জীবনের নানা উতর-চড়াইয়ের মধ্যেই ধীর নিশ্চিত পায়ে এগিয়ে আসছিল ডাক্তারির শেষ পরীক্ষা, ফাইনাল এমবিবিএস। সতেরোশো নম্বরের উপর পরীক্ষার্থীদের চুলচেরা মূল্যায়ন — স্লাইডের উপর আণুবীক্ষণিক কোষকে দেখার মতো করে পরীক্ষার্থীর মেধার নির্যাসটুকু দেখে নিতেন পরীক্ষক। আর সেই ‘অগ্নিপরীক্ষা’-র শেষে আক্ষরিক অর্থেই ছিবড়ে হয়ে যেতো ছাত্রছাত্রীরা।
আমি কোনোকালেই ভোরবেলা উঠতে পারতাম না। আর সুখলতাদি পারত না রাত জাগতে। নিশুত রাতে আমি মশারির নিচে ডুব দেবার কিছুক্ষণের মধ্যেই বেজে উঠত সুখলতাদির টেবিলঘড়ির অ্যালার্ম। ফলে, রুম নম্বর বাহান্নতে প্রায় সারারাতই জ্বলত ষাট পাওয়ারের হলুদ বালবটা।
আমি আর তুলি মাঝে মাঝে ‘জয়েন্ট স্টাডি’ করতাম। মানে, কোনো একটা বিষয়ের একটা চ্যাপটার একসঙ্গে পড়ে, তারপর একে অন্যের পড়া ধরতাম। বিনা ক্লান্তিতে অনেকটা এগিয়ে যাওয়া যেত।
একদিন, তুলি খুলে বসেছে, নেফ্রোটিক সিনড্রোমের চ্যাপটার — জানলার বাইরে বিমর্ষ ফাল্গুনী বিকেল। নিস্তব্ধ চারতলায় তখন শব্দ বলতে শুধু দূরে অ্যানাটমি বিল্ডিংএর ছাদে একটা দাঁড়কাকের একঘেয়ে কর্কশ ডাক — আমার মনটা হঠাৎ খুব খারাপ হয়ে গেল। আমি ভুলে গেলাম, যে আমাদের পরীক্ষার আর বেশিদিন বাকি নেই, ভুলে গেলাম, যে মেডিসিন সাবজেক্টটাই আমার সর্বাধিক দুর্বলতার জায়গা — সন্ধের মধ্যে এই চ্যাপটার শেষ করে, রাতেই ডায়াবিটিস মেলিটাস ধরতে হবে আমায়, সব ভুলে গেলাম আমি।
দুম করে তুলির কোলের উপর খোলা বইটা বন্ধ করে দিয়ে বললাম —
“একটা গান গা না, তুলি!”
আর কি আশ্চর্য, পিঠের উপর ম একঢাল এলোচুল ছড়িয়ে, লোহার খাটের ম্রিয়মাণ বিছানায় দুটো পা মেলে বসে, আমার প্রথম অনুরোধেই তুলি গান ধরল —
“শুধু যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা—”
ছাত্রী হিসেবে আমি ছিলাম মাঝারি মানের। মাঝারি মেধা, মাঝারি স্মৃতিশক্তি, মাঝারি উচ্চাকাঙ্ক্ষা।
পরীক্ষার কিছুদিন আগে থেকেই আমার কৃত্রিম আত্মবিশ্বাস আমি হারাতে আরম্ভ করেছিলাম। শেষতক এমন অবস্থা দাঁড়াল, যে আমি পরীক্ষা এবং পরীক্ষককুলকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করতে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠলাম। মায়ের কঠিন চোয়াল, ‘ভীরু’ অপবাদ দিয়ে অপমান করে বীরত্ব জাগিয়ে তোলার চেষ্টা, অকালে অপাত্রে সম্প্রদানের যাবতীয় উৎকট ভীতিকর প্রস্তাব — মাঠে মারা গেল সবই। শেষে হালছাড়া গলায় মা বলল —
“আমি তো যাব তোর সঙ্গে হোস্টেলে, খুকু। তোর পড়ায়, পরীক্ষায়, পরিশ্রমে, সবসময় তোর পাশে থাকব তো! তাহলেও পারবি না তুই? ঠিক পারবি, দেখিস!”
