আমার ইস্কুলজীবনের পাঠ্য বিষয়গুলির উপরে (অঙ্ক ও পদার্থবিদ্যে বাদে) আমার অকৃত্রিম টান থাকা সত্ত্বেও কেন যে ইস্কুল ব্যাপারটাতেই আমার একটা চূড়ান্ত ভীতি আর বিবমিষা ছিল, সেই ছেলেমানুষ বয়সে তার ময়নাতদন্ত করা সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে।
একটু বড়বেলায় পৌঁছে বুঝেছিলাম, আমার শৃঙ্খল ভাল লাগে না। শৃঙ্খলা আর শৃঙ্খলকে স্বতন্ত্র করে দেখার পাঠ কতজনের আত্মস্থ ছিল জানি না, আমার কিছুটা ছিল। তাই বোধহয় এ’রকম একটা স্ববিরোধী জগাখিচুড়ি মানসিকতা নিয়ে সমাজে না ঘরকা না ঘাটকাই রয়ে গেলাম। যাগ্ গে সেসব ছেঁদো আফশোসের দীর্ঘশ্বাস —- ফিরে আসি ইস্কুল-কথায়।
আমি মাধ্যমিক দিইনি, আইসিএসই দিয়েছিলাম। যে ইস্কুল থেকে দিয়েছিলাম, চন্দননগরের সেই সেন্ট জোসেফ কনভেন্টের গল্প কাঁড়ি কাঁড়ি করেছি সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায় — সেসব স্মৃতি দূরের হলেও তার ঔজ্জ্বল্য হারায়নি এতটুকু। কিন্তু সে ইস্কুলে এগারো বারো ক্লাস ছিল না, তাই আইসিএসই পাশ করার পরে ইস্কুল বদলের কথা ভাবতে হলো বাবা-মাকে।
জয়েন্ট এন্ট্রান্স তখন পাখির চোখ, আর তার জন্য পশ্চিমবঙ্গের হায়ার সেকেন্ডারি বোর্ডের সিলেবাস সম্বলিত ইস্কুল বিনে চলবে না, অথচ মায়ের প্রবল ইচ্ছে সে ইস্কুলকেও কনভেন্ট হতে হবে, নিদেনপক্ষে ইংলিশ মিডিয়াম। কারণ বিবিধ। বাকি সব ভাবাবেগী কারণ বাদ দিলে মূল কারণ দাঁড়ায় একটিই — দশ ক্লাস পর্যন্ত ইংরেজি মাধ্যমে সায়েন্স সাবজেক্ট পড়ে মেয়ে তো দু’বছরে বাংলায় ভৌত আর জীববিজ্ঞানের সংজ্ঞা আর ভাষ্যে সড়গড় হয়ে উঠতে পারবে না, সে যতই শরদিন্দু গুলে খেয়ে থাকুক না কেন! বাস্তব যুক্তি।
আমরা তখন থাকি শ্যামনগরে। বাবা চাকরি করত স্থানীয় কটন মিলে। কাছেপিঠে তেমন ভাল উচ্চমাধ্যমিক ইংরেজি মাধ্যম ইস্কুল নেই। হুগলী মহসিন ছিল, গঙ্গার ওপারেই — মায়ের পছন্দ হলো না। নামটায় কেমন মফস্বলী গন্ধ। আমার বড় দুই মাসতুতো দাদা সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়েছে, ঠিক পরের মাসতুতো ভাই নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন, দুই জ্যাঠতুতো দিদি লোরেটো কনভেন্ট আর আমি কিনা হুগলী মহসীন? কেমন একটা শোনাবে না?
