তোমাদের গ্রামে ঘরে তো সব রোগকেই “গ্যাস” হয়েছে বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। হার্ট অ্যাটাকের ব্যথাই হোক বা ব্রেনের স্ট্রোকই হোক সবই গ্যাসের ঠেলায় হচ্ছে বলে ভুঁইফোঁড় চিকিৎসকেরা আসল রোগনির্ণয়ে নিজেদের অপারগতা ঢাকা দিয়ে থাকেন। আর আসল রোগ না জেনেই গ্যাসের ঠেলায় বাঙ্গালী দক্ষিণের নামীদামী হাসপাতালে তথাকথিত “গ্যাসে”র চিকিৎসা করাতে যান। ওখানকার চিকিৎসকেরা বাঙ্গালীর এ ভ্রমের উৎপাতে আবডালে মুচকি হাসেন। বাঙ্গালী চিকিৎসক বন্ধুদের ফোন করে ঠাট্টা করে বলেন বাংলায় তো “গ্যাসের মহামারী” চলছে দেখছি।
রাতের খাওয়া শেষ করে শিশু চিকিৎসক প্রফেসর ডাঃ ঘোষ হাসপাতালের নিওনেটাল কেয়ার ইউনিটের রেস্ট রুমে কথাগুলো মুচকি হেসে বললেন হাউস ফিজিসিয়ান ডাঃ সৌম্যকে।
সৌম্য, গ্রামের গরীব বাড়ির মেধাবী ছেলে। প্রফেসরের বাধ্য স্টুডেন্ট। প্রফেসর বেরিয়ে যাবার পর আজ রাতে এক রত্তি শিশুদের কান্ডারী সৌম্য একা।
গভীর রাতে ব্লক হাসপাতাল থেকে যখন মাস চারেকের শিশুটি রেফার হয়ে ভরতি হলো তখনও ওয়ার্ডে ঘুরে ঘুরে ছোট্ট শিশুদের স্ট্যাটাস নোট করছিলো সৌম্য।
চার মাস আঠ দিনের শিশু। বারবার মিনিট দুয়েকের জন্য চোখ উল্টে শিরদাঁড়া বেঁকিয়ে কাঁদছিলো শিশুটি। কনুইয়ের কাছে শক্ত হাত। ঠিক যেমন ধনুষ্টংকারে হয়। মিনিট দুয়েক পরে রেহাই মিললেও ঘন্টায় ঘন্টায় একই ঘটনা। ব্লকের চিকিৎসক রেফারাল লেটারে মেনিনজাইটিস সন্দেহ করেছেন। রক্তের টেষ্ট অনুযায়ী ব্লাড সুগার নরমাল। কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট নরমাল। বিলিরুবিন নরমাল। ইউরিন রিপোর্টও প্রায় স্বাভাবিক। এমনকি ইনফেকশনের রিপোর্ট, সি.আর.পি.ও স্বাভাবিক।
রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে সৌম্য বুঝলো মেনিনজাইটিসের লক্ষণ থাকলেও মেনিনজাইটিস হবার সম্ভাবনা কম। ওপরের চোখের পাতা টেনে জন্ডিস হবার সম্ভাবনা প্রায় নাকচ করে অ্যান্টিরিওর ফন্টানেলিতে হাত দিয়ে দেখল, সব স্বাভাবিকই তো ঠেকছে। সাধারণত এ ধরনের চোখ উলটে শিরদাঁড়া বেঁকিয়ে কাঁদতে থাকা খিঁচুনি রোগের বহিঃপ্রকাশ। তাই ব্লক হাসপাতালে ফেনোবারবিটাল দেওয়া হয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ হয়েছে। কিন্তু কোনও উন্নতি হয়নি দেখে মেডিক্যাল কলেজে পাঠিয়েছেন উনারা।
কিচ্ছুটি মাথায় ঢুকছে না সৌম্যর। পুরো পিডিয়াট্রিক্স সাবজেক্টটাই যেন এক নিমেষে জট পাকিয়ে গেছে মাথার মধ্যে। প্রফেসর ঘোষকে ফোন করলো সৌম্য ।
প্রফেসর ঘোষ মিনিট কয়েকের মধ্যেই এসে পড়লেন।
ভালো করে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে সমস্ত রিফ্লেক্সেগুলো দেখে নিলেন একবার।তারপর ঘাড় বেঁকিয়ে শিশুর মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন – বাচ্চা খাচ্ছে কেমন??
