সাদা পর্দা অল্প উড়ছে। কাঁচের শার্সি খোলা। বারান্দায় কাপড় মেলা নেই। লাল দরজা বন্ধ। গোটা বাড়িটাকে দুপুরের রোদ ভাসিয়ে দিচ্ছে…
হুশ করে বেরিয়ে যেতে যেতে এর চেয়ে বেশি দেখা যায় না। সত্যেশ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন। বারান্দায় সে একা-ই। কিন্তু বেশিক্ষণ ঘাড় ফিরিয়ে রাখতে পারলেন না। গাড়ি চালাচ্ছে বাবা। বাবার নজর খুব কড়া। চট করে খেয়াল করে ছেলের হাবভাব। আবার নজর দিলেন সামনের রাস্তায়।
রোজই এক ঘটনা। রোজের মতই আজও কি অদ্ভুত কিছু দিয়ে শেষ হবে? ভাবতে ভাবতেই সত্যেশ দেখলেন – নৌকোয় উঠেছেন। শেষ হতে চলেছে। কাল গাছে উঠেছিলেন। গাছ থেকে পড়তে পড়তেই ঘুম ভেঙেছিল। আজ নৌকোয়।
প্রায় তখনই নৌকো ডুবতে শুরু করল। সামনের গলুই জলের নিচে চলে গেছে। নিশ্চিন্তের নিঃশ্বাস ছাড়লেন সত্যেশ। এইবার ঘুম ভাঙবে।
রাত এখন অনেক। সামনের ছাদ-ছোঁয়া, দেওয়াল-জোড়া কাচের জানলার বাইরের আকাশ একেবারেই নিকষ কালো। বিছানার পাশের টেবিলে ঘড়ি দেখাচ্ছে দুটো বেজে এক মিনিট।
এখন আর ঘুম আসবে না। তিন মাস হল রাতে ঘুম ভাঙছে। রোজ। বিছানা ছেড়ে উঠলেন সত্যেশ। সাবধানে, যাতে বিছানা না নড়ে। মাটিতে পা রেখেই মনে হল, এই সাবধানতার আর প্রয়োজন নেই। যার ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটাতে সাবধানে উঠতে হত, সে চিরঘুমের দেশেই গেছে। দুবছর কেটে গেছে তার পরে। প্রায় আড়াই…
একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন। পাশের খালি বালিশটা যেন চেয়ে আছে। কাচের দরজা পাশাপাশি টেনে খুললেন। বাইরেটা গুমোট। ভেতরে এ-সি চলছে বলে বোঝা যায় না। এই গুমোট ঝড়ের পূর্বাভাস। বহুদিনের অভিজ্ঞতায় জানেন সত্যেশ।
লম্বা শ্বাস নিলেন। বাতাস এতই নিথর, নাসারন্ধ্র দিয়ে ভেতরে আসতেও যেন তার আপত্তি। মুহূর্তের মধ্যে কপালে বিনবিনিয়ে ঘাম বেরোল। দরজা বন্ধ করে বাইরের দিকে এগিয়ে এলেন। বিশাল টেরেস শেষ হয়েছে কোমর-সমান পাঁচিলে। চওড়া পাঁচিল বানিয়েছিলেন, যাতে বসা যায় – যদিও বসেননি অনেকদিনই। আজ বসলেন। একটু পাশ করে, যাতে বাইরের দিকটা একেবারে পেছনে না পড়ে যায়। বাড়িটা যখন বানিয়েছিলেন, তখন কিছু দূরে সমুদ্র স্পষ্ট দেখা যেত, কিন্তু এখন বাগানের শেষের গাছগুলো বড়ো হয়েছে। ছোটোবেলায় মা-বাবার সঙ্গে হাজারিবাগ গিয়েছিলেন। সেখানকার গেস্ট-হাউসের বাগানের মতো বাগান করবেন ইচ্ছে ছিল সেই তখন থেকেই। বাগানের শেষে, তিনদিকে বড়ো বড়ো গাছ থাকবে। দুপুরের, বিকেলের হাওয়া সরসর করে বয়ে যাবে পাতার ফাঁকে ফাঁকে। তাই হয়েছে। ফলে এখন সমুদ্রের দৃশ্য আর দেখা যায় না।