লোহার খাটটা মেরেকেটে ফুট তিনেক চওড়া। মা আদৌ রোগা নয়। আমার রাত তিনটে পর্যন্ত পড়া অভ্যেস — মা অনিদ্রার রোগী, ঘুমের ওষুধ না খেলে ঘুম আসে না। মাথার উপর ভোররাত অবধি ক্যাটকেটে হলুদ বাতি জ্বলে — মায়ের পায়েসাধা ঘুম অন্ধকার ছাড়া নামে না চোখের পাতায়।
দীক্ষিত, গোঁড়া বামুনবাড়ির ছোঁয়াছুঁয়ি মানা মা, হোস্টেলের বারোয়ারি বাথরুম আর হেগো-বাসি না মানা মেয়েদের দলে দিব্যি মিশে রইল আমার পরীক্ষার দিনগুলোয়। কেবল আমার মুখ চেয়ে।
পরীক্ষার দিন সকালে, সক্কলে প্রণাম করে যেতো মাকে। আর, আদিবাসী ক্রিশ্চান সুখলতাদি, মাকে প্রণাম করতো জুতোজোড়া খুলে রেখে। আমার ভারি মিষ্টি লাগত দৃশ্যটি।
মায়ের গা ঘেঁষে শুয়ে, মায়ের শরীরের ওম নিতে নিতে আমি জোরে জোরে মুখস্থ করছি ওভারিয়ান নিওপ্লাজম-এর ডিফারেন্সিয়াল ডায়াগনসিস, আর অনেক দূরে হাজিনগরের কোয়ার্টারে আমার সংসার-অনভ্যস্ত বাবা আনাড়ি হাতে গ্যাসে গরম করছে দুপুরে মলিনার মায়ের রেঁধে যাওয়া ডাল তরকারি!
সব, সবকিছু ঐ সতেরোশো নম্বরের চৌকাঠটা ডিঙোবার জন্য।
পরীক্ষা শেষ হবার দিনই মা বাড়ি ফিরে গেল। আমার যাবার কথা কয়েকদিন পরে। জয়িতার খুড়তুতো বোন আবীরার বিয়ে — নেমন্তন্ন খেয়ে তারপর ফিরব আমি। রেজাল্ট তো দু’ আড়াইমাস পরে। তার আগে তো অখন্ড অবকাশ। মা-বাবাও আপত্তি করেনি তাই।
কিন্তু সেই বিয়েতে যাওয়া হয়নি আমার। আমাদের কারোরই হয়নি। কারণ, ঠিক তার একদিন আগেই, আত্মঘাতী সন্ত্রাসবাদের হাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলেন আমাদের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। পশ্চিমবঙ্গে, ১৯৮৪-র হাঙ্গামার স্মৃতি তখনো টাটকা। তাই কোনোরকম অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর তড়িঘড়ি বনধ ডেকে দেওয়া, বিভিন্ন দলের আয়োজিত শান্তিমিছিল, আমাদের হোস্টেলের বাইরে(একমাত্র হসপিটাল ডিউটি ছাড়া) পা রাখার ক্ষেত্রে সুপারের কড়া নিষেধাজ্ঞা — এই সবই আমাকে সাত বছর আগের সেই ভয়ঙ্কর দিনটির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। বাবরি মসজিদের করসেবা যদিও তখন ভবিষ্যতের গর্ভে লালিত হচ্ছে।
রাজনীতির বোদ্ধা নই কোনোকালেই, বরং এড়িয়েই চলেছি বরাবর। অপারেশন ব্লু স্টার খলিস্তান আন্দোলন দমনে যথাযথ পদক্ষেপ ছিল কিনা, শ্রীলঙ্কায় শান্তিসেনা পাঠানো রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা কিনা, পুত্রের প্লেনক্র্যাশে মৃত্যুর ঘটনা মায়েরই ব্রেনচাইল্ড কিনা — এই সব কূটতর্কের মীমাংসা করার প্রজ্ঞা ছিল না আমার, রুচিও নয় — তবু, একটি পরিবারের এতগুলি মানুষের অপমৃত্যু, রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে মনকে ঝাঁকুনি দিয়ে গিয়েছিল ভীষণ।
যে কোনো পরীক্ষার সময়, আমি খাওয়া নিয়ে বড্ড বাড়াবাড়ি করতাম। আমার বদ্ধমূল ধারণা ছিল, পেটভরে খেয়ে পরীক্ষা দিলে অবধারিতভাবে পরীক্ষা খারাপ হবে। প্রায় দেড়মাস ধরে চলা ফাইনাল এমবিবিএস পর্বের ডামাডোল কাটিয়ে নিরিবিলি হাজিনগরে ফেরার সপ্তাহখানেকের মধ্যে যখন অরুচিভাবের সঙ্গে বমির যুগলবন্দি শুরু হলো, বাবা মায়ের সঙ্গে আমিও ভেবেছিলাম, না খেয়ে খেয়ে গ্যাস্ট্রাইটিস বাধিয়েছি বোধহয়। গুচ্ছের অ্যান্টাসিড আর বমি কমানোর ওষুধ, মায় ইঞ্জেকশনেও অবস্থার কোনো উন্নতি হলো না কিন্তু। মায়ের কপালে চিন্তার ভাঁজ ঘনালো।
