*বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ : ইহা ভ্রমণ কাহিনী ভাবিয়া কেহ ভ্রম করিবেন না।
দি দীঘা
———–
ছেলের ক্লাস ফাইভ, মেয়ে নাইন। হিন্দি সিনেমার এফেক্ট কিনা জানি না, মুখ ফসকে বলে ফেললাম, একবার ‘গোয়া’ গেলে হয়।প্রত্যাঘাত আসতে মুহূর্ত বিলম্ব হলো না, তোমার ভীমরতি হলেও আমার তো হয় নি।ছেলে মেয়েকে নিয়ে উনি নাকি এখন গোয়া যাবেন। ভীমরতি আর কি!
ভীমের রতিক্রিয়া নিয়ে বিন্দুমাত্র জ্ঞান না থাকায় এ যাত্রা চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে হলো।
অগত্যা ‘দীপুদা’র দী। তখনকার দিনে মধ্যবিত্তের হাত বাড়ালেই সাগর — আমাদের দীঘাসুন্দরী। তখনও ‘মন্দারমণি’ও পথের মাথার মণি হয়ে ওঠে নি।
কোলকাতা থেকে সকাল সকাল বাসে উঠলেই সাগর পাড়ে মধ্যাহ্নভোজ।
সে যুগে দীঘা ছিল গৃহপালিত গৃহবধূর মুক্তির আকাশ, আনন্দের সাগর। শেষ মুহূর্তে লাগেজ ব্যাগে সযত্নে ঢুকে যেত প্যাকেটে মোড়া সদ্য কেনা সালোয়ার কামিজ। অবশ্যই, ‘বৌমা ওটা কি কিনলে’-র চোখ বাঁচিয়ে। ঐ পোশাকই দীঘাতে ক’দিন স্যুইমিং কস্টিউম থেকে স্লিপিং গাউন।
সে যাক গে। আমি তো উলুবেড়িয়ায় পঞ্চাশ কিলোমিটার এগিয়েই আছি। প্রশ্ন হলো দূরপাল্লার বাস দাঁড়াবে কিনা?
সমাধান এলো। সক্কাল সক্কাল উঠে একটু চেকপোস্টের ট্রাফিক পুলিশকে বললে বাস দাঁড় করিয়ে দেয়।
সেই মতো সকাল বেলাই চারমূর্তি চেকপোস্টের ট্রাফিক গার্ডে হাজির। মনে ভয়, দীঘার বাস না দাঁড়ালে ছেলে মেয়ে মায় তদীয় জননীর কাছে পেস্টিজ পাঞ্চার আর কি!
এগিয়ে এলেন ট্রাফিক গার্ড, আপনি তো এস আই (ই এস আই) এর মেয়েছেলের ডাক্তার।
আমি বুঝলাম না, এ সম্ভাষণে আমার গর্বিত না লজ্জিত হওয়া উচিত। গিন্নির মুখের দিকে তাকালাম। এটা আমার বদভ্যাস। যখনই ঘাবড়ে যাই তখনই ওখান থেকে সাহস সঞ্চয় করি। এই মুহূর্তে যেমন পড়ে নিলাম,– যাই বলুক, তোমার কাজটা করিয়ে নাও।
উনি এগিয়ে এসেছেন, দীঘা যাবেন তো! বাস দাঁড় করিয়ে দিচ্ছি।
সুতরাং— দীঘার সৈকতাবাসে ঢেউ গুনতে গুনতে যথাসময়ে মাছ ভাত।
হোক না ঢেউ এর দাপট কম, তবু সপরিবারে সে সমুদ্রে-স্নানে বড়ই মজা। কিন্তু গিন্নির সদা সতর্ক দৃষ্টির বায়নাকুলারে ধরা পড়েছে এক উদ্ভিন্ন-যৌবনা তরুণ তরুণীর স্নানদৃশ্য ও জলকেলি।
—একটু পাশেই ঐ দিকে চল। ঢেউগুলো আরো বড়,বীচটাও সুন্দর।
আমি ভ্রূ-ভঙ্গি লক্ষ্য করেছি। ছেলে মেয়েরা তো ছোটবেলা থেকেই এ পাঠে অভ্যস্ত।
