শীতের রোদ পোহাতে আমাদের পরিচিত বুড়ো হাতুড়ে ভাড়া বাড়ির সামনে রাস্তায় বসেছিলেন। চারপাশে ঝগড়ার চিলচিৎকার, কান্নার শব্দ। এটা একটা বস্তি এলাকা। হাতুড়ে দোকানে খেয়ে এসে’ সামনের রাস্তার পশ্চিমা রোদ্দুর গায়ে মাখছিলেন। খেয়ালই করেননি, কখন যে পাশে বুড়ো হাসা টুডু এসে বসেছে। হাসা মানে পৃথিবী। ওর ভাষায় পির্থিমি। ওর এককালের বলিষ্ঠ পেশীগুলো আজ শিথিল। গায়ে প্রকটভাবে তেল মাখা। স্যান্ডো গেঞ্জির ওপরে পুরোনো তুষের চাদর জড়ানো, নিচে ধুতি।
“হেই হেতুড়ে, শুইনছিস? চারদিক থেকে চিল্লাচিল্লি আসছেক!”
হাতুড়ে বলেন “হুঁ”
“হ্যাঁ রে যখুন গেরামে ছিল্যম, তখন জমি জিরেতের ল্যেঁগে খুনাখুনি হঁইয়েছেক, কিন্তু এখানে দিনমানে, রেতে ইয়াদের চিল্লাচিল্লি ঝগড়া চলছেই বঁটে….ক্যানে বলতো? এই বুঢ়া বয়সকালে ইসব কী লাঁগাইছে ইয়াঁরা? এখানে তো দুবেলাকার ভাতটঁ জুটে….তবু এ্যামুন ক্যানে?”
হাসা একটা বিড়ি হাতুড়েকে দিয়ে নিজে একটা ধরায়।
হাতুড়ে বিড়িটা ধরিয়ে বলে “তাহলে শুন ক্যানে… মস্ত বড়ো গল্প বঁট্যে….টুকুন শুনে দ্যাখ….”
রোদ জমে উঠেছে, ওম লেগে শরীর গরম হয়ে উঠেছে। হাতুড়ে গল্প শুরু করে।
“পাখিরা ভোর থেকে উঠে পড়ে, চারপাশে গান জোড়ে। আর দিনের আলো যখন কমে আসে, পাখিরা তখন নিজের বাড়ি ফিরতে থাকে, সব পাখি ঘরে ফেরে, সব নদী… তারপর আলো নিভে এলেই পাখিদের চোখ বন্ধ হয়ে আসে। কেন জানিস? দিনের আলো নিভে গেলেই আমাদের শরীরে একটা হরমোন বেরোতে শুরু করে-তার নাম মেলাটোনিন। এটা সবাইকে ঘুম পাড়ায়, ক্লান্ত করে, পেশীগুলোকে ক্লান্ত করে তোলে, মাথার কাজ করার ক্ষমতা কমিয়ে দ্যায়- তখন সবাইকার ঘুম পায়। শরীরের মধ্যে একটা ঘড়ি আছে….সেটা এসব ঠিকঠাক চালায়”
“আলো আঁধারির সনে এগুলার কি সম্পর্ক?”
“মুশকিল করলি রে হাসা..আসলে আমাদের মাথার ভেতরে একটা গ্ল্যান্ড আছে, পাইন ফলের মতো দেখতে বলে ওটাকে পিনীয়াল গ্ল্যান্ড বলে। এটা থেকে দুটো হরমোন বেরোয়–সেরেটোনিন আর মেলাটোনিন। প্রথমে বেরোয় সেরেটোনিন, এটা ট্রিফটোফ্যান থেকে তৈরি হয়। তারপর সেরেটোনিন অ্যাসিটাইলেটেড হয়ে মেলাটোনিন তৈরি হয়।”
“ইসব কি বকতেছিস, উরগুম(পাগল) হ্যঁলি বঁট্যে?”