একদিন বাথরুম করার পরে, কমোডের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলাম। কমোডের জল সর্ষের তেলের মতো হলুদ।
পেপার মিলের ডাক্তারবাবুর পরামর্শে এবার রক্তপরীক্ষা হলো।
সন্ধেবেলা রিপোর্ট হাতে ঢুকল বাবা, মুখ রাতের মতো আঁধার করে। রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা ৬.৭, আর হেপাটাইটিস বি সারফেস অ্যান্টিজেন — পজিটিভ!
সেই দিন থেকে আমাদের তিনজনের ছোট্ট পরিবারটির চতুর্থ সদস্য হয়ে অনন্তকালের জন্য ঘাঁটি গাড়লো মারী। কখনো আমাকে জড়িয়ে, কখনো মা-বাবাকে জড়িয়ে, পুষ্ট হতে থাকল তার স্বাস্থ্য। মহাকালের ক্ষুধা নিয়ে ঢুকেছে সে আমাদের সংসারে, সকলের পূর্ণ বিনাশ বিনা তার সন্তুষ্টি নেই।
অসুখের দুশ্চিন্তায় একটা লাভ হয়েছিল। জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা বলে যেটাকে ভেবেছিলাম, তার রেজাল্ট নিয়ে কোনো রকম নেতিবাচক চিন্তাভাবনা করার অবসরটুকুও পাইনি।
আমি শয্যাশায়ী। গ্রীষ্মের দুপুরে খড়খড়ি বন্ধ করা বিরাট জানলার ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে আসতো রাঙা রোদ। হাওয়ায় মাথা দোলানো বাইরের গাছপালা, চিকরিমিকরি উল্টো ছায়া ফেলতো হালকা সবুজ ডিসটেম্পার করা দেওয়ালে। আমি নির্ঘুম চোখে বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেখতাম, অনেক উঁচুতে আদ্যিকালের লম্বা ডাঁটির ফ্যান ঘুরছে ঘরঘর, ঘরঘর — সকাল থেকে আমার পরিচর্যা করে করে ক্লান্ত মা ঘুমিয়ে পড়েছে আমার পাশটিতে।
বিকেলে গিয়ে বসতাম রেলিং ঘেরা টানাবারান্দায়। মালী ভাগীরথী জল দিয়ে যেতো টবের গোলাপ আর বেলফুলের গাছে। রোদ্দুর পড়ে ঝিকিয়ে উঠতো সামনের গঙ্গার জল। আমি তাকিয়ে থাকতাম ওপারে — মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা ব্যান্ডেল চার্চের দিকে। ঠোঁট নড়ত নীরব প্রার্থনায়। সাপলুডো খেলার মতো ওঠানামা করছে তখন সাপ্তাহিক বিলিরুবিন রিপোর্ট।
‘জিসাস, সেভ মি! আমায় ভাল করে দাও ঠাকুর। এখনো অনেক কাজ বাকি যে আমার।’
কলেজের বন্ধুরা নিয়মিত আসতো পালা করে। তিবর, মিঠু, সোমা, তুলি, নীপা, জয়িতা, রীণা, রণধীর —
তখন আড্ডা, হাসি আর গল্পে অনেকটা লঘু হয়ে যেতো বাড়ির বাতাবরণ।
পরের দিকে, যখন আমি একটু সুস্থ, দল বেঁধে হাঁটতে যেতাম গঙ্গার ধারে, পেপারমিলের জেটি পর্যন্ত। জেটির রেলিংএ ভর দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখতাম, উত্তর থেকে দক্ষিণে, জলস্রোতে সওয়ার হয়ে, ভেসে যাচ্ছে কচুরিপানা, পোড়া কাঠ, টুকরো জঞ্জাল, নাম না জানা আগাছা — আঘাটার পলিতে, ভাটার সময় বাঁধা আছে তিন চারটে মলিন চেহারার জেলেনৌকো — মাঝিরা সতৃষ্ণ চোখে তাকিয়ে রয়েছে জেটিতে দাঁড়ানো আমাদের দিকে।
“গঙ্গায় ঘোরা হবে না কি বাবারা?”