সাগরপারের রাস্তায় বড়ো বড়ো আলোগুলো জ্বলে আছে একসার একচোখো দৈত্যের মত। নিথর প্রশান্ত মহাসাগরে ঢেউয়ের ছোঁয়া নেই। কিন্তু এই রূপ বেশিক্ষণ থাকবে না। আকাশের দিকে তাকালেন সত্যেশ। লাল। বৃষ্টি হবে রাতেই।
মুখ আর ঘাড় ঘামে ভিজে গেছে। নাইটশার্টটা পিঠে সেঁটে যাচ্ছে। এই নিয়ে ভেতরে গেলে চট করে ঠাণ্ডা লেগে যাবে। বয়স বাড়ার নানা চিহ্নর মধ্যে এও একটা। ভেতরে গিয়ে আগে এসি-টা বন্ধ করলেন। বাথরুমে গিয়ে জামা খুলে তোয়ালে দিয়ে ঘাম মুছলেন মুখ, গা, বুক-পিঠ থেকে। বেরিয়ে এলেন খালি গায়েই। বেডসাইড টেবিলে জলের বোতল নেই। শুতে আসার আগে আনতে ভুলে গেছেন। আগে হলে এটা হত না। ভুলে গেলেও, মাঝরাতে ঘুম ভেঙে দেখতেন ভরা বোতল রয়েছে টেবিলে সাজান। পরদিন সকালে সেটা চলেও যেত। রোজ রাতে নতুন, ভরা বোতল আসত। আজকাল খালি হওয়া অবধি পড়েই থাকে। অগোছাল না হলেও সত্যেশ অত গোছান কোনও কালেই ছিলেন না।
শোবার ঘরের বন্ধ দরজা খুলতেই চৌকো একটা আলোর-বাক্স গিয়ে পড়ল বাইরের মেঝেতে। থমকে দাঁড়ালেন সত্যেশ। আজ মেঝে পরিষ্কার, কিন্তু এখানেই ছিল অনু। আজকের মতোই মাঝরাতে ঘুম ভেঙে খেয়াল করেছিলেন, বিছানা খালি। বাথরুমে নেই, টেরেসে নেই, দেখে, এই দরজা খুলেই দেখেছিলেন। এই আলোতেই। ওই শয়নভঙ্গীমাকেই ইংরেজিতে বলে ‘ক্রাম্প্লড’। অনুর লম্বা শরীরটা কেমন কুঁকড়ে ছোট্ট হয়ে গিয়েছিল। মাথার নিচে অতটা রক্ত জমে কালচে হতে শুরু করেছিল।
প্রায় বছরখানেক সত্যেশ জায়গাটা লম্বা পা বাড়িয়ে পেরিয়ে যেতেন। যেন অনুর দেহ আর রক্ত ওখানেই রয়েছে। খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে যেন দেখতে পেতেন, মুছে দেবার পরেও রক্তের আবছা ছায়া। আজ অবশ্য আর লম্বা পা ফেলে পার হন না। কিন্তু থমকে দাঁড়ানোটা বদলায়নি।
কেন বেরিয়েছিল অনু? সন্দীপ জিজ্ঞেস করেছিল হাসপাতালে। উত্তরে বলেছিলেন, জানেন না। জল খেতে? জানতে চেয়েছিল সন্দীপ। না। একটা ভরা বোতল অনুর দিকের বেডসাইড টেবিলেও ছিল, বাড়ি ফিরে সত্যেশ দেখেছিলেন। মাঝরাতে অনু কোনও দিন বিছানা ছেড়ে উঠত বলে সত্যেশ জানেন না। বিয়াল্লিশ বছরের বিয়েতে কোনও দিনই না।
