তক্তপোশের উপর গুটোনো তেলচিটে শতরঞ্চি মোড়া ছেঁড়া তোশকে হেলান দিয়ে লোকটা, গরাদে দেওয়া জানলার বাইরে চায়। কাছের জিনিস দেখতে অসুবিধে হতো আগেই— এখন দূরের জিনিসও অস্পষ্ট লাগে চোখে। তবুও ও জানে, সামনের ফ্ল্যাটবাড়ির পাশের একচিলতে আমগাছে এখন মুকুল এসেছে। ফাটা আধময়লা কাপটায়, দুধ ছাড়া চায়ের তলানিটা গলায় ঢালতে ঢালতে চোখ পড়ে মেঝেতে। ওটা কি পড়ে আছে, গোলাপি রঙের তুলোর বলের মতো?
লোকটা ওঠে। কাছে গিয়ে দেখে, চড়াইপাখির ছানা। এখনো চোখ ফোটেনি। পড়ে গেছে বুঝি কখন ঘুলঘুলি থেকে।
পায়াভাঙা টুলটা সাবধানে তক্তপোশের উপরে তোলে লোকটা। তারপর যত্নে কুড়িয়ে নেয় ছানাটাকে। হাঁচোড় পাঁচোড় করে টুলে ওঠে। পাখির বাচ্চাটাকে ফিরিয়ে দিতে হবে তো মায়ের কাছে। আহা, কচি ছানা একেবারে।
টুলটা নড়বড় করে। ঘুলঘুলির নাগাল পেতে চাওয়া লোকটার আঙুলগুলো ভাবে— ইস্, টুলটা ধরে থাকার জন্য যদি কেউ থাকত!
এঁদোগলির এক কোণে একটা জীর্ণ, পলেস্তারা খসা এজমালি ভাড়াটে বাড়ির একতলায় একটা ঘুপসি ঘর ওর পৃথিবী। নিশ্বাস নেওয়ার মুক্তি ওই জানলাটা।
তিনমাসের ভাড়া বাকি পড়েছে। কাল মালিকের বখাটে ভাইপোটা এসে শাসিয়ে গেছে। শুধু তাকে নয়, পাশের ঘরের গোবিন্দ, দোতলার খগেন দাস আর তারামতী, উঠোনের ওপাশের হারু ভটচায— সকলকেই।
গোবিন্দ লালবাজারের সামনে পুরোনো লঝঝড়ে টাইপ মেশিন নিয়ে বসে। রোজগার তেমন হয় না আজকাল। তারামতীর মেয়ে জামাই কোনোমাসে টাকা পাঠায়, তো কোনোমাসে ফাঁকি পড়ে। হারু ভটচায স্ট্রোকে শয্যাশায়ী— মেয়েটা সেয়ানা— ডবকা ছুঁড়ি, দুদিন ধর্মতলায় দেখেছে ওকে লোকটা— দুটো আনকা বাবুলোকের সঙ্গে ট্যাক্সিতে উঠছে—সে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল— ঘেন্নায় নয়, অসহায় কষ্টে। এই তো, ক’বছর আগেও, সবুজ পাড় সাদা শাড়ি পরে, দুই বিনুনি ঝুলিয়ে, বুকের কাছে ঢাউস বইয়ের ব্যাগ আঁকড়ে ইস্কুল থেকে ফিরত!