খানিক দূরে দেখা যাচ্ছে জুবিলি ব্রিজের লোহার খাঁচা। নৈহাটি ব্যান্ডেল রেলব্রিজ ঝমঝম করে বেরিয়ে যাচ্ছে দূরের রেলগাড়ি।
কলেজের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিংএর একতলায় অফিসের সামনে, ১৯৯১ সালের ফাইনাল এমবিবিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ রোল নাম্বারের ঝোলানো তালিকাটার দিকে তাকাতে পারছিলাম না আমি। বাবা দেখছিল সেটা। তারপর আমার মুখটা লিস্টের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে বলেছিল, —
“এই দ্যাখ, রোল নম্বর ২৮৮, পাশ করে গেছিস বাপি, তুই ডাক্তারি পাশ করে গেছিস, ভাল করে তাকিয়ে দ্যাখ এবার — ইউ আর এ ডক্টর নাউ!”
এক বছরের কম্পালসারি ইন্টার্নশিপ শেষ করার পরেই বাবা মায়ের সঙ্গে বিরোধ, অশান্তি তুঙ্গে উঠল আমার।
“কেন বুঝতে পারছ না তোমরা, অপছন্দের সাবজেক্টগুলো জোর করে পড়ে, যতদূর আসা সম্ভব এসেছি আমি। এর পর পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করা আমার পক্ষে একেবারেই সম্ভব নয়।”
“খুব সম্ভব!”— মায়ের গলায় যেন বাজ ডাকত —
“পড়লেই সম্ভব!”
জেদি ঘোড়ার মতো ঘাড় বাঁকাতাম আমি —
“জানি, পাগলের মতো পড়লে হয়ত হতেও পারে। কিন্তু আমি পড়ব না। পড়তে আমার ভাল লাগে না।”
“তবে কি করতে ভাল লাগে, শুনি? রদ্দি সিনেমা দেখতে, আর হাবিজাবি গল্পের বই পড়তে?”
“মাআআআ, তুমি কিন্তু আমায় ইনসাল্ট করছ!”
“বেশ করছি! তোমার ওই কনভেন্ট ইস্কুলের মরাল সায়েন্সের পাঠ আমাকে পড়াতে এসো না—” তারপর, বাবার দিকে ফিরে বলল কঠিন গলায়,
“শোনো, পড়াশোনা যখন ওর দ্বারা আর হবেই না, তুমি কাগজে বিজ্ঞাপন দাও। খুকুর আমি বিয়ে দোবো।”
আমার উচ্চশিক্ষিত মায়ের গলায় মধ্য কলকাতার গোঁড়া ঘটিবাড়ির রক্ষণশীল আভিজাত্য কথা বলে উঠল।
আমিও দাঁত নখ শানিয়ে, ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
“বিয়ে দেবে মানে? ইয়ার্কি নাকি? কি করে দেবে, শুনতে চাই।”
“যেমন করে দ্যায়—”
এবার বাবার গলা, অনেকক্ষণ নীরব দর্শক হয়ে থাকার দায় ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বাবা বলতে আরম্ভ করলো, যেন অবোধ ছেলেমানুষকে বোঝাচ্ছে —
“বিয়ে তো দিতেই হবে বাপি! এটা তো আমাদের কর্তব্য! তাছাড়া, দেরি করে হবেই বা কি? আমার রিটায়ারমেন্টের সময় এগিয়ে আসছে। তুই হায়ার স্টাডিজ করলে না হয় পিছিয়ে দেবার কথা ভাবতাম। যখন আর পড়বিই না, তখন, অগত্যা—”
“তা, বিয়েটা দেবে কি করে বলবে একটু?”—
আমার গলায় বিদ্রোহী ব্যঙ্গের সুর মায়ের কান এড়াবে না জানতাম!
