জন্মের সময় মা-কে অমানুষিক কষ্ট দিয়েছিলাম আমি। সবেমাত্র প্লুরিসি থেকে ভুগে ওঠা মা, বিয়ের তিনবছর পরেও বাচ্চা না হওয়ার জন্য বুড়ো শ্বশুরের গঞ্জনা সওয়া মা, বড় মরীয়া হয়ে চেয়েছিল আমায়। ঠিক যতটা মরীয়া হয়ে আজ মৃত্যু আর মায়ের মধ্যের কমে আসা দূরত্বটাকে নিষ্ফল আক্রোশে চেঁচিয়ে বলি আমি — ”তফাৎ যাও!” — ততটাই কি? জানা নেই।
ছত্রিশ ঘন্টা আগে জল ভেঙে যাওয়া মায়ের প্রসববেদনা যখন উঠল না সেভাবে, তখন ডাক্তারদিদি সিদ্ধান্ত নিলেন, ফরসেপস ডেলিভারি হবে। শেষ চৈত্রের ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে, মেডিক্যাল কলেজের ইডেন হসপিটালের লেবার রুমে বিস্তর টানাহেঁচড়ার পরে জন্মালাম আমি। মা নাকি একফোঁটাও চিৎকার করেনি সারাটা সময়।
গোড়ালি উল্টো করে ঝুলিয়ে, মায়ের জরায়ুরসে মাখামাখি ‘আমি’কে, মায়ের নাড়ির থেকে বিচ্ছিন্ন ‘আমি’কে ক্রমাগত থাবড়ে থাবড়ে কাঁদাতে চেষ্টা করছিলেন ডাক্তারদিদি!
“অ্যাই মেয়ে, দেখো, কি হয়েছে তোমার? বলো, বলো, মুখে বলো!”
মায়ের ক্লান্ত চোখের সামনে তখন সদ্য নাড়িছেঁড়া সন্তানের যোনি। ক্ষীণ গলায় কোনোমতে বলেছিল, ”মেয়ে”।
শ্রান্ত চোখের কোল বেয়ে দু ফোঁটা জল বুঝি গড়িয়ে পড়েছিল — দেখেই ডাক্তারদিদি আরতি রায়ের কড়া ধমক —“কাঁদছো কেন? অ্যাঁ, কাঁদছো কেন? মেয়ে হয়েছে বলে?”
অহঙ্কারী গলায় সান্ত্বনা দিয়েছিলেন –“শাশুড়ি কথা শোনাবে, এই ভয়ে? ছেলেই শুধু মুখোজ্জ্বল করবে বংশের? মেয়ে বুঝি ফ্যালনা? কেন, আমি মেয়ে নই? ডাক্তার হইনি আমি?”
মা আরো নিভে যাওয়া গলায় বলেছিল —”তার জন্য নয় দিদি। আমি যে শারীরিক কষ্ট পেয়েছি — পাবোও — সে কষ্ট তো ও-ও পাবে একদিন। সেই ভেবেই —-”
তখন না ছিল মোবাইল, না ছিল রোগীর বাড়ির লোকের টেলিফোন নম্বর নিয়ে রাখার রীতি। বাবা যথারীতি চারটের সময় ভিজিটিং আওয়ারে মাকে দেখতে এসে দেখেছিল বেড ফাঁকা। এক বুক উদ্বেগ নিয়ে দৌড়েছিল করিডোরে। ওখানেই ঝোলানো রয়েছে সেদিনের ডেলিভারি হওয়া মায়েদের নামের লিস্ট। নর্মাল ডেলিভারির লিস্টে মায়ের নাম না দেখে জিভ শুকনো বাবার। তবে কি সিজার? সে তো অনেক খরচের ধাক্কা। এমনিতেই ধার হয়েছে কিছু। কলেজ থেকে সামান্য অ্যাডভান্সও নিতে হয়েছে। আরও কার কাছ থেকে নেবে, ভাবতে ভাবতেই সিজারের লিস্টে চোখ বোলাচ্ছিল। নাহ্, এতেও তো নাম নেই। তবে কি — তবে কি —
অজানা আশঙ্কায় বুক গুরগুর করে উঠেছিল বাবার। পিছন থেকে কানে এসেছিল নার্সের নৈর্ব্যক্তিক স্বর — ফরসেপস হয়েছে আপনার স্ত্রীর। ডাল ওয়ার্ডে আছে। যান, দেখা করে আসুন।
১৯৬৯ সাল। ডাল ওয়ার্ডের বেডে, মায়ের কোল ঘেঁষে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিল এক হাবলা কন্যাশিশু — তার জন্মের বছরেই ঘটবে কত কি! ভারতের ব্যাঙ্কগুলির রাষ্ট্রায়ত্তকরণ হবে, স্বাধীনতার পর প্রথম দু’টুকরো হবে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, চাঁদে প্রথম পা রাখবে মানুষ — আর মুক্তি পাবে “গুপী গাইন বাঘা বাইন”!