একটা দীর্ঘশ্বাস গিলে নিয়ে লোকটা কলতলার দিকে পা বাড়ায়।
তাপ্পিমারা টায়ারের চটিটা অভিমানে জবাব দিতে চাইছে অনেকদিন ধরে। লোকটা দিন তিনেক ক্ষৌরী না করা গালে একবার হাত বুলোয়। তারপর বুক পকেট হাতড়ে বার করে একটা ময়লা দশটাকার নোট। নিতান্ত বেমানান ভাবেই, পকেটে একখানা ছেঁড়া লতপতে মানিব্যাগও আছে তার। কবেকার কেনা, আজ মনেও নেই। ব্যাগ হাতড়ায় নিরুপায় আঙুল। উঠে আসে এক পাতা জেলুসিল, ঠনঠনে কালীবাড়ির শুকনো প্রসাদী ফুল, গোটাকয় সাতপুরোনো ক্যাশমেমো—কিসের, কে জানে, এতই ঝাপসা, যে পড়া যায় না অক্ষরগুলো— আর একখানা বিবর্ণ, ছোপধরা ফোটোগ্রাফ— তার বহুদিন আগে চলে যাওয়া মায়ের। অনেকক্ষণ ধরে ফোটোটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ জ্বালা করে ওঠে লোকটার।
তারপর, মানিব্যাগটা ফের পকেটে ঢুকিয়ে তাপ্পিমারা চপ্পলটা টেনে টেনে চলতে শুরু করে লোকটা।
মেডিক্যাল কলেজের এক নম্বর গেটের বাইরের ফুটপাথের এককোণে ওর বসার জায়গা। একটা চিট ময়লা প্লাস্টিক পাতে সে ফুটপাথে। কোনোকালে ওটার রঙ বোধহয় লাল ছিল— কিংবা কমলা। ও মনে করতে পারে না। প্লাস্টিকটার চার কোণে চারটে ইঁটের টুকরো চাপায় সে। ফুটে ইঁটের অভাব নেই— কেন, কে জানে!
এবার তার কুটকুটে ঝোলার জিনিসগুলো সে উপুড় করে দেয় প্লাস্টিকের উপরে। হাজার মলম, মাথা ধরার বাম, ভাস্কর লবণ, শুকনো আমলকি, বাতের অব্যর্থ বিষহরি— পিতপিতে হলুদ কাগজের লেবেলমারা কালচে শিশিগুলোকে প্লাস্টিক শিটের ওপর যত্নে সাজায় লোকটা। ‘আজ নিশ্চয় বিক্কিরি একটু ভাল হবে। বাঁ চোখটা সকাল থেকেই নাচছে বড্ড।’
বাস আর ট্যাক্সির ধুলোয় যেন ঘূর্ণি ওঠে ব্যস্ত কলেজ স্ট্রিটে। দুপুরের রোদ চোখ রাঙিয়ে রাঙিয়ে ক্লান্ত হয়ে বিকেলের কোলে ঢলে পড়তে চায় আহ্লাদির মতো।
সকালের শুকনো পাঁউরুটি আর লাল চা তুফান তোলে লোকটার পেটে। মুখের ভিতরটা হাকুচ তেতো হয়ে আছে। ওর খুব বমি পায়। আজ চারটাকার এক পিস হাজার মলম বিক্রি হয়েছে শুধু। ক্ষয়া ক্ষয়া আঙুলের একটা বুড়ি নোংরা আঁচলের গিঁট খুলে অনেক দর কষাকষির পরে এক শিশি নিয়ে গেছে। বুড়ির ছেলে বুঝি ভর্তি আছে হাসপাতালে। খান দুই আপেলের নৈবেদ্য ছেলের বিছানার পাশে রেখে, ফিরতি পথে নিজের জন্য হাজার মলমের উপহার নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে বুড়ি।
আর কেউ আসেনি। দর করতেও না। পেটটা এক হাতে চেপে ধরে লোকটা ভাবে— ভিক্ষেও তো দিয়ে যেতে পারে লোকে দু’চারটাকা। কত পয়সা এধার ওধার খরচা করে রঙিন ছেলেমেয়ের দল— তার দরকচা মারা অস্তিত্বটা বুঝি চোখেও পড়ে না কারো!
এত খিদেই বা আসে কোথ্থেকে কে জানে! মা বলত, তার নাকি ঘরখাই বাড়িখাই খিদে।
মা! মা মানেই গরম ভাতের গন্ধ— তাদের ন’দে জেলার গাঁয়ের বাড়ি—চূর্ণী নদীতে জাল ফেলে মাছ ধরা— চান করা—কালীনারানপুরে যাত্রা দেখতে যাওয়া— সদ্য চান করে আসা মায়ের শরীরে কি এক আবিষ্ট করা ফুলেল গন্ধ— বড় শৌখিন ছিল তার গরিব মা— কি একটা লোশন যেন মাখত বারোমাস? হ্যাঁ, বসন্ত মালতী!
দুচ্ছাই! ওসব তো গতজন্মের কথা! ওসব ভাবলে কি খিদে মরে? বরং আরো বেশী চাগাড় দিয়ে ওঠে!