গোখেল মেমোরিয়ালের অ্যাডমিশন টেস্টে আমি কৃতকার্য হতে পারলাম না। অবাক হইনি। অবাক হলাম যখন সেই ইস্কুলের হেডমিস্ট্রেস আমার আইসিএসই-র মার্কশিটের কপি হাতে বাবা-মাকে তাঁর চেম্বারে ডেকে পাঠিয়ে বললেন — “এ মেয়ে তো লিটারেচরের মেয়ে, একে আপনারা সায়েন্স স্ট্রিমে ভর্তি করতে এনেছেন কেন? হিউম্যানিটিজ নিয়ে পড়লে ও শাইন করতে পারবে।”
আড়চোখে দেখেছিলাম মা চোয়াল শক্ত করে জোড়হাতে বড়দিমণিটিকে একটি নীরব নমস্কার জানিয়ে বাবাকে চোখের ইশারায় বেরিয়ে আসতে বলছে ঘর থেকে।
অতঃপর মিডলটন রো-য়ের লরেটো হাউস। ট্যাঁশপনা আর ফ্যাশনিস্তামোর জন্য কুখ্যাত একটি কনভেন্ট ইস্কুল। যে ইস্কুলে প্রথম দিন ঢুকেই আমার একটুও ভাল লাগেনি, চোখ টানেনি কোনো কিছুই — যিশু কোলে মা মেরির মূর্তিটি ছাড়া।
তবু, সুদূর শ্যামনগর থেকে পার্ক স্ট্রিট — আমার যাত্রা হলো শুরু।
স্টুডেন্টরা তো বটেই, টিচাররাও সম্ভবত অন্তর থেকে বিশ্বাস করতে পারতেন না, যে এই ইস্কুলে সিরিয়াস পড়াশোনা হতে পারে। তবে পড়াশোনার হাল যাই হোক, ডিসিপ্লিনের বহর ছিল দেখার মতো। প্রতিদিন সকালে প্রেয়ারের পরে লাইন করে ক্লাসে ঢোকার আগে ক্লাস মনিটররা চেক করে নিতো হাত আর পায়ের নখ — কায়দা করে বাড়ানো থাকলে বা রঙ বোলানো থাকলেই শাস্তি। হবু ফ্যাশনিস্তারা লংস্কার্টের পকেটে রেখে দিতো নেলকাটার আর নেলপলিশ রিমুভার। আমি হাঁ করে দেখতাম।
কানে ঝোলা দুল ছিল নিষিদ্ধ, নিষিদ্ধ ঘড়ি ছাড়া হাতের অন্যান্য অলঙ্কারও। কিন্তু ছুটির পরে মুনমুন সেন তাঁর প্রাইমারি সেকশনে পড়া দুই মেয়েকে নিতে এলে হুড়মুড় করে গোটা ক্লাস (শুধু সায়েন্স সেকশন নয়, হিস্ট্রি এবং ‘জোগ্রাফি’ও) লাগোয়া করিডরে দৌড়ে বেরিয়ে, দোতলার বারান্দা থেকে বিপজ্জনকভাবে কোমর অবধি ঝুঁকে, ঠেলাঠেলি করে তারকাদর্শন করলে সেটা নিষিদ্ধ ছিল না — টিচাররা প্রশ্রয়ের হাসি হাসতেন।
ভোর ছ’টা বাজারও দশ মিনিট আগে ঢাউস ব্যাগ কাঁধে (বইয়ের চেয়ে টিফিনের ভার বেশি) আখতারদার রিকশায় চড়ে শ্যামনগর স্টেশনের দিকে যাত্রা শুরু করে আরম্ভ হতো আমার দিন।
তারপর ছ’টা পঁচিশের শিয়ালদাগামী ট্রেন। তারও পরে শিয়ালদা ফ্লাইওভারের উত্তর প্রান্তে জগৎ সিনেমার উল্টোদিক থেকে সাতচল্লিশের এ বাস ধরে হাঁচোড় পাঁচোড় করতে করতে জীবনদীপ স্টপে নেমে প্রায় দৌড়তে দৌড়তে আর্চিজ গ্যালারি, ফ্লুরিজ পার হয়ে ইস্কুলে ঢুকে, সকাল আটটার মধ্যে গোমড়া মুখে প্রেয়ার লাইনে দাঁড়ানো। একদিন ট্রেন লেট হলো তো ব্যস্ — ফার্স্ট পিরিয়ড মরাল সায়েন্স — সেখানে সিস্টারের মৃদু বকুনির মোড়কে সময়জ্ঞান সম্পর্কে গভীরতম শিক্ষাদান ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