“হ্যাঁ রে হাসা, মাথাটাই বিগড়ে গেছে আমার…” হাতুড়ে হাসে। তারপর আবার শুরু করে “আমাদের চোখ থেকে কিছুটা আলো ঐ পিনীয়াল গ্ল্যান্ডে চলে যায়। আলো পড়লেই-সব মেরুদন্ডী প্রাণীর ঐ পিনীয়াল গ্ল্যান্ড থেকে সেরেটোনিন বেরোতে শুরু করে, সেই প্রাণীরা সজীব,সক্রিয় হয়ে ওঠে, যৌন হর্মোন বেরোতে থাকে, গ্রোথ হরমোন বেরোনো শুরু হয়। আর আলো কমে এলেই ঐ সেরেটোনিন অ্যাসিটাইলেটেড হয়ে মেলাটোনিন হয়ে যায়, মাথা নিস্তেজ হয়ে আসে, যৌন হরমোন কমে আসে (Holst SC, Valomon A, Landolt H; Xie Z,Chen F,Wa L)।দেখা গেছে যে বুড়োদের ঘুম হয় না, তাদের মেলাটোনিন রিসেপটার কমে আসে। আসলে মেলাটোনিন আমাদের ঘুমিয়ে পড়তে সাহায্য করে আর সেরেটোনিন খুশি থাকতে”
“কিন্তু ঝগড়াট্যোঁ ক্যানে হয়, উটো তো বুল্যাঁ করবি?”
“আমেরিকায় মোট প্রাপ্তবয়স্কদের শতকরা পাঁচ ভাগ লোক শীতকালে হতাশায় ভোগে। কেননা শীতকালে আলো কম। এটাকে মরশুমী হতাশা (seasonal affective disorder) বলা যায়। হতাশার পরিমাণ কম হলে বলা হয় উইন্টার ব্ল্যু। এটা মেয়েদের বেশী হয়। উইন্টার ব্ল্যু-তে আমেরিকার জনসংখ্যার শতকরা প্রায় কুড়ি ভাগ লোক ভোগে।
স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় যেহেতু শীতকাল খুব লম্বা,পুরো শীতকালটাই ওদের রাত্রি, দীর্ঘ ছ’মাস ব্যাপী- তাই ওখানেও প্রচুর মরশুমী হতাশার রোগী পাওয়া যায়।
যেহেতু সূর্যের আলো এই সেরেটোনিন তৈরিতে সাহায্য করে, তাই যেসব লোকের শরীরে সেরেটোনিন এমনিতেই কম আছে-শীতে কম আলো তাদের সেরেটোনিন আরও অনেক কমিয়ে দিয়ে মেজাজ (mood) আরও বিগড়ে দ্যায়। তারা খুশি থাকতে পারে না। অবসাদে চলে যায়। বুঝলি হাসাবুঢ়া?”
“বুঝলম রে হেতুড়ে, তাহলে আলো জ্বালাল্যে পরে’ উয়ারা ভালো হঁয়ে যাবেক?”
হাতুড়ে হাসেন “হ্যাঁ রে হাসাবুঢ়া, বিদেশে ঠিক দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল আলো তৈরি করে’ সেটা থেকে আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি ছেঁকে নিয়ে, রোগীর কাছে জ্বালিয়ে রাখা হয়। যেখানে খায়, লেখাপড়া করে, কাজ করে-সেই স–ব জায়গায়। এতে তিন চার দিন পর থেকেই উপকার পাওয়া যায়। অনেক সময় তার সঙ্গে হতাশা কমানোর ওষুধ খেতে হয় আর হতাশার অন্যান্য কারণ কমিয়ে দিতে হয়। দেখা গেছে রাতে নীল রংয়ের হালকা আলো জ্বেলে রাখলে হতাশা কম হয়।”
হাসাবুড়ো যেতে যেতে বলে “কে আমাদের জীবনে আলো জ্বালিয়ে দেবে… কে জানে……”
রোদ পড়ে এসেছে-নিভে আসছে সূর্য, বুড়ো হাতুড়েও নিজের কুঠুরিতে ঢুকে পড়ে।