সন্ধের পরে, প্লাস্টিক গোটানোর সময় এলে, হাতের পাতায় একটাকার চারটে কয়েনের দিকে হতাশভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ গা পাক দিয়ে ওঠে লোকটার। আর থাকতে পারে না ও। হড়হড় করে বেরিয়ে আসে বমি— টকটকে রঙটা হ্যালোজেনের আলোয় চিনতে কষ্ট হয় না ওর।
ফুটপাতে এলিয়ে পড়ে চেতনা হারাতে হারাতে, লোকটার মনের মধ্যে চিন্তা ঝিলিক দিয়ে ওঠে—তার মতো নিখাকি মানুষের রক্ত এত লাল?
ঠিক দুপুর বারোটায় ডায়েটের গাড়ি আসে ওয়ার্ডে। লোকটার ঘড়ি নেই হাতে, তবু পাকস্থলীর এক নির্ভুল বালিঘড়ি তাকে জানিয়ে দেয় সময়ের মাপ।
মোটা চালের গ্যাদগ্যাদে ভাত, জলের মতো একটু ডাল, একটা পটল কিংবা কুমড়োর ঘ্যাঁট, আর এক টুকরো কাটাপোনা। অমৃত কি এর চেয়েও ভাল খেতে? লোকটা জানে না। শুধু হাপুস হুপুস করে খেতে খেতে পাশের বেডে, বিছানার সঙ্গে মিশে যাওয়া লোকটার বায়না শোনে।
সেই লোকটা কেবলই ইলিশ মাছের রাই ঝাল, কচি পাঁঠার ঝোল আর আমের চাটনির জন্য ঘ্যানঘ্যান করে। ওর বউটা পাথরের মতো মুখ করে থালা থেকে গরাস মেখে খাওয়াতে খাওয়াতে শোনে সব। কিচ্ছুটি বলে না। মাঝে মাঝে তার সঙ্গে চোখাচোখি হয়। বউটার দৃষ্টিটা যেন কেমন। ঠিক আদেখলা ঢলানি নয়, আবার সেয়ানাও নয়। কেমন যেন একটা দূরান্তের ছোঁয়া তাতে। সে পড়তে পারে না সেই দৃষ্টি। মুখ ফিরিয়ে নেয়।
স্বামীকে খাইয়ে, বউটা থালাবাটি ধুতে যায় ওয়ার্ডের বারান্দার কলে। রঙিন ছাপা শাড়ি, কপালে ‘ম্যাচিং’ সোয়েডের টিপ, সস্তা রেক্সিনের চকচকে হাতব্যাগ— আর সব কিছুর ওপরে সে—ই কবেকার চেনা গন্ধের আভাস ছুঁইয়ে চলে যায় সে। বসন্ত মালতী। মা মাখতো।
পাশের বেডের লোকটার নাম রবীন দস্তিদার। ওর পাকযন্ত্রে ক্যানসার। ক্যানসার সারে না। ও জানে। ভুগে ভুগে কাঠির মতো চেহারা হয়েছে রবীনের। অসুখে পড়ার আগে ওর একটা স্টেশনারি দোকান ছিল, হাওড়ার আঁদুলে। এখন সেখানে ওর দাদা বসে। একমুখ কুটকুটে দাড়ি আর গর্তে ঢোকা পিচুটিমাখা ফ্যাকাশে চোখে তীব্র বিষ নিয়ে রবীন মাঝে মাঝে শিশুর মতো চিল চেঁচায়—”দাদা হয়েছেন, দাআআদা! সব চিবিয়ে চুষে খেয়ে নেবার মতলব!”— তারপর নোংরা বিছানার চাদরে সরু সরু খসকুটে পা দুটো ঠুকে ঠুকে চিৎকার করতে থাকে—“মর! মর! মর সক্কলে!”
দূরের টেবিল থেকে সিস্টার দিদি ধমকে ওঠে উঁচু গলায়—“অ্যাই বারো নম্বর! চুপ করো বলছি! চুপ! একদম চেঁচাবে না!”