শ্যামনগর স্টেশনের দু’নম্বর প্ল্যাটফর্মে ওভারব্রিজের সিঁড়ির কাছে একটা ঝাঁকড়া বটগাছের নিচেই আমার প্রথম প্রেমে পড়া। ঐ ভোরবেলা জেসপের কয়েকজন বয়স্ক কাকু ছাড়া সহযাত্রী হিসেবে পেয়েছিলাম এক মুখচোরা তরুণকে, শিবপুর থেকে সদ্যভূমিষ্ঠ এক ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ার — ধর্মতলায় কোন একটা ফার্মে নতুন চাকরিতে ঢুকেছে। অসমবয়সী কাকুদের চেয়ে কাছাকাছি বয়সের ছেলেটির সঙ্গেই আড্ডা জমত বেশি — গাভাসকার-শাস্ত্রী-কপিলদেব, গৌরীপ্রসন্ন-হেমন্তের জুটি, বচ্চনের শরাবি থেকে এইচ এসের সিলেবাস, জয়েন্টের কোয়েশ্চনেয়ার, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হিসেবে যাদবপুর বেটার না শিবপুর — হরেক আলোচনায় কোথা দিয়ে যে কেটে যেত পঞ্চাশটা মিনিট, খেয়ালই থাকত না। একবার বাসে উঠে পড়লে আবার পরদিন ভোরের অপেক্ষা, কারণ আমার ইস্কুল ছুটি হতো একটা চল্লিশে। আমি দুটো চল্লিশের রাণাঘাট বা দুটো পঞ্চান্নর নৈহাটি ধরতাম। আর তার অফিস শেষ হতো সাড়ে তিনটেয়, সুতরাং —
ক্লাসে মিসেস ঘোষ, মিস মুখার্জি আর মিসেস কুন্ডুদের পড়ানো এমনিতেই মাথায় ঢুকত না, এবার পড়াশোনা আরোই গোল্লায় গেল। তার উপর নতুন বছর পড়তেই তার কাছ থেকে একখানা গ্রিটিংস কার্ড পেলাম — পুবের আকাশে লাল কমলা আবির ছড়িয়ে সূর্য উঠছে আর তার দিকে মুগ্ধভাবে তাকিয়ে রয়েছে একটি আত্মমগ্ন কিশোরী — নিচে ক্যাপশন, The day starts with crimson and you….
আমার সাড়ে সব্বনাশের যেটুকু বাকি ছিল হয়ে গেল।
ফলশ্রুতি, ইলেভেন থেকে টুয়েলভে ওঠার পরীক্ষায় পেলাম অসম্ভব ‘পুয়োর মার্কস’।
মায়ের আশাভঙ্গের বেদনাহত বকুনির সুতীব্র অভিঘাতে নভিস প্রেমিকা আমি গ্যালগ্যাল করে উগরে দিলাম হৃদয় হরণের রোমাঞ্চকর কাহিনী।
মা চুপচাপ শুনল। বাবার সঙ্গে কি গুজগুজ করল কে জানে, খানিক বাদে আমাকে বাবা এসে বলল — ‘ছেলেটার ঠিকানাটা দে’।
দু’দিন পরে দেখলাম মূর্তিমান দন্তবিকশিত করে আমাদের কোয়ার্টারে হাজির, সঙ্গে বাবা। সে নাকি আমাকে ফিজিক্স আর অঙ্ক দেখিয়ে দেবে, সপ্তাহে দু’দিন। বাবার অনুরোধে রাজি হয়েছে — কি যেন এক আত্মীয়তাও বেরিয়ে গিয়েছে তার মায়ের সঙ্গে আমার বাবার দিকে।
উল্লসিত হয়ে উঠলাম। পড়া কিন্তু হাহা হিহি আর একতরফা বিমুগ্ধ চাহনির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল, বেশিদূর অগ্রসর হতে পারল না। একদিন সকালের ট্রেনে এই নিয়ে অনুযোগ করে বসল ছেলেটি, আর আমি হাঁদার মতো স্বীকার করে ফেললাম নিজমুখে, ‘কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া,
তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া—‘ ইত্যাদি ইত্যাদি।
ফল হলো ভয়ঙ্কর। প্রচন্ড ক্ষেপে উঠে সেই প্রেমিকপ্রবর আমার ষোলো বছরের সদ্যপ্রস্ফুটিত প্রীতির কমলটিকে নির্মমভাবে দু’পায়ে দ’লে, মাড়িয়ে জানিয়ে দিল, সে তো আমাকে ছোট বোনের মতোই দেখে এসেছে, গল্প করেছে, পড়াতে এসেছে — এইসব কলুষিত চিন্তা মনে আনার কথা কল্পনাও করেনি কোনোদিন!