খাবার টেবিলে, সাইডবোর্ডে একাধিক জলের বোতল। প্রায় সবকটাই খালি। টেবিলে একটা আধভর্তি বোতল থেকে গ্লাসে ঢেলে জল খেলেন। আগে বোতল থেকেই খেতেন সরাসরি। ডাঃ সিওয়ার্ড বারণ করার পর থেকে আর খান না। স্পন্ডিলোসিস আছে। মাথা পেছনে হেলানো ভালো না। মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারেন।
অনুর মাথা ঘুরে গিয়েছিল? না কি পা পিছলেছিল? হোঁচট খেয়েছিল? না। পায়ে আটকানোর মতো সাহেবি কায়দায় রাগ বা পাপোষ, দেশি ন্যাকড়া, কোনওটাই ছিল না। সাহেবী ঢঙে বানানো বাড়িতে দরজায় চৌকাঠও নেই। জল থাকার প্রশ্নই ওঠে না। কাঠের প্যানেল করা মেঝেতে জল ফেলা বারণ। রক্ত ছাড়া কিছু ছিল বলে মনেও করতে পারেননি পরে।
সায়ক বলেছিল, মার জ্ঞান ফিরলে জিজ্ঞেস করতে। সে সুযোগ দেয়নি অনু। পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে লেখা ছিল কিছুই পাওয়া যায়নি। রক্তক্ষরণের ফলেই মৃত্যু।
জল খেয়ে ঘরে ঢুকে খেয়াল হল এবারও বোতলটা আনেননি। ঘড়ি বলছে দুটো আটত্রিশ। অর্থাৎ ঘণ্টা দুয়েক পরে আবার ঘুম ভাঙবে। আবার জল খেতে হবে। গিয়ে নিয়ে আসবেন বোতলটা? থাক।
বিছানায় বসতেই স্বপ্নটা মনে পড়ে গেল। বারান্দা না, ছাদ ছিল। খোলা বারান্দা। অনেকটা সত্যেশের টেরেসটার মতো, কিন্তু অনেক ছোটো। বাইরের রেলিংটা ছিল লোহার শিকের ওপরে কাঠের বাটাম। রং বোধহয় ছিল সবুজ। সবুজ কি ছিল? নাকি সেটা সত্যেশের স্মৃতিতেই? লোহার শিকগুলো কি মরচে ধরা ছিল? মনে নেই। কতবার দেখেছেন সত্যেশ? কয়েকশো? হবে। ক্লাস এইট থেকে টেন, তিন বছর সপ্তাহে তিন দিন ওই রাস্তায় যাতায়াত। যাওয়ার সময় রোদের আলো, ফেরার পথে সন্ধের আঁধার। কোণে বোগানভিলিয়ার গাছ ছিল? নাকি সেটা নিজের বাগানে রেখেছেন বলেই মনে হচ্ছে ছিল? দেওয়ালটা হলদে ছিল। টেরেসের ওপারের ঘরের দেওয়াল উজ্জ্বল হলুদ, কিন্তু বাইরের, দোতলা থেকে যে দেওয়ালটা রাস্তায় নেমে এসেছে, সেটা ছিল শ্যাওলা মেখে কালচে। মনে আছে।
আর মনে আছে দরজাটা। লাল দরজা। পোস্ট-অফিস রেড। এমন রঙের দরজা ছোটোবেলায় গৃহস্থবাড়িতে কখনও দেখেছেন বলে মনে পড়ে না।
না, আরও কিছু মনে আছে। গত ক’দিন স্বপ্নে যে এসেছে তার কথা মনে আছে। সাকুল্যে দু-দিন তাকে দেখেছিলেন। প্রথম দিন দাঁড়িয়ে ছিল রেলিঙে ভর দিয়ে। একলহমার দেখা, তবু সেই স্বপ্নালু চোখের দৃষ্টি দেখে চমকে উঠেছিলেন। গাড়ি পেরিয়ে গিয়েছিল পরমুহূর্তে। চট করে