আজ প্রায় এগারোদিন ভর্তি আছে লোকটা। কমবয়সী সুন্দরপানা যে ডাক্তার ছেলেটি তার নাড়ি ধরে দেখে যায় রোজ— তার মুখেই শুনেছে, না খেয়ে খেয়ে পেটে ঘা হয়ে গিয়েছিল তার! আরেকটু হলে পেটটাই নাকি ফুটো হয়ে যেতো। রক্তবমিটাই বাঁচিয়ে দিয়েছে ওকে।
গেটের পাহারাদার আর পুলিশরাই নাকি তাকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল হাসপাতালে। ওরাই কিনে দিয়ে গেছে একখানা স্টিলের থালা, গেলাস, নতুন লাল গামছা, এক টুকরো গন্ধসাবান, দাঁতের মাজন আর একজোড়া সুতির হাফপ্যান্ট।
তবু, যেদিন বমি বন্ধ হয়ে, শরীরটা একটু জুতের হলো লোকটার, ও কেঁদে উঠেছিল ওর রংওঠা প্লাস্টিকের ওপর সাজানো হাজার মলম আর বাতের তেলের হারানো পসরার জন্য! কোন্ হারামির বাচ্চা ওগুলোকে গাপ করলো রে শালা— মনটা গুমরে গুমরে উঠেছিল ওর।
দয়ালু পুলিশগুলো আর সব দিলেও, মাথায় মাখার তেলের শিশি এনে দেয়নি। অথচ, যেদিন হাত থেকে স্যালাইনের ছুঁচ খুলে দিলো ডাক্তারবাবু, ওর তেল মেখে ভাল করে চান করতে খুব সাধ হচ্ছিল! যা চাঁদিফাটা গরম!
বিছানায় পা ঝুলিয়ে ইতিউতি চাইছে যখন, তখনি রোল্ডগোল্ডের চুড়ি পরা একটা হাত তেলের শিশিটা এগিয়ে ধরেছিল। পাশের বেডের লোকটার বউ।
সেদিনই জেনেছিল রবীন দস্তিদারের বৃত্তান্ত। বউটার কথা শুনে বুঝেছিল লোকটা— রবীনের জীবনের কেতাবখানা এবার বন্ধ হতে চলেছে। প্রদীপের তেল নিঃশেষিত। আলো মরে এসেছে। দপদপ করছে শিখা— একেবারে নিভে যাবার আগে।
অদ্ভুত একঘেয়ে উদাস গলায় বলেছিল বউটা—“বড্ড কষ্ট পেলো মানুষটা—অ্যাতোটাও বোধায় ওর পাওনা ছিল নি”—
লোকটার চোখে জল এসেছিল শুনে। পোড়া মন কিসের জন্য এত আকুল হয়?
রাণাঘাটের শ্মশানে বাবার নিভে আসা চিতাটার দিকে তাকিয়ে একই কথা বলেছিল মা-ও। “বড় কষ্ট পেয়ে গেলে গো এ ছাইএর সংসারে— কিচ্ছু করতে পারলুম না তোমার জন্যি—“
কবেকার চেনা ঘ্রাণ ওর অনুভূতির বুননে ঝড় তোলে। বসন্ত মালতীর গন্ধমাখা আঙুলে মা ওর কপাল ছোঁয়। ও চমকে চোখ মেলে। দেখে, ও—ই ওয়ার্ডের বড় দরজা দিয়ে যেন হাওয়ায় ভেসে বেরিয়ে যাচ্ছে হলদে সবুজ ছাপা শাড়ির আঁচল।
এরই মাঝে একদিন আবার বমি হলো লোকটার। সুন্দরপানা ডাক্তারের কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখল ও। বলতে পারল না, যে ওষুধের গুণে ঘাটতি পড়েনি, দোষ হয়েছিল তার নিজেরই। কি দরকার পড়েছিল রবীনের বউয়ের আনা টোকো কমলালেবুটা খাওয়ার? সঙ্গে আবার দুখানা দানাদার! অম্বলের রোগ তার— রেয়াত করে কখনো? এদিকে পিছিয়ে গেল ছুটি ।
তাতে অবিশ্যি দুঃখ হয় না লোকটার। এমন নিবিড় নিশ্চিন্তি, মা যাবার পর থেকে আর কখনো অনুভব করেনি সে।