আমাদের ট্যাঁশ লরেটোতে সেদিন স্কুল ফেস্ট ছিল — কমিউনিকে। ফেস্টে শাড়ি পরে যাবার অনুমতি ছিল বলে পরেছিলাম — জীবনে প্রথমবার। সেদিন সেই আকাশি রঙের শিফনের আঁচলে নাক মুছতে মুছতে শিয়ালদায় নেমেছিলাম।
তারপর থেকে একা যাতায়াত করলে লেডিজ ছাড়া অন্য কোনো কম্পার্টমেন্টে আর কখনো উঠিনি আমি।
হায়ার সেকেন্ডারিতে এগারো বারো ক্লাসের সম্মিলিত সিলেবাস শেষ করার জন্য সর্বসাকুল্যে বছর দেড়েক সময় পাওয়া যেত তখন, তারপরেই টেস্টের চোখ রাঙানি। অচিরাৎ দেখলাম শিয়রে এইচ এস, আর তার পিছনেই হাত বাড়িয়ে কড়া নাড়বার জন্য দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে জয়েন্ট এন্ট্রান্স। জয়েন্ট ফয়েন্ট হবে না, তবে হায়ার সেকেন্ডারিতে একটু ভদ্রস্থ নম্বর না তুলতে পারলে কোনো ভদ্রস্থ কলেজে গ্র্যাজুয়েশন করাও হয়ে উঠবে না জানতাম। কিন্তু তাতেও পড়ায় চাড় নেই মায়ের মেয়ের — ইস্কুলের একমাত্র ভাল লাগার দুটি সাবজেক্ট বাংলা আর ইংরেজির পাঠ্যগুলি ভোরবেলার জনবিরল লেডিজ কম্পার্টমেন্টে জোরে জোরে পড়তে পড়তে আসি, ঘুমজড়ানো উদাস চোখে কৌতূহলহীন দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে দেখে কোনো চালওয়ালি মেয়ে বা নার্সিংহোমের আয়া।
ফেরার পথে ইস্কুলের লাইব্রেরি থেকে নেওয়া কিরীটী অমনিবাস বা নীললোহিতের ‘সুদূর ঝর্নার জলে’ গিলতে গিলতে যাই, বাড়ি ফিরলে মা হাতে গল্পের বই দেখলে পিঠে হাতপাখা ভাঙবে।
যত মুখচোরাই হই, ঐ দেড় বছরে সমমনস্ক জনা ছয়-সাত নন-ট্যাঁশ, আমারই মতো ‘হংসমধ্যে বক যথা’ ষোড়শীকে ততদিনে আবিষ্কার করে ফেলেছি কেতার লরেটোতে। পিয়া, শুক্তি, সুমিতা, ঈশিতা, সপ্তর্ষি(মেয়ে কিন্তু), দেবস্মিতা আর সুলা। আমাদের সেই ছোট্ট গ্রুপে মিসেস ঘোষের লিপস্টিকের রঙ, সিস্টার আরসুলার পাঁউরুটির স্লাইসের মতো ফিগারেও সবসময় গাউন সামলানো, দেবস্মিতার ব্যারি ও’ব্রায়েনের উপর ইনফ্যাচুয়েশনের করুণ দাস্তান, হিস্ট্রি সেকশনের শর্মিলার মিস ক্যালকাটা কনটেস্টে যোগদানের মতো চুটকি গল্পগাছা ছাড়া লেখাপড়ার কথাও মাঝেমধ্যে আলোচনা হতো বৈকি।
তবে পড়াশোনার আন্তরিক তাগিদটা কিছুতেই আসছিল না আমার। মায়ের রক্তচক্ষু, বাবার নিঃশব্দ মিনতি, কিছুই যেন আমাকে সেভাবে বইমুখো করতে পারছিল না। বাড়ি ফিরে সায়েন্স সাবজেক্টের কোনো বই হাতে নিলে, ঘন্টাখানেক পর থেকে ঢুলতে আরম্ভ করতাম।
এইচ এসের মাস দুই আগে বাবা একদিন অফিস থেকে ফিরল একটা ইনল্যান্ড লেটার হাতে করে। আমার নামে চিঠি। ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী আমার সুভদ্র বাবা চিঠিটা খোলেনি। কিন্তু আমার হাতে পড়ার আগেই সেটা মায়ের হাতে পড়ল আর নাড়ির প্রবল টানের অধিকারবলে মা সেটিকে তুরন্ত ছিঁড়ে পড়ে ফেলল। তারপর ছুঁড়ে দিল আমার দিকে।
সংক্ষিপ্ততম চিঠি।
