কোনো মহৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে গিয়ে কেউ মারা গেলে তাঁকে ‘শহিদ’ বলার চল। আমরা যারা পিতৃতন্ত্রের বিরোধিতা করি, ধর্ষণের বিরোধিতা করি, ভিক্টিম ব্লেমিং-এর বিরোধিতা করি, তাদের কাছে আপনি ‘শহিদ’, হে সুজেট! আমার কাছে তো বটেই। অন্য নারীবাদীদের কাছে কি নয়?
সুজেট, আপনি যখন ধর্ষিতা হন, তখন আমি অন্তঃসত্ত্বা। আর গৃহহিংসায় নির্যাতিতা। আপনার জন্য একটাও মিছিলে আমি হাঁটতে পারিনি, সেটা এখনও একটা আক্ষেপ। এক লাইন লিখতেও পারিনি৷ তখন আমি যা লিখি, যা ভাবি, তার কোনোকিছুর উপর নিজের ভরসা ছিল না। আপনাকে আমি কিছু দিতে পারিনি, আপনি আমায় অশেষ দিয়েছেন।
তখন জানতাম, একদিন আমি বিবাহবিচ্ছিন্ন হব। কোনো একদিন। আমি যখন বিবাহবিচ্ছিন্ন হব, তখন আমার ধর্ষণ হলে সংবাদপত্র বলবে, ‘একটা ডিভোর্সী নষ্ট মেয়ে’, তা আমি বুঝছিলাম। বুঝতে পারছিলাম, সিংগল মাদারের ক্লান্ত লাগে অথচ তার নিজের মতো অবসর কাটানোয় বিধিনিষেধ আছে। সব বুঝছিলাম আপনাকে দেখে আটাশ বছরের আমি। তৈরি হচ্ছিলাম মনে মনে। নাটকীয় ভাবে পিছন ফিরিয়ে আপনাকে বসানো হত চ্যানেলের স্টুডিওতে, তাও আবার অন্ধকারে।
তারপর আপনি একদিন ঘুরে বসলেন। আলো এসে পড়ল রুক্ষ্ম মুখে, অবাধ্য কোঁকড়া চুলে। সেদিন রাষ্ট্রের ধর্ষিতাকে দেখার চোখ কি যে ধাক্কা খেল! সেই রাষ্ট্রব্যবস্থা, যার মুখ্যমন্ত্রী আপনাকে ‘মন্দ মেয়ে’ ঘোষণা করেছিলেন! স্রেফ ঘুরে বসে আপনি ঘোষণা করলেন, আপনি লজ্জিত নন। লজ্জা ওদের, ধর্ষকদের। সে এক ব্রাহ্ম মুহূর্ত! আপনি শুধু ঘুরে বসে ঘোষণা করেছিলেন, নিজের পাশে নিজেকে দাঁড়াতে হয়। আরও বার্তা দিয়েছিলেন, পাব-এ যাওয়া ‘খারাপ মেয়ে’-র, বিবাহবিচ্ছিন্না সিংগল মাদার ‘খারাপ মেয়ে’-র আলবাৎ ন্যায় চাওয়ার অধিকার আছে।
২০২৪ সালের অগাস্টে যখন রাজ্য আন্দোলিত হল এক ‘ভালো মেয়ে’-র ধর্ষণ ও মৃত্যু ঘিরে, তখন ‘খারাপ মেয়ে’ সুজেটকে আমি মিছিলে কতবার পাশে কামনা করেছি! বারবার প্রশ্ন করেছি, অভয়া ধর্ষিত ও খুন হয়েছে, এটুকু কেন যথেষ্ট নয়? কেন তার ডাক্তার হওয়া, মেধাবী হওয়া, এবং (হাইপোথেটিকালি) ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী’ হওয়া জরুরি? প্রতিজন নির্যাতিতা আমাদের ঘরের মেয়ে, স্নেহের ধন নয় কেন?
আপনি নিপীড়িতা থেকে উত্তীর্ণা, উত্তীর্ণা থেকে আন্দোলক হয়ে উঠছিলেন। মানসিক-শারীরিক কী কী চাপ সহ্য করতে হয়েছে, কল্পনা করতে পারি৷ নাহলে আজ মিছিলে থাকতেন।
হয়ত অবচেতনে কারও কারও পেরে যাওয়া অন্যদেরও উৎসাহিত করে। হয়ত আপনি যে পেরেছিলেন ঘুরে দাঁড়াতে, তার একটা সামান্য প্রভাব আমার ঘর ভাঙতে পারাতেও পড়েছিল!
যখন নিজের ভাবনায়, নিজের লেখায়, আস্থা ফিরেছিল, তখন আপনার কথা অনেকবার লিখেছি। আজও ছাত্রীসমাদের বলি, ‘ভাল মানুষ’ হও, কিন্তু ‘ভাল মেয়ে’ হবে না। ‘খারাপ মেয়ে’ হতে গেলে মদ খাওয়া বাধ্যতামূলক নয়। সমাজনির্মিত লিঙ্গভূমিকার গণ্ডি টপকানো মেয়ে মাত্রই ‘খারাপ মেয়ে’, নিজের হক বুঝে নেওয়া মেয়ে মাত্রই ‘খারাপ মেয়ে’, ধর্ষিতা হলেও মুখ যে লুকোয় না, সে ‘খারাপ মেয়ে।’ সেই ‘খারাপ মেয়ে’ হওয়াটা যে জরুরি, মায়েরা যেন মেয়েদের, শিক্ষক যেন মেয়ে বা প্রান্ত লিঙ্গযৌনতার পড়ুয়াদের তা শিখিয়ে যান।
একটা অসংবেদনশীল, ভিক্টিম-ব্লেমার, অপরাধীকে-পালাতে-সাহায্য-করা রাষ্ট্রব্যবস্থা আপনাকে শরীরে-মনে ক্ষয়প্রাপ্ত করে মেরে ফেলেছিল। আপনি লড়েছিলেন। ২০১২ থেকে ২০১৫ আপনি নিরন্তর লড়াই করেছিলেন নিজের জন্য, অন্যদের জন্য। তাই, হে শহিদ সুজেট, আপনি অমরত্ব লাভ করেছেন! আজ শাহাদত দিবস।
🙏🙏🙏 অপূর্ব