“যেমন করে সবাই দেয়! কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে।”
“হুম”—
আমার গলাও ধারালো হতো —
“পাত্রপক্ষ এসে গায়ের রং আর হাইট দেখে, হবি জিজ্ঞেস করে, গান আর রান্না জানা আছে কিনা প্রশ্ন করে, এক থালা মিষ্টি সাঁটিয়ে, পরে খবর দেব, বলে কেটে পড়বে। আর তোমরাও পরের বার মুরগী হবার জন্য লাফিয়ে পড়বে—”
“বাহ্, শিক্ষিত মেয়ের কি ভাষা!”
“মা, মেয়ে মানুষ করবে একালের শিক্ষায়, আর তার থেকে আশা করবে সেকালের আনুগত্য, এমন জগাখিচুড়ি কি হয়, বলো?”
মা একটু থমকেছিল শুনে। তারপর গলা অপেক্ষাকৃত নরম করে বলেছিল —
“তা, পড়বেও না, বিয়ে-থাও করবে না এখন — তো করবেটা কি, শুনি?”
“চাকরি করব মা। গ্রামে যাব। সেখানে থেকে, জীবনের সব ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর কাছে চিকিৎসা পৌঁছে দেবার খুব ইচ্ছে আমার। তার জন্য এমবিবিএস-ই যথেষ্ট বলে মনে করি আমি।”
মা অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। তারপর আস্তে আস্তে বলল — “তাই-ই তো হবে তোমার স্বপ্ন! ছাপোষা মজদুরদের ‘লেবার সাব’এর মেয়ের এর চেয়ে উঁচু আশা হবে কি করে? আমারই ভুল!”
বাবার মুখটা কি আরো একটু ম্লান হয়ে গিয়েছিল কথাটা শুনে? কি জানি, আমারই দেখার ভুল হয়ত।
ফাইন্যাল এমবিবিএস পাশ করে যাওয়ার তিরিশ বছর আগের সেই অবিশ্বাস্য স্বপ্নিল বিকেলকে পিছনে ফেলে এসেছি বহুদিন — নতুন ডাক্তার হওয়ার, মায়ের অদম্য আকাঙ্ক্ষাকে পূরণ করে অসম্ভবকে সম্ভব করার সদ্যমুকুলিত গর্ব, ‘পাতি এমবিবিএস’-এর ফ্যাকাসে রাবার স্ট্যাম্পের নিচে মুখ লুকিয়েছে লজ্জায়।
কিন্তু, শেষ কলেজি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ যখন হয়েই গেলাম, অদৃশ্য স্টার্টার যখন গুলিটা ছুঁড়েই দিলেন শূন্যে, তখন নির্ভুলভাবে জেনে গেলাম দৌড়োতে আমাকে হবেই। যতই গোলমেলে লাগুক ট্র্যাক, দু’পাশ দিয়ে হুশ হুশ করে আমাকে ছাড়িয়ে অনেক, অনেক এগিয়ে যাক ইয়ারমেট বন্ধুরা, ব্যথায় টাটিয়ে উঠুক অনিচ্ছুক পা দুটো, ছুটে যেতেই হবে আমাকে। ছুঁতে হবে ফিনিশিং লাইন। যদি সবার শেষেও ছুঁই, তবুও।
অভিমন্যুরা কোনোকালেই ফেরার পথ চিনে রাখে না — কেন কে জানে!