বেস্ট অফ লাক ফর কামিং জয়েন্ট এন্ট্রান্স অ্যান্ড এইচ এস এক্সাম। ইওর —- দাদা। ‘দাদা’ শব্দটা ক্যাপিটাল লেটারে লেখা। ঠিকানাও দিয়েছে। দেখলাম দিল্লির কোন এক মহল্লার অ্যাড্রেস।
কয়েক নিমেষ লাগল ব্যাপারটা বুঝতে। মাথার ন্যাতানো রাগের পলতেটায় যেন আগুন ধরে গেল।ঝাংঝাং করে বেজে উঠল অপমানাহত কিশোরমনের সবক’টা তন্ত্রী। বাবা-মায়ের বিস্মিত চোখের সামনেই চিঠিটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে রান্নাঘরের কোণে ময়লার বালতিতে ফেলে এলাম।
কথায় বলে, প্রতিটি পুরুষের সাফল্যের পিছনে একজন নারীর অবদান থাকে। উল্টোটাও বোধহয় মিথ্যে নয়। সেই ১৯৮৬ সালে, সতেরো বছর বয়সের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আমার মতো আলসে বেড়ালের কপালে যেটুকু শিকে ছিঁড়েছিল, তার পিছনে ঐ দু’লাইনের চিঠিটার অবদান এই অবেলায় অগ্রাহ্য করলে আমার পাপ হবে।
ঝপাঝপ রুটিন তৈরি করে ফেললাম পড়ার। আর পরের দিন থেকেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম দত্ত পাল চৌধুরী, চক্রবর্তী চ্যাটার্জি আর লাডলি মোহন মিত্র-র উপরে। আড়াই মাসের মধ্যে আর মাথাটি তুলিনি।
সারা ইস্কুল এমন কি প্রিন্সিপ্যাল সিস্টার আরসুলাকে পর্যন্ত বিমূঢ়, বিস্মিত করে সেই বছরের লরেটো হাউসের সায়েন্স সেকশনের পঁয়ত্রিশটি মেয়ের মধ্যে আটজন ডাক্তারিতে সুযোগ পেয়েছিল জয়েন্ট এন্ট্রান্সে। আমিও তাদের মধ্যে গুঁতিয়ে ঢুকে পড়েছিলাম কি করে যেন!
হায়ার সেকেন্ডারিতে মোটামুটি ভদ্রস্থ নম্বরই জুটেছিল আমার, যদিও মায়ের আশানুরূপ হয়নি সেই রেজাল্ট। কোনো বিষয়েই লেটার মার্কস ছিল না যে।
জীবনের শেষ বাংলা পরীক্ষায় দু’নম্বরের জন্য মিস করেছিলাম লেটার মার্কস। ট্যাঁশ লরেটোর ইতিহাসে অভূতপূর্ব না হলেও অভাবনীয় নম্বর বাংলার মতো ব্রাত্য বিষয়ে।
আজ প্রায় চার দশক পরে, সেই ফ্যাশনিস্তা ইস্কুলের ক্লাসমেটদের মধ্যে মাত্র দু’জনের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। পিয়া আমারই সঙ্গে ন্যাশনাল মেডিক্যালে ডাক্তারি পড়তে ঢুকেছিল — আজ কলকাতার প্রখ্যাত গাইনেকোলজিস্ট ডঃ পিয়া রায়, দেশি বিদেশি গন্ডাখানেক সম্ভ্রান্ত ডিগ্রির অধিকারিণী — বাইপাসের ধারের ঝাঁ চকচকে হাসপাতালগুলি তাকে কনসালট্যান্ট হিসেবে পাওয়ার জন্য সর্বদাই উৎসুক। আর অন্যজন শুক্তি — ডঃ শুক্তি মুখার্জি, কলকাতা কর্পোরেশনের অন্যতম ডেপুটি চিফ মিউনিসিপ্যাল হেলথ অফিসার, ঘটনাচক্রে সে আমার বর্তমান বস।
আর সেই বিপথগামী লিটারেচরের ছাত্রীটি এখন অবসন্ন ফেসবুক কলমচি —
‘অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয় —
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়’ যার ‘অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে’;
তাকে ‘ক্লান্ত করে, ক্লান্ত– ক্লান্ত করে;’