মেয়ে একবার ভাইকে ফিসফিসিয়ে বলছে শুনেছি, মা-এর ভ্রূ আর বাবার কপাল লক্ষ্য করবি। ওখানে কুঞ্চনরেখা দেখলেই, বি এলার্ট। নির্দেশের অপেক্ষায় থাকবি। মা-এর ভ্রূ-এর নীচেই অক্ষিগোলকের ঘূর্ণায়নেই থাকবে পরবর্তী নির্দেশ। সেই মতো গুটিগুটি পা-এ চললাম পাশের বীচে। এ পদক্ষেপ কার চিত্তশুদ্ধির জন্য তা আজও আমার অজানা।
গো গোয়া
‐—————-
ছেলে এসে বলল, চলো এবার পুজোয় গোয়া যাই।
আমার সেই পুরনো অভ্যাস যায় নি। ভ্যাবলা হয়ে গিন্নির মুখের দিকে তাকালাম।
-তোরা গোয়া যাবি যা না। আমাদের নিয়ে আবার টানাটানি কেন? –সতর্ক গিন্নি।
না না দিদিভাই এর সাথে কথা হয়ে গেছে, এবার সবাই মিলে গোয়া’য় পূজো।
ও, তার মানে ষড়যন্ত্র আগেই হয়ে গেছে, এখন শুধু রূপায়ণ।
—আরে চলোই না। তোমাদের কোনো মাথা ঘামাতে হবে না। জাস্ট গো,রিল্যাক্স এণ্ড এনজয়।
ছেলের শেষ কথাগুলোয় গিন্নির টনক নড়ল, —মনে রেখো নাতনি যাচ্ছে। তার খেয়াল তোমায় রাখতে হবে। ওর হাত সবসময় ধরে থাকবে।
ব্যাস ব্যবস্থা হয়ে গেল, স্বপ্নের গোয়া তটে নাতনি হাতে সচিত্র বিজ্ঞাপন, — আমি এক বুড়ো দাদামশাই, আমার এক এত্তো বড়ো নাতনি আছে।
অবশেষে নাতনির হাত ধরেই গিয়ে পড়লাম গোয়ার সমুদ্র সৈকতে। আহা জীবন কতো সুন্দর। এখন আর গিন্নির হাতটানে পাশের বীচে গিয়ে কোনো লাভ নেই। এ বলে আমায় দ্যাখ ও বলে আমায়।
জর্জ বিশ্বাসের গলা যেন গমগমিয়ে উঠছে, জগতের আনন্দ যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ।
নর্থ গোয়ার বাগা বীচে সত্যিই এক আনন্দ যজ্ঞ। মানুষ যেন পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ শুষে নিচ্ছে।
গিন্নির মধ্যেও বেশ উদাস উদাস ভাব। চোখে-মুখে কোথাও নেই কোনো গোয়াতঙ্ক। –বুঝলে এতো সভ্য ভদ্র সী-বীচ আমি আর দেখি নি।
একদম খাঁটি কথা।
আপনার পোশাক আপনার পরিচয় নয়, আপনার ব্যবহারই আপনার পরিচয়।
সাউথ গোয়ার বীচে আবার এক অদ্ভুত উদাসীন অবসর যাপন।পৃথিবীর কোথাও কারো তাড়া আর ব্যস্ততা আছে বলে মনে হয় না। খাও-পিও-জিও-র এক সুন্দর বিজ্ঞাপন।
মাঝ সমুদ্রে ক্যানো-এ ভাসমান স্বল্প বসনা একাকী এক মহিলাকে দেখে মনে হলো সুন্দরী গোয়ার এর চেয়ে ভালো বিজ্ঞাপন আর হয় না ।
গোয়ার আবেশে গিন্নিও দেখি তার আইন মোতাবেক সন্তানকে (সন-ইন-ল) বলছেন, তোমার আই ফোনে এই ছবিটা তোলো তো দেখি।
সত্যিই গোয়ার আবহ সঙ্গীত এমনই।
আমি কিন্তু আছি আমার গার্ল ফ্রেণ্ডের হাত ধরেই।