ডা চন্দ্রিমা নস্কর
সকালবেলা তৈরী হতে হতে বেশ একটা অজানা আনন্দ অনুভব করছিল অদ্রীশ। শেষমেশ স্কুলের গণ্ডি পেড়িয়ে তাহলে কলেজ জীবন শুরু হচ্ছে! নতুন কলেজ, নতুন হোস্টেলের ঘর আর নতুন এই স্বাধীনতার স্বাদ… অদ্রীশের নিজেকে দারুণ ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল। সে মনে মনে ভাবছিল যে গত ক’বছরের খাটনিটা স্বার্থক; নিজের স্বপ্নগুলো এইবার যেন ধরাছোঁয়ার মধ্যে আসছে ।
স্কুলের প্রথম সারিতে থাকা অদ্রীশ চিরকালীন ভালবেসে পড়াশোনা করেছে, শাস্তি-বকুনি তো দূর অস্ত, কখনও শিক্ষকরা তার সম্বন্ধে কোনও সামান্য অভিযোগ করারও সুযোগ পাননি। কলেজেও তেমনটাই আশা করেছিল সে। কিন্তু স্কুলের চার- দেওয়ালের বাইরের জগৎটার সাথে তার আলাপ পরিচয় শুরু হতে না হতেই সম্পর্কটা কেমন যেন অস্বস্তিকর হয়ে উঠল। অদ্রীশের সময় মতন অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়া, ক্লাসে পটাপট উত্তর দেওয়া, ক্লাসের শেষে শিক্ষকদের কাছে কিছু প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করতে যাওয়া, এই সব অচিরেই কিছু ছেলে মেয়ের ঠাট্টার বিষয় হয়ে উঠল। তার এই অতিরিক্ত বাধ্যতা নিয়ে কিছু ছোটখাট কথা শোনানো, আশপাশ দিয়ে চলতে ফিরতে টিপ্পনী কাটা এইসব চলতে লাগল পুরদমে। প্রথম প্রথম গা করত না অদ্রীশ, ভেবেছিল বেশিরভাগ লোক যা বলে বলুক, ঠিক মনের মতন কিছু বন্ধু নিশ্চয়ই পেয়ে যাবে ধীরে ধীরে, যাদের সাথে আরাম করে ভাগ করে নিতে পারবে তার নিজের চিন্তা, ভাবনা, প্রশ্ন, স্বপ্ন সবকিছু।
কিন্তু মাসখানেক যেতে যেতে সে বুঝল, সে বড়ই এক ঘরে হয়ে গেছে কলেজে, এমনকি হোস্টেলেও। তার পেছুনে লাগা বাদে আর তেমন কেউ কাছে ঘেঁষে না তার। মন খারাপ লাগতে থাকল তার এসব কথা ভেবে, পড়াশোনা করতে গেলেও মনে হতো কিইবা হবে করে, সেই তো সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে ক্লাসে। ক্লাসেও নিজেকে গুটিয়ে রাখতে শুরু করল সে, আর হাত তুলে জবাব দেয় না, মনে প্রশ্ন এলেও জিজ্ঞাসা করে না, খালি মনে হয় এই বুঝি সবাই তাকে নিয়েই টিপ্পনী কাটবে। ক্যান্টিনেও বেশীরভাগ সময়ে সে একাই খেতে বসে। কদিন ধরে মনে হতে লাগল পাশের টেবিলে বসা ছেলেমেয়েরা যেন তার ব্যাপারেই ফিসফিস করে কথা বলছে, তার দিকেই আঙুল তুলে দেখাচ্ছে, আর সে তাদের দিকে তাকালেই অন্য কিছু করার ভান করছে। কয়েকবার সে মন দিয়ে তাদের কথা শোনবারও চেষ্টা করল, কিন্তু যেন ওরা বুঝতে পেরে গিয়েই অন্য ব্যাপারে কথা বলতে থাকল সেই সময়ে। ওর বেশ ধারনা হল ওর ক্লাসের অন্যেরা সবাই কোনও ভাবে ওর মনের ভেতর চলা চিন্তাগুলো জানতে পেরে যাচ্ছে, হয়ত মোবাইল ফোনের কোনও অ্যাপ দিয়ে… আজকাল তো মোবাইল দিয়ে সবকিছুই করা যায়! সেই কারণে নিজের মোবাইল বন্ধ করে রাখতে শুরু করল বেশীরভাগ সময়ে, কিন্তু ভয়টা কিছুতেই কমলনা। এই বুঝি কেউ কোনও ভাবে তাকে কোনও জটিল পরিস্থিতিতে