এতক্ষণ শিশুটির মা অসহায় ভাবে তাকিয়ে থাকলেও প্রফেসরের কথায় সম্বিত ফিরে বললেন- এ ক’ দিন একদম খেতে পারছে না ডাক্তারবাবু। খাওয়ার পরপরই বমি করে দিচ্ছে। খুব অস্থির ভাব। থেকে থেকেই কেঁদে কেঁদে উঠছে। কান্নার আওয়াজটাও যেন দিন কে দিন কর্কশ হয়ে যাচ্ছে।
জ্বর ছিলো? জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর।
না, ডাক্তারবাবু।
প্রস্রাব করার সময় কান্না বা বারে বারে প্রস্রাব??
না, সেরকম তো কিছু ছিলো না।
ঘাড় নেড়ে প্রফেসর প্রেসক্রিপশনটা টেনে নিয়ে খসখস করে লিখলেন- স্যান্ডিফায়ার সিনড্রোম।
ডোমপেরিডোন ড্রপ আর র্যানিটিডিন সিরাপ লিখে বললেন এগুলোর সাথে সাইমেথিকোন ড্রপ দিবি প্রয়োজন হলে।
সৌম্যর দিকে প্রেসক্রিপশন এগিয়ে বললেন – কাল সকাল অবধি ভালো করে খেয়াল রাখিস। প্রয়োজন হলে আবার ডাকিস।
প্রফেসর চলে যাবার পর পিডিয়াট্রিক্সের বই উলটে স্যান্ডিফায়ার সিনড্রোম গোগ্রাসে গিলল সৌম্য।
গ্যাস্টো ইসোফেগাল রিফ্লাক্স ডিজিজ (জি ই আর ডি)-এর এক অবাঞ্চিত লক্ষণ। বাচ্চার খেতে না পারা ও বমি। পেটে ব্যথার জন্য কঁকিয়ে কান্না। পাকস্থলীর অ্যাসিড গলায় উঠে গলার স্বরের বিকৃতি ও কাশি। অস্থিরতা ভাব। মাস চারেক বয়েস থেকে দু বছর বয়স অবধি এ রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা। সব যেন ছবির মত ভেসে উঠলো সৌম্যর চোখে।
চিকিৎসা? প্রফেসর যা দিয়েছেন সবই যেনো বইয়ের পাতা দেখে লেখা।
সকালের রাউন্ডে প্রফেসরের চোখে শিশুটিকে দেখলো সৌম্য। এক্কেবারে স্বাভাবিক। যেন কিচ্ছুটি হয়নি।
প্রফেসরের প্রতি আরও শ্রদ্ধা বাড়লো সৌম্যর। মেনিনজাইটিসের লক্ষণ থাকলেও শুধুমাত্র অভিজ্ঞ চোখে এ রোগের নির্ণয়। মামুলি তার চিকিৎসা । জ্ঞান সমুদ্রে কতখানি সাঁতরালে এ বৈতরণী পার হওয়া যায়।
রাতজাগা ডিউটি শেষ। হঠাৎই শিশুর মা ঘিরে দাঁড়াল সৌম্যর পথ। ডাক্তারবাবু, আমাদের গ্রামের মদন ডাক্তার বলল – যা ওষুধ দেওয়া হয়েছে সবই তো গ্যাসের ওষুধ। মদনই কিন্তু প্রথম বলেছিল – গ্যাস মাথায় উঠে ঝামেলা পাকিয়েছে।
চমকে উঠলো সৌম্য। গতকালের কথাগুলো মনে পড়ে গেলো তার।
নিরুত্তর মুচকি হেসে হস্টেলের পথ ধরলো সে।