ইন্টার্নশিপ শেষ হবার পরে আমাদের বাধ্যতামূলক হাউসস্টাফশিপ করতে হতো এক বছরের জন্য — তার মেয়াদ বাড়ানোটা ছিল ঐচ্ছিক।
সচরাচর, ফাইনাল এমবিবিএসে যে বিষয়ে নম্বর বেশি রয়েছে, সেই বিষয়েই হাউসস্টাফশিপ করতে চাইত ছাত্ররা। ব্যতিক্রম ছিল না এমন নয়, তবে তা ছিল নগণ্য।
মা চেয়েছিল আমি গাইনিকলজিতে হাউসস্টাফশিপ নিই, কারণ শেষ পরীক্ষায় ঐ একটি বিষয়ে আমার নম্বর মোটামুটি ভদ্রস্থ ছিল। তাছাড়া, আমার পুরোনোপন্থী মা ভেবেছিল, মেয়ে ডাক্তার তো গাইনি হওয়াই স্বাভাবিক — পসার জমাতে সুবিধে হবে।
আমার ইচ্ছের সঙ্গে মায়ের ধারণা মোটেই মিলল না। আমি পেডিয়াট্রিকস অর্থাৎ শিশুচিকিৎসায় হাউসস্টাফশিপ করব বলে দরখাস্ত লিখে ফেললাম। ফাইনাল এমবিবিএসে পেডিয়াট্রিক্স জেনারেল মেডিসিনের অন্তর্গত ছিল, আলাদা বিষয় হিসেবে পরীক্ষা দিতে হতো না। আর জেনারেল মেডিসিনে আমার প্রাপ্ত নম্বর ছিল শিক্ষকদের ভাষায় যাকে বলে — “পুওর মার্কস”!
পেডিয়াট্রিকসে সাকুল্যে দশটি সিট ছিল হাউসস্টাফশিপে। যেদিন ফাইনাল লিস্ট বেরোলো, সেদিন দেখলাম আমার ন’জন উজ্জ্বল সহপাঠীর সঙ্গে দশম ব্যক্তি হিসেবে নেহাৎই কান ঘেঁষে, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের শিশু চিকিৎসার আঙিনায় চুপিসাড়ে ঢুকে পড়েছি আমি। অপাংক্তেয়র মতো, অনধিকারীর মতো, ভিনগ্রহের জীবের মতো।
পেডিয়াট্রিক মেডিসিনে এক বছর হাউসস্টাফশিপ শেষ করার পরে, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ এবং লেডিজ হোস্টেলের পাট চুকিয়ে আমি হাজিনগরে ফিরে এলাম। আমার বন্ধু আর সহপাঠীরা সকলেই পায়ের তলার মাটি শক্ত করার তাগিদে এগিয়ে গেছে যে যার পথে।
জয়িতা বিয়ে করে চলে গেল ইউ কে। সোমা পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করতে গেল চিত্তরঞ্জন শিশুসদনে। নীপার বিয়ে হয়েছে ততদিনে। বর জয়ন্ত মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার, ওর বাল্যবন্ধু — আমাদেরও দীর্ঘ দিনের সুহৃদ। রোমা ফিরে গেল ত্রিপুরায়। রীণারও বিয়ে হয়ে গেল একজন তরুণ সম্ভাবনাময় চিকিৎসকের সঙ্গে। সে বিয়ে করে বরের সঙ্গে চলে গেল চন্ডীগড়।
আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে ভাঙনের বাতাস লাগল। আলগা হতে হতে ভেঙে পড়ল দোর, কবাট, খিলান — তারপর ধুলোর সঙ্গে মিশে গেল একসময়।
হাজিনগরে এসে আমি কিছুদিন মিল অঞ্চলে কিছু হাটুরে ওষুধের দোকানে প্র্যাকটিস জমাতে চেষ্টা করলাম। আমার ধৈর্য্য কম। বয়সও। রুগীদের বিশ্বাস অর্জন করতে পারলাম না। প্র্যাকটিস জমল না আমার।
এরমধ্যেই একদিন কাগজে বিজ্ঞাপন দেখলাম, কল্যাণীর জওহরলাল নেহরু হাসপাতাল হাউসস্টাফ চাইছে এক বছরের কন্ট্রাক্টে — পেডিয়াট্রিক, ইএনটি, প্লাস্টিক সার্জারি — বিভিন্ন বিভাগে। দিলাম দরখাস্ত ঠুকে।
হাসপাতালের সুপারের ঘরে একটা নাম-কা-ওয়াস্তে ইন্টারভিউয়ের পরে এসেও গেল জয়েনিংএর চিঠি।
জয়েন করার দিন, সুপারের কথা শুনে আমার মাথায় বাজ পড়ল যেন। নেহরু হাসপাতালের সুপার অমায়িক হেসে বললেন —
“মাত্র একজন হাউসস্টাফ জয়েন করল। তুমি। যদিও পেডিয়াট্রিকের জন্যই নিয়েছিলাম তোমায়, কিন্তু সেখানে তবু দুজন আছে, একটা প্লেসমেন্ট ফাঁকা — কিন্তু প্লাস্টিক সার্জারিতে একজনও নেই — ফলে তোমাকে ওই ডিপার্টমেন্টেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া হলো।”
বলে কি লোকটা? সার্জারি? আমি? একটা অ্যাপেন্ডিসেকটমিতে অ্যাসিস্ট করতে গিয়ে যার তিনবার মাথা ঘুরে যায়, একটা স্টিচ দিতে যার হাত থরথর করে কাঁপে, সে হবে সার্জারির হাউসস্টাফ? আবার প্লাস্টিক সার্জারি? সে তো আরো কঠিন, আরো নিপুণ শল্যচিকিৎসা!