ফাঁসিয়ে কলেজ থেকে রাস্টিকেট করিয়ে দেয় এমন ভয় হতে থাকল খালি। রাতে কিছুতেই ঘুম আসতে চায়না কিছুতেই, পায়চারি করতে থাকে সে ঘরময়। নাওয়া খাওয়ার কোন খেয়াল থাকে না। জামা বদলানো, দাড়ি কামাবার কথা মনে আসে না তার। ক্লাসে যাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিলো অদ্রীশ, কেউ ঘরে খোঁজ নিতে এলেও দরজা খোলেনা সে, যদি তার মনের কোনও কথা জানতে পেরে ফাঁস করে দেয় তারা! আগে রোজ প্রায় মিনিট কুড়ি ফোন করে মা-বাবার সাথে কথা বলত সে রুটিনমাফিক, কিন্তু এখন আর কেমন যেন তাদেরকেও ফোন করতে ইচ্ছে করেনা আর। বাবা নিজে থেকে ফোন করলে ছোটখাটো হ্যাঁ-নাতেই কথা ফুরিয়ে যায়; নিজের ভয়ের ব্যাপারে মা- বাবাকে বলতে ভয় করে, যদি কেউ ফোন ট্যাপ করে শোনে? ঘরে একলা বসে থাকতে থাকতেও সে শুনতে পেতে থাকে বন্ধুদের গলা, তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে তার ব্যাপারে…বলছে নানান খারাপ কথা, এমনকি গালিগালাজও! কোথা থেকে শব্দ আসছে খোঁজার অনেক চেষ্টা করে অদ্রীশ, কিন্ত জানলা, দরজা, দেওয়াল আলমারি সব খুঁজেও ওইসব শব্দের কোনও উৎস খুঁজে পায়না কিছুতেই। এমন হয় যে ফ্যান চালালেও তার ভেতর থেকে কেউ তার উদ্যেশে নানান কটূক্তি করতে থাকে, কমন রুমের টিভির অ্যাঙ্কররাও তার ব্যাপারেই কথা বলাবলি করে- সবসময় এই প্রচণ্ড ভয়ের মধ্যে থাকতে থাকতে অদ্রীশের মনে হয় এর থেকে পালিয়ে যাওয়াই ভালো।
কলেজের হোস্টেল থেকে উধাও হয়ে যাওয়ার কথা জানাজানি হয় দিন দুই বাদে। ওদিকে ছেলে ফোন না ধরাতে মা বাবাও অস্থির হয়ে পৌঁছে যান তার কলেজে। থানা পুলিশ করতে করতেই আশপাশে খোঁজা শুরু করে কলেজের ছাত্রছাত্রী এবং কর্মীরা। কলেজ থেকে মাইলখানেক দূরে একটা নির্মীয়মাণ বাড়ির আশপাশ থেকে খুঁজে পাওয়া যায় অদ্রীশকে। তখনও সে নিজের মনে বিড়বিড় করে কী যে বলে যাচ্ছে তার মানে বোঝা দুষ্কর। গত দুদিনের ব্যাপারে তেমন কিছু বুঝিয়ে বলতে পারেনা সে, শুধু তার হাবভাব থেকে তার মারাত্মক ভয় স্পষ্ট বোঝেন সবাই। ছেলেকে সাথে নিয়ে কলকাতা ফিরে যান তার মা-বাবা। কোনও রকমের সান্ত্বনাতেই তার ভয় কাটেনা, সে কিছুতেই মানতে পারেনা যে কেউ তার ক্ষতি করতে চায় না, ওইরকম সামান্য ঠাট্টাতামাশা বাদে আর কোনও কিছুই করতে চায়নি কলেজের ছাত্ররা…
এক প্রতিবেশী ডাক্তারবাবু অদ্রীশের বাবাকে ডাক্তার মিত্রের ঠিকানা দেন এবং দেরী না করে তাঁর কাছে দেখাতে বলেন। ছেলেকে প্রায় জোর করে নিয়ে যেতে হয় ডাক্তারের কাছে। বাড়ি এসে থেকে সে মা বাবাকেও সন্দেহ করতে শুরু করেছে, তাদের দেওয়া খাবার খেতেও ভয় পায়, কথা শোনা তো দুরের কথা। বরং কিছু বলতে গেলে রেগে যায় ভীষণ, হাতের কাছের জিনিস তুলে মারতে যায়, সবসময় দু কানে আঙুল গুঁজে এক কোনে বসে নিজের মতন কীসব বিড়বিড় করতে থাকে। ডাক্তারবাবুর কাছে নিজের ছেলের এই অভাবনীয় পরিবর্তনের কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন শ্রীলাদেবী। হাতজোড় করে বারবার প্রার্থনা করেন তাঁর কাছে যে তিনি যেন যেমন করেই হোক তাঁর ছেলেকে ফিরিয়ে দেন, বারবার বলতে থাকেন তাঁর ঘোর বিশ্বাস কেউ তাঁর শান্ত ছেলেটার ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে কোনও জাদুটোনা করেছে।
