প্রত্যাখ্যানের অধিকার এবং রোগীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে রোগীর চিকিৎসা। এই তিনটে বিরোধমূলক বিষয় নিয়ে ভাবতে ভাবতে কোর্টও হাল ছেড়ে দিয়েছে।
আমাদের হাল ছাড়লে চলবে না।