আমার জন্মের সময়েই দুর্ঘটনা ঘটেছিল আমার মামার বাড়িতে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বড়লাট রিপন সায়েবের অন্যতম নায়েব রায়বাহাদুর গোপাল মুখুজ্জের বৌবাজারের বসতবাড়ি, আমার মায়ের বাপের বাড়ি। স্বাধীনতা উত্তর কংগ্রেসি মন্ত্রী, আমার মায়ের বাবা কালীপদ মুখোপাধ্যায়ের অকালপ্রয়াণের পরে সাত বছর কেটে গিয়েছে। জ্ঞাতিদের সঙ্গে ভিন্ন হয়েছে হাঁড়ি। মামার বাড়ি তার পুরোনো গৌরবের তলানি কুড়িয়ে নিচ্ছে, রবরবা অস্তমিত অনেকটাই, তবু, মরা হাতি লাখ টাকা।
মায়ের জ্যেঠতুতো দাদা, যাঁকে বড়মামা বলতাম, তাঁর একমাত্র ছেলে ছিল টোটনদা। আমার মায়ের বড্ড প্রিয় ছিল সে। এপিলেপ্সি ছিল টোটনদার। সে বছর লেকের ধারের রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামে বম্বের ফিল্মস্টারদের নিয়ে বিশাল জলসার আয়োজন করেছিল যুব কংগ্রেস। মা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে পইপই করে বারণ করেছিল — ”হাঙ্গামা হতে পারে টোটনা, তুই মোটেই যাবি না। তুমি ওকে টিকিটের পয়সা দিও না কিন্তু দাদাভাই —-”
টোটনা শোনেনি। জেদি ছেলে আর তার নাছোড় বন্ধুরা, ঠিক বড়মামার কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছিল টিকিটের টাকা। ”আপনি কিচ্ছু চিন্তা করবেন না কাকু, ওর দায়িত্ব আমাদের। আমাদের সঙ্গে যাবে, আমাদের সঙ্গেই ফিরবে টোটন।”
ফেরেনি। খুব গন্ডগোল হয়েছিল সেই অনুষ্ঠানে। যত টিকিট বিক্রি হয়েছিল, লোক নাকি হয়েছিল ঢের বেশি। কাজ করেনি মাইক্রোফোন। সেই নিয়ে হাঙ্গামা শুরু হয়, যার ফলে হয়েছিল পুলিশের নির্মম লাঠিচার্জ, স্ট্যামপিড, বহু মানুষ পদপিষ্ট হয়েছিলেন, মেয়েদের শ্লীলতাহানির অভিযোগও উঠেছিল প্রচুর।
বন্ধুরা ফিরলেও টোটনা ফেরেনি। পরের দিন লেকের জলে পাওয়া গিয়েছিল তাকে। হাতের মুঠোয় কিছু ঘাসচাপড়া। ফুসফুস ভর্তি কাদা। বোধহয় দৌড়ে পালাতে গিয়ে দিকভ্রষ্ট হয়ে জলে পড়ে গিয়েছিল সে। হয়ত তখনই হয়েছিল এপিলেপসির আক্রমণ! জানা যায়নি আর কিছুই।
শুধু জানি, খবরটা মাকে জানানো হয়নি প্রথমে। মেয়ে কোলে মা যখন হাসপাতাল থেকে ফিরে এলো বাপের বাড়িতে, আমার নির্বোধ বাবা উৎসাহের আতিশয্যে কিনে এনেছিল একবাক্স মিষ্টি — থমথমে চকমিলানো বাড়িটায় তখন শুধুই নৈঃশব্দ্য আর দীর্ঘশ্বাস। বড়দিদা, মায়ের জ্যাঠাইমা, একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিলেন — ”হুঁ, কারুর আবাহন, আবার কারুর বিসর্জন! ”
মা আমায় কোলে নিয়ে হুহু করে কেঁদে ফেলেছিল তখন।
(ক্রমশ)