শ্রীলাদেবীকে কোনও মতে শান্ত করে ডাক্তার মিত্র বলতে থাকেন যে তাঁর ছেলের এই অসুখটির নাম স্কিৎজফ্রেনিয়া। ব্রেনে কিছু গঠনগত ও রাসায়নিক পরিবর্তনের কারণে এই রোগ হয় এবং এতে মানুষের বাস্তব এবং কল্পনাকে আলাদা করতে পারার ক্ষমতা কমে যায়, যে কারণে মনের ভেতরকার চিন্তাভাবনা ভয়গুলো সত্যি বলে বিশ্বাস করতে থাকে রুগী, এমনকি নিজের মনের ভেতরের শব্দগুলো বাইরে থেকে আসছে বলে মনে হয়। ঘুম কমে যাওয়া, নিজের প্রতি খেয়াল রাখার অভাব, নিজের মনে বিড়বিড় করা সবই এই পরাবাস্তব জগতে হারিয়ে যাওয়ার ফলে হয়। শুনতে বেশ ভয়াবহ লাগলেও, এই অসুখের নানান ওষুধ এখন বেশ সহজলভ্য। এবং প্রতিদিন নিয়ম করে ওষুধ খেতে থাকলে মাসখানেকের মধ্যে ফারাক দেখা যায় একশ জনের মধ্যে ষাট-সত্তরজন রুগীর ক্ষেত্রে। পুরোপুরি নিজের মতন হতে অবশ্য সময় লাগতে পারে মাস ছয়েক কিম্বা তারও বেশী। কখনও কখনও কিছু কাউন্সেলিং ও করা হয় ধীরে ধীরে এদেরকে সাধারণ জীবনযাপনে ফিরিয়ে আনতে।
মাসখানেকের জন্য একটা রাত্তিরে খাওয়ার ওষুধ লেখেন ডাক্তার মিত্র, স্বাভাবিকভাবে কথা বলার চেষ্টা করেন অদ্রীশের সাথে, তাঁর ভয়ের ভাবনা এবং সন্দেহগুলোকে নাকচ না করে মন দিয়ে শোনেন, একটা ভরসার আশ্রয় তৈরীর চেষ্টা করেন আর তার মা বাবাকেও ঠিক তাই করবার পরামর্শ দেন।
প্রায় মাসচারেক কেটে গেছে ওষুধ শুরুর পর, অদ্রীশের সন্দেহ অনেকটা কমেছে, কানেও আর এখন ওইসব আওয়াজ আর আসে না, তবু কলেজে ফেরত যেতে সে ভয় পায়, যদি আবার সব খারাপ হয় ভেবে। ডাক্তার মিত্র আর তাঁর সাথে কাজ করা সাইকোলজিস্ট রক্তিম বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেন ধীরে ধীরে তাকে এই ভয় কাটিয়ে উঠে আবার পুরনো জীবনে ফিরে যেতে।
আবার একটা নতুন সকাল আসে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তৈরি হতে হতে অদ্রীশ তার জীবনের স্বপ্নগুলোর কথা ভাবে। মনের ভেতর স্বপ্ন-কল্পনা-বাস্তব মিলে মিশে একাকার হয়ে যাওয়ার ভয়টা যেন কলেজে ফিরে যাওয়ার ভয়ের চাইতে অনেক বড় বলে মনে হয়। কিন্তু নিজেই নিজেকে একবার পিঠ থাবড়ে নেয়, নিজেকে মনে করিয়ে দেয় যে সে ডাক্তারবাবুকে কথা দিয়েছে যে কিছুতেই নিজেকে হারিয়ে যেতে দেবেনা। শেষমেশ… ওই ভারচুয়াল রিয়ালিটি থেকে হাত ধরে টেনে রাখবার জন্য একধারে ওষুধ আর অন্য ধারে তার মা-বাবা আর রক্তিমদা তো আছেই! আগের রাতেই গুছিয়ে রাখা ব্যাগটা নিয়ে, মাকে একবার জড়িয়ে আদর করে অদ্রীশ বেড়িয়ে পরে কলেজের পথে, তার যত্ন করে গুছিয়ে রাখা স্বপ্নগুলো বাস্তব করতে।