পালঙ্ক আলো করে শুয়ে আছে একরত্তি খোকা। ঘরের এক কোণে জ্বলছে রেড়ির তেলের সাঁঝ বাতি। বড় বড় ডাগর চোখ মেলে খোকা সেদিকেই তাকিয়ে আছে , আর মাঝে মাঝেই ফুটফুটিয়ে হাসছে। খোকার মা তার পাশেই কাৎ হয়ে শুয়ে খোকার এই সব কাণ্ডকারখানা দেখছে আর ছেলের তালে তাল মিলিয়ে এক অবুঝ ভাষায় কথা কইছে। খোকাও বেশ মজা পেয়েছে।
দেউড়ির ঘন্টা বেজে ওঠে ঢং ঢং করে। মা এবার প্রমাদ গোণে! রাত দশটা বেজে গেল, অথচ তাঁর খোকা এখনও জেগে রয়েছে! কপট রাগ দেখিয়ে মা খোকাকে শাসন করে – “অনেক রাত হয়েছে, এবার ঘুমোও। এখনও খেলা করলে , আমি খাব,শোব কখন?”
এমন সময় ঘরে ঢোকেন খোকার ঠাকুমা। “কী হলো বৌমা ? রাগারাগি কিসের? ও কায়দায় তোমার খোকার চোখে ঘুম আসবেনা। তুমি যাও খেয়ে এসো। গিরীন তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।”
ঘুমহীন চোখে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকা ছেলের থেকে ক্ষণিকের জন্য মুক্তি। মনে মনে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে মা বলে– “ বেশ হয়েছে ! আমার কথা তো শুনলি না, এবার ঠাকুমার জিম্মায় থাক্।” বৌমা ঘর ছাড়তেই শ্বাশুড়ি মা হার্মাদ নাতিকে সামলানোর কাজ শুরু করেন। প্রথমেই চাবি ঘুরিয়ে সাঁঝ বাতির আলো খানিকটা কমিয়ে দেন। তারপর বিছানায় উঠে দামাল নাতিটিকে নিজের দিকে পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে মাথায় পিঠে আলতো করে আঙুল চালাতে শুরু করেন। খোকা বুঝতে পারে যে তাকে দেখভালের দায়িত্ব এখন আন্ জনের হাতে, তবে সুড়সুড়ির আরাম তাকে খানিকটা বিবশ করে রাখে। ঠাকুমা নাতির শরীরে হাত বোলাতে বোলাতে মৃদু স্বরে গান ধরেন –
ঘুমপাড়ানি মাসি – পিসি
মোদের বাড়ি এসো,
খাট নাই পালঙ্ নাই
খোকার চোখে বসো।
বাটা ভরা পান দেব
গাল ভরে খাও,
খোকার চোখে ঘুম নাই
ঘুম দিয়ে যাও।
এতক্ষণ চোখ মেলে চেয়ে থাকা খোকার চোখ একটু একটু করে বুজে আসে ঘুমে। খোকা এখন গভীর ঘুমের দেশে।
যে সময়ের কথা দিয়ে আজকের কথা শুরু করছি সেই স্বপ্নালু সময়টাকে আমরা পেছনে ফেলে এসেছি অনেক অনেক কাল আগে। এ যুগে ঘর জোড়া পালঙ্ক নেই, রেড়ির তেলের সাঁঝ বাতি নেই, ঠাকুমারা আছেন বটে তবে এযুগে তাঁদের এই আগ বাড়িয়ে আদিখ্যেতা দেখানো নেই, ঘুমপাড়ানি মাসি পিসির দল এই কঠোর বাস্তবের দুনিয়ায় ঠাঁই না পেয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন কোন্ কালে! আর এইসব নস্টালজিয়ার মধ্যে রয়ে গিয়েছে কেবল অসংখ্য নাগরিক মানুষের নিদ্রাহীন চোখ। সেই চোখে এখন ইনসোমনিয়ার করাল ছায়াপাত।
রোগের নাম ইনসোমনিয়া, বাঙলায় নিদ্রাহীনতা। আমার পরিচিত এক প্রবীণ ডাক্তারবাবুর কথায় – নিদ্রাহীনতা হলো সময়ের অভিশাপ। কাকে বলে ইনসোমনিয়া? চিকিৎসা বিজ্ঞান কোন্ শব্দ বন্ধে সংজ্ঞায়িত করেছে একে ? আসুন একটু দেখে নেওয়া যাক্ । এই সময়ে বহুল চর্চিত ইংরেজি Insomnia শব্দটির আকর হলো ল্যাটিন শব্দ somnus ,যার অর্থ হলো স্লিপ বা ঘুম। এই শব্দটির আগে in- এই উপসর্গটিকে জুড়ে দিয়ে তৈরি করা হয়েছে মূল শব্দের বিপরীতার্থক শব্দ in + somnus = insomnus যার অর্থ হলো no sleep বা sleepless. বর্তমান সময়ে নিদ্রাহীনতার সমস্যাকে বিশেষ ভাবে বোঝাতে যে ইংরেজি শব্দটি ( insomnia ) ব্যবহার করা হয় তার প্রচলন ১৭০০ শতকে। এই অবসরে সেই ইতিহাসের পাতাগুলো একবার উল্টেপাল্টে দেখে নেওয়া যাক্।
নিদ্রাহীন অবস্থাকে সরকারিভাবে নতুন শব্দবন্ধের দ্বারা নির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করার বহুকাল আগে থেকেই এই রোগটি সম্পর্কে পরিচিতি ছিল। আমাদের রূপকথার গল্পে আর আখ্যানে নিদ্রা
প্রসঙ্গ উঠে এসেছে নানান কাহিনির অনুষঙ্গে। আরব্য রজনীর গল্পগুলো পাতা ভরে আমাদের নজর টেনেছে ঐ ইনসোমনিয়া আক্রান্ত এক শাহজাদার আজব খেয়ালকে ঘিরেই। সুতরাং ঘুম নিয়ে মানুষের উদ্বেগ উৎকণ্ঠার পাশাপাশি, চর্চাও বহুদিন ধরেই চলছে।
Eluned Summers Bremner নামে নিউজিল্যান্ডের এক ঐতিহাসিক আনুমানিক ২৭০০ খৃষ্ট পূর্বাব্দে আজকের ইরাক বা তৎকালীন মেসোপটেমিয়ার সুপ্রাচীন মহাকাব্য Gilgamesh’ এর পাতায় এক কাহিনিতে এই রোগের কথা লিখিত আছে বলে জানান। গল্পটি – জনৈক প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুর পর শোকাহত অন্যান্য বন্ধুদের আচরণগত অবস্থা ও নিদ্রাহীন থাকার সমস্যা নিয়ে লেখা।
এই সময়ের বুকে দাঁড়িয়ে American Sleep Association নিদ্রাহীনতাকে ব্যাখ্যা করেছে আমাদের ঘুমিয়ে পড়া ও ঘুমিয়ে থাকার সমস্যা হিসেবে। তাদের মতে এটি কোনো একক সমস্যা নয়, বরং বলা যায় বিভিন্ন ধরনের নিদ্রাহীনতাকে একটি সাধারণ ছাতার তলায় আনার চেষ্টা মাত্র। যদি আপনার ইনসোমনিয়া থাকে তাহলে আপনি কয়েক দিন থেকে কয়েক মাস বা কয়েক বছর ধরে নিদ্রা বিঘ্নিত হবার সমস্যার শিকার হতে পারেন। আপনার একান্ত কোনো শরীরী সমস্যা থাকলে এই অবস্থা দেখা দিতে পারে, অথবা আপনার স্নায়ুতন্ত্রের কোনো ত্রুটির কারণে আপনি ইনসোমনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারেন।
নিদ্রাহীনতার কারণ যাই হোক না কেন, এটি আক্রান্তের জন্য এক দুঃখের পর্ব বয়ে নিয়ে আসে। এমন একজন মানুষকেও বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবেনা যিনি উচ্চকন্ঠে খুশি মনে চিল্লিয়ে উঠে ঘোষণা করবেন – “আমি একজন নিদ্রাহীন মানুষ, আমি ঘুমোই না।” আসলে নিদ্রা মানে তো শুধু চোখ বন্ধ করে থাকা নয় , নিদ্রার সঙ্গে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে আছে একজন মানুষের শারীরিক ও মানসিক আরাম এবং স্বস্তি। তাই কেউ নিদ্রাহীন হয়ে এক বা একাধিক রাত কাটাতে বাধ্য হলে তা তার শরীর স্বাস্থ্য, মানসিক চলন, মানসিক স্থিরতা, মনোনিবেশ করতে পারার ক্ষমতা এবং কাজকর্মের ধরণ তথা জীবনের ওপর গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। চিকিৎসকদের মতে আপনি যত উদ্বেগ করবেন, দুশ্চিন্তা করবেন ততই আপনি এই কষ্টকর পরিস্থিতির শিকার হয়ে উঠবেন। সুতরাং উদ্বেগ দূর করুন।
এবার দেখে নেওয়া যাক্ চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ইনসোমনিয়া কত রকমের হতে পারে । নিদ্রাহীনতার পেছনের কারণগুলোর বিচারে ইনসোমনিয়াকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে –
প্রাথমিক বা প্রাইমারি ইনসোমনিয়া
যখন অন্য কোনো বিশেষ শারীরিক সমস্যা বা অবস্থা ছাড়াই ঘুমহীনতার শিকার হতে হয় তখন তাকে প্রাথমিক ইনসোমনিয়া বলে। এক্ষেত্রে নিদ্রাহীনতার ঘটনার সঙ্গে অন্য কোনো শারীরিক দুর্বলতা বা ওষুধপত্র গ্রহণের বিষয়টি জড়িত নয়। তাই প্রাথমিকভাবে এইটি নিদ্রাহীনতারই সমস্যা। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এইটি একান্ত ভাবেই
ঘুমের অনিয়ম যার পেছনে circadian rhythm disorders , পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যা, উৎকণ্ঠা, মানসিক চাপ বা অস্থিরতা , এবং অস্বাস্থ্যকর ঘুমের অভ্যাস দায়ী। অন্যদিকে –
সেকেন্ডারি বা গৌণ ইনসোমনিয়া
এই ধরনের নিদ্রাহীনতার সমস্যার পেছনে আক্রান্ত মানুষটির একান্ত শারীরিক বা দৈহিক অবস্থাই মূলত দায়ী থাকে। সেকেন্ডারি ইনসোমনিয়ায় আক্রান্ত মানুষেরা নিরবচ্ছিন্ন স্বস্তিদায়ক দীর্ঘায়িত ঘুমের পরিবর্তে গোটা পর্বটি কতগুলো বিচ্ছিন্ন খণ্ড খণ্ড পর্বে সম্পন্ন করেন। যে সব মানুষ হাঁপানি, ডিপ্রেশন বা মানসিক অবসাদ,আর্থারাইটিস, ক্যানসার , হৃদ কম্পন, অথবা ব্যথা বেদনায় ভুগছেন কিংবা নিয়মিত মদ্যপানে আসক্ত তাদের মধ্যে সেকেন্ডারি ইনসোমনিয়ায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি।
এই দুই প্রধান শ্রেণির ইনসোমনিয়া ছাড়াও আরও কয়েক ধরনের ইনসোমনিয়ার কথা আমাদের জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এদের মধ্যে আছে
স্লিপ অনসেট ইনসোমনিয়া (যার অর্থ হলো ঘুমাতে যাওয়ার ব্যাপারে অনীহা ), স্লিপ মেইনটেন্যান্স ইনসোমনিয়া ( এক্ষেত্রে সারারাত ঘুমোতে না পারা অথবা খুব তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়া ), মিক্সড ইনসোমনিয়া ( এই ধরনের নিদ্রাহীনতার শিকার যারা হন তাঁদের ঘুমিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে ও সারারাত ঘুমিয়ে থাকার ক্ষেত্রে সমস্যা থাকে ) এবং প্যারাডক্সিক্যাল ইনসোমনিয়া ( এক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি মনে করেন অনেক সময় ধরে ঘুমিয়েছেন যদিও তা প্রকৃত নিদ্রা কালের তুলনায় অনেক কম )।
কেন আমরা নিদ্রাহীনতার শিকার হই ?
এ পর্যন্ত যতটুকু আলোচনা করা হয়েছে তার থেকে নিদ্রাহীনতার কারণগুলো হয়তো অনেকটাই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে ; তবুও সেগুলো সম্পর্কে আরও কিছু কথা খোলাসা করে বলা হলে কেউই হয়তো আপত্তি করবেন না। ইনসোমনিয়ায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা একান্তভাবে আমাদের মানসিক ও শারীরিক সুস্থিতি তথা সুস্থতার ওপর নির্ভর করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা অনুসারে প্রাথমিক বা প্রাইমারি ইনসোমনিয়ার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে –
স্ট্রেস বা মানসিক চাপ।
- এই সময়ের জটিল পরিস্থিতির কারণে প্রতিদিন আমাদের নানান ধরনের মানসিক নিপীড়ন সহ্য করতে হয়।অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কোভিড মহামারীর সময়ে আট থেকে আশি – সব বয়সের মানুষকেই গভীর সংকটময় আর্থসামাজিক অবস্থার সঙ্গে যুঝতে হয়েছে । চাকরি হারানো বা চাকরির ক্ষেত্র পরিবর্তন,আত্মজনের আকস্মিক মৃত্যু, বিবাহ বিচ্ছেদ বা অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হবার মতো ঘটনা নিদ্রাহীনতার অন্যতম কারণ।
- ঘুমের একটা নিরালা নিভৃত প্রশান্ত পরিবেশ দরকার। উজ্জ্বল আলো, অনাবশ্যক হৈচৈ, শব্দ সঙ্কুল পরিবেশ, স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি বায়বীয় উত্তাপ মানুষকে নিদ্রাহীনতার শিকার করে তোলে।
- অন্যান্য কাজের মতো ঘুমেরও একটি সুনির্দিষ্ট সময়তালিকা থাকা খুব জরুরি। নানান কারণে এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে তা ঘুমহীন রাত ডেকে আনে। দীর্ঘ বিমান যাত্রা,ওয়ার্ক শিফটের পরিবর্তন,ঘুম কাটানোর জন্য অন্যকিছু অভ্যস্ত হয়ে ওঠা ইনসোমনিয়াকে ডেকে আনে।
- আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে যে জিনগত কারণেও কেউ কেউ ইনসোমনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারেন।
অন্যদিকে যেসব মানসিক চাপ আমাদের মধ্যে সেকেন্ডারি নিদ্রাহীনতাকে ডেকে আনতে পারে সেগুলো হলো –
- দুর্বল মানসিক স্বাস্থ্য। মানসিক অবসন্নতা, বিষাদগ্রস্ততা, অখুশি মনোভাব -আমাদের মানসিক স্থিতির প্রতিকুল। ফল ইনসোমনিয়া।
- বিভিন্ন রোগের জন্য নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হয় যাদের তাঁদের মধ্যে অনেকেই নিদ্রাহীনতার সমস্যায় আক্রান্ত হন।
- বিশেষ কোনো কারণে ব্যথা বা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে আছেন যাঁরা তাঁদের মধ্যে নিদ্রাহীনতার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- নেশাগ্রস্ত মানুষের ঘুম কম হয়।
- যে সব মানুষের মধ্যে হাইপার থাইরয়েডের সমস্যা অথবা অন্য কোনো এন্ডোক্রোনিক সমস্যা রয়েছে তাঁরাও ঘুমহীন হয়ে রাত কাটাতে বাধ্য হন।
- যাঁদের মধ্যে স্লিপ এ্যাপনিয়া বা ঘুমের মধ্যে পা নাচানোর সমস্যা রয়েছে ইনসোমনিয়ায় তাঁরাও আক্রান্ত হতে পারেন।
- গর্ভবতী মায়েরা এবং মেনোপজের পর মহিলাদের মধ্যে এই সমস্যা উঁকি দিতে পারে।
- ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত মানুষের মধ্যেও ইনসোমনিয়া বাসা বাঁধতে পারে।
ইনসোমনিয়া প্রসঙ্গে এতো সব কথা পড়ে অনেকেই হয়তো মনে মনে ভাবছেন, “ মুখুজ্যে মশাই! সবই তো বুঝলাম, তা সহজে ঘুম পাওয়ার জন্য কয়েকটা টোটকা যদি বাতলে দেন, তাহলে যে বড় উবকার হয়!” এই বিষয়টি যে আমার মনেও ঘুরপাক খায়নি তেমনটা নয়। তাহলে আসুন নিদ্রা বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ করা কয়েকটি সাধারণ নিদ্রা বিধির সুলুক সন্ধান এ যাত্রায় আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিই।
নিদ্রাহীনতার সমস্যা সংক্রান্ত মার্কিন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ শ্রীমতি ব্রুনিল্ডা নাজারিও আমাদের জানাচ্ছেন – “বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ঘুম নিয়ে উদ্বেগ বাড়তে থাকে। অনেকেই হয়তো লক্ষ করেছেন যে সিনিওরিটি বাড়া মানেই হয়তো ঘুমের সময়টা খানিকটা নেড়ে ঘেঁটে যাওয়া। মাত্র কিছুদিন আগে যিনি এক ঘুমে রাত কাবার করে অন্যদের নাকের ডগায় তুড়ি দিতে অভ্যস্ত ছিলেন, তিনিই হয়তো এখন ঘুম আসছে না বলে উল্টো দিক থেকে ১০০ থেকে ১ টি ভেড়া গুনছেন। হয়তো লক্ষ করেছেন যে গোটা রাত আপনি পরম নিশ্চিন্তে চোখ দুটো বুজে থেকেছেন হয়তো সামান্য কিছু সময়ের জন্য অথবা দিনের বেলায় রাতের ঘুমের ঘাটতি মেটাতে গিয়ে বারংবার তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছেন।”
ঠিক কতটা সময় ধরে ঘুমালে একজন মানুষের ঘুমের ঘাটতি থাকবে না তা নিশ্চিত করে বলা সত্যিই মুশকিল; বিষয়টা সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তি সাপেক্ষ। তবে সাধারণভাবে বলা যায় যে রাতে ৭ থেকে ৯ ঘন্টা সময় ঘুমের খুব প্রয়োজন।
আমাদের মধ্যে যদি কারও মনে হয় যে বছর কয়েক আগেও যত সময় ঘুমালে শরীর বেশ তরতাজা লাগতো এখনও একই রকম অনুভুতি হচ্ছে তাহলে খুব একটা চিন্তা নেই, ইনসোমনিয়া আপনার কাছে হার মেনেছে। কিন্তু যদি মনে করেন যে আরও কিছু সময় ভালো ঘুমের দরকার তাহলে মনে রাখুন কয়েকটি সাধারণ নিয়ম।
- আপনার বিছানায় শুতে যাবার সময়টা নির্দিষ্ট করুন। প্রতিদিনই এক সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং একই সময়ে উঠে পড়ার অভ্যাস গড়তে পারলে আপনার শরীর ধীরে ধীরে এই নিয়মে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। যেদিন যেমন ইচ্ছে তেমন করলে জানবেন আপনার শরীর ঘড়ি বিগড়ে যেতে পারে।
- শোবার আগে কবোষ্ণ জলে স্নান করতে পারেন। তবে এ নিয়ম এদেশে খাটবে বলে মনে হয় না , কেননা গরমের দেশে এমনিতেই আমাদের শরীর তেতে থাকে।
- ঘুমতে যাবার আগে শরীর মন শান্ত করুন। এই বিষয়টি খুব জরুরি। চারপাশের একরাশ উত্তেজনা মাথায় নিয়ে শুতে গেলে ঘুম ঘুরে যাবে। যে সময় শুতে যাবেন তার অন্তত একঘন্টা আগে টেলিভিশন, মোবাইল ফোনের স্ক্রিন এসব থেকে দূরে থাকুন। সাম্প্রতিক কালে ইনসোমনিয়া আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবার পেছনে ইলেকট্রনিক্স উপকরণের প্রতি অতি আসক্তিকে দায়ি করা হচ্ছে। বালিশে মাথা দিলাম আর ঘুমিয়ে পড়লাম এমন মানুষ একালে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তাই যতক্ষণ না ঘুম আসছে ততক্ষণ কোনো বই পড়ুন, হালকা যন্ত্রসঙ্গীত শুনুন। মনে রাখবেন এ দুটো আশ্চর্য কার্যকর টোটকা।
- যখন তখন বিছানায় গা এলিয়ে দেবার অভ্যাস ত্যাগ করুন। যখন খুব ক্লান্ত লাগছে মনে হবে তখনই বিছানায় শুয়ে নিদ্রা দেবীকে আহ্বান জানান। মনে রাখুন বিছানা কেবলমাত্র শয়নের জন্য নির্ধারিত।
- আমাদের শাস্ত্র বচনে বলে মা দিবা সাপ্সি অর্থাৎ দিনের বেলা না ঘুমনোর চেষ্টা করুন। মনে রাখবেন, দিনের বেলায় যতক্ষণ আপনি ঘুমাবেন, রাতে ঠিক ততটা সময়ই আপনি কম ঘুমানোর সুযোগ পাবেন।
- নেশা সর্বনাশা । সব রকমের নেশাবস্তু বর্জন করুন। শোবার সময়ে অ্যালকোহল সর্বদা বর্জনীয়। মনে রাখবেন নেশা আপনার নিদ্ হারাম করে দেবে।
- রাতের দিকে কম জল পান করুন, বিশেষ করে রাত আটটার পর জলপানের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে। অন্যথায় টয়লেট ব্রেকের সময় আপনার স্লিপ ব্রেকের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
- ঘুমের তিন ঘণ্টা আগে কোনোরকম শারীরিক কসরৎ করবেন না। বলাই হয় after dinner walk a mile. সামান্য হাঁটাহাঁটি চলতে পারে খোলা মনে।
- দিনের কিছু সময় শরীরে সূর্যের আলো লাগান। এই প্রাকৃতিক আলো আর তাপ আপনার দেহ ঘড়ির ছন্দোময় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে দেবে।
এতোসব বিধি নিয়ম মেনে চলার পরেও যদি আপনার ঘুমের সমস্যা রয়েছে বলে মনে করেন তাহলে সোজা ডাক্তারবাবুর শরণাপন্ন হোন। ওরাই আপনার সমস্যার সমাধান বাতলে দেবেন নিদ্রালু নয়নে আপনার কথা শুনে।
এই লেখাটি লিখতে গিয়ে বহু দিন আগে লেখা একটি ছড়ার কথা আবার মনে পড়ে গেল। তখন সবে কলেজে ঢুকেছি। পাড়ার বন্ধুরা সবাই মিলে ঠিক করলাম একটা হাতে লেখা পত্রিকা বার করবো। সেই পত্রিকায় আমাদের বন্ধু রন্টুর ছোট ভাই থান্টুর এক আশ্চর্য প্রস্তাব নিয়ে লেখা হলো ছড়া। এটাও কিন্তু রাত ঘুমের এক মজার টোটকা। আগে পড়ুন সেই ছড়াটা।
রাত্তিরে তোমাদের
ঘুম যদি না আসে!
আঙ্গুলটা মুখে পুরে
চুষে যাও আবেশে।।
থিয়োরিটা মোর নয়,
থান্টুর তৈরি ,
আমাকে বলেছিল –
তার দাদা, শৌরী।
যাঁরা ইনসোমনিয়ায় ভুগছেন বা ভুগছেন না সবাই এই টোটকা পরীক্ষা করে দেখুন। ফলাফল জানাবেন।
পুনশ্চ:
ঘুমপাড়ানি গান দিয়ে এই গপ্পো শুরু করেছিলাম। ওই স্মৃতির ভাগ হবেনা। আঙুল চুষতে চুষতে ঘুমিয়ে পড়ার কাহিনিও শোনানো হয়েছে আপনাদের এককালে এই অধমের লেখা এক ছড়ার সূত্র ধরে। কিন্তু ঘুম পাড়ানোর জন্য যন্ত্রকে কাজে লাগানোর কথা শুনেছেন কখনও ,তাও আবার আমাদের এই খোদ কলকাতা শহরে ! ১৯২৫ সালের এক চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন আমাদের এমন তথ্যই পরিবেশন করছে।
বিজ্ঞাপনটি পড়ুন এবং তারপর? নাসিকা গর্জনে মুখরিত হোক আমাদের নিশি যাপনের পর্ব।
২১, ডিসেম্বর ২০২৪
মধ্যমগ্রাম।
ভালো লিখেছেন
ধন্যবাদ আপনাকে। আমি পেশাদার চিকিৎসক নই। তাই অনেক খোঁজখবর করে পড়াশোনা করতে হয়। তথ্যগত ভ্রান্তি যাতে না থাকে সেই বিষয়ে সচেতন থাকতে হয়। ভালো লাগলে ছড়িয়ে দেবার অনুরোধ রইলো।
লেখাটা পড়ে ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগলো। একজন চিকিৎসকের লেখা পাঠকের স্বীকৃতি পাচ্ছে ভেবে নিজের লেখনির ওপর বিশ্বাস বাড়ছে।
ছড়িয়ে পড়ুক অনেকের মধ্যে।
valo likhechen dada ❤️
Khub tothyosomriddho lekha
এমন হালকা মেজাজে ইনসোমনিয়া নিয়ে এতো মনোগ্রাহী একটি নিবন্ধ যে লেখা যায় তা এটি না পড়লে মালুম হয়তো হতোই না। এমন লেখা আরও আরও চাইই নতুন বছরেও।