আমি পাংশুমুখে মিনমিন করে বলতে শুরু করলাম —
“না, মানে, আমি তো পেডিয়াট্রিকসের জন্যই অ্যাপ্লাই করেছিলাম স্যার— আমার তো ন্যাশনালে একবছর পেডিয়াট্রিকে হাউস জব করাও আছে—”
“জানি। বায়োডাটা দেখেছি তো। কিন্তু ওই যে বললাম, একজন হাউসস্টাফও নেই প্লাস্টিক সার্জারিতে। অপারেশনগুলো পিছিয়ে যাচ্ছে। এই হাসপাতালটাতে ঐ ডিপার্টমেন্টে রুগীর খুব চাপ, জানো তো?”
“কিন্তু স্যার, আমি তো সার্জারির কিছুই জানি না — আমি কেমন করে—”
আমার কথা শেষ হলো না, একটা গম্ভীর গলা বেজে উঠল পিছনে —
“কি জানো না? ডান হাত আর বাঁ হাতের গ্লাভস চিনে পরতে পারবে তো?”
ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, একজন সৌম্যদর্শন কাঁচাপাকা চুলের প্রৌঢ়, দুচোখে গভীর মরমী দৃষ্টি আর ঠোঁটে প্রশ্রয়ের হাসি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন!
“আরে, গাঙ্গুলিদা, এসে পড়েছেন!”— সুপার সম্ভাষণ করলেন আগন্তুককে —
“নিন, আপনার ডিপার্টমেন্টের খরা কাটিয়ে দিলাম। হাউসস্টাফ এনে দিলাম। এবার আর ওটি ডেট পিছোনোর কমপ্লেন পাবো না আশা করি।”
“হুম, এনে তো দিলে। কিন্তু কাটা সৈনিক দিয়ে যুদ্ধ করব কি করে বলো দেখি? একে তো একেবারে গোড়া থেকেই শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হবে।”
কি বিপুল আত্মপ্রত্যয়! আমি শিখতে চাইব কি না, চেষ্টা করলেও আদৌ শিখতে পারব কি না, সে সম্পর্কে কোনো সংশয়ের অবকাশই নেই যেন এঁর মনে।
শব্দ করে একটা চেয়ার টেনে, আমার পাশে বসে পড়লেন দোহারা চেহারার মানুষটি —
“কাল জয়েন করো। ওটি আছে আমার। সাড়ে আটটার মধ্যে ফার্স্ট ফ্লোর ওটিতে পৌঁছে যাবে। বাই দ্য ওয়ে, বাড়ি কোথায় তোমার? নৈহাটী? ফাইন। তাহলে, এবার বলো, কোত্থেকে শুরু করবে? গ্লাভস পরা, না ইন্সট্রুমেন্ট চেনা? বলো, বলে ফ্যালো — দেয়ার ইজ নাথিং টু বি অ্যাশেমড অফ!”
সেই মুহূর্তেই আমার মনের সব ভয়, সব সংশয় কেটে গেল। মনে হলো, আমি পারব। আমায় পারতেই হবে। অন্তত এই আত্মবিশ্বাসী মানুষটার মুখ চেয়ে আমাকে পারতেই হবে।
হুড়মুড় করে এই অচেনা, পিতৃপ্রতিম প্রৌঢ়ের যেন প্রেমে পড়ে গেলাম আমি।
(ক্রমশ)