এক ভোররাতে চলে গেল রবীন দস্তিদার। পড়ে রইল একটা শুকনো কাঠামো—ময়লা বিছানার চাদর আঁকড়ানো অবয়ব— মাথার কাছে জংধরা লকারে প্রায় শেষ হয়ে আসা হরলিকসের শিশি, আধখাওয়া আপেল, খাটের নিচে নতুন হাওয়াই চটি, পায়ের কাছে গুটোনো পাতলা বালাপোশ।
বডি নিতে এসেছিল ওর ‘গুখেগো’, ‘পিচাশ’ দাদাটা, দু’চারজন পড়শি, এক বুড়ি আত্মীয়াগোছের কেউ। বউটা আসেনি।
বেলাটা বড্ড ফাঁকা লাগল লোকটার। বুকের ভিতরটা যেন খালি হয়ে গেছে।
কেমন একটা অভ্যেসের মতো হয়ে গিয়েছিল রবীন দস্তিদার, এই ক’দিনে। এখন মনে হচ্ছে, তার আশেপাশে একটা নীরব শূন্যতা— ভুতুড়ে হাসিতে যেন ভেংচি কাটছে তাকে।
সরকারি হাসপাতালে বিছানা মহার্ঘ— তাই খালি থাকা দুষ্কর। সন্ধেবেলাই রোগী এসে গেল বারো নম্বর বেডে। ন্যাবাধরা এক রুগ্ন তরুণ। নাম জানার ইচ্ছে বা উৎসাহ হল না লোকটার।
ভিজিটিং আওয়ারে বড় অসহ্য লাগে তার। চারপাশে এত আত্মীয়, বন্ধু, পরিজনদের কলকলানির মধ্যে তার নিঃশব্দ বিছানার ধার— কেউ কেউ অবাক চোখে তাকায়। এই লোকটাকে কেউ কোনোদিন দেখতে আসে না কেন, কে জানে?
যে দয়ালু পুলিশগুলো ভর্তি করে দিয়ে গিয়েছিল, তারাও তো এক আধদিন আসতে পারে! নাঃ, কেউ আসে না। লোকটা পাশ ফিরে শোয়। মাথার কাছের জানলায় বিকেলের রোদ্দুর রাঙা হয়ে আসে। ক’টা লোভী কাক হুটোপাটি করে একটুকরো পাঁউরুটির অধিকার নিয়ে। সে চোখ বোজে।
হঠাৎ— একেবারে হঠাৎই, তার ইন্দ্রিয়ে এসে ধাক্কা দেয় সেই সুবাস। মায়ের সুবাস। বসন্ত মালতী।
সে ধড়মড় করে উঠে বসে।
হাতে কষাটে আপেলের ঠোঙা নিয়ে, সেই অদ্ভুত উদাস চোখ মেলে, তার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে রবীনের বউ।
“তোমাকে দেখতে এলাম।”— বলে মাথা নীচু করে বউটা—“তাকেও”—
তার গলা ধরে আসে। চোখ থেকে টপটপ করে ঝরে পড়ে বেহায়া জলের ফোঁটা। লোকটার সামনে থেকে মুছে যায় হাসপাতালের ওয়ার্ড, ঝুলমাখা কড়িবরগা, কফভর্তি গামলা, রোগী আর বাড়ির লোকের অর্থহীন চিৎকার—
ভেসে ওঠে চূর্ণী নদী, গরম ভাতের থালা, তুলসীতলায় স্নিগ্ধ সন্ধেপ্রদীপ, ঘুলঘুলির কিচমিচে চড়াই দম্পতি, মায়ের আঁচলের ওম— সে খেয়াল করতে পারে না, কখন যেন লোহার খাটের ঠান্ডা রেলিঙের ওপর জড়িয়ে গিয়েছে দুটি উষ্ণ করতল— রুক্ষ আঙুলগুলো খুঁজে নিয়েছে বড় আপন স্পর্শখানি— সহানুভূতির ছোঁয়ায় কখন যেন গলে পড়ে গেছে বর্তমানের কঠোর অনিশ্চয় মুহূর্তগুলো।
ঠিক তখনি, দূরের বেঞ্চের সিস্টার দিদি, পাশে বসা সহকর্মিণীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে তেরো নম্বর বেডের দিকে— উৎকট ভ্রূভঙ্গি করে ছিটকে দেয় শব্দটা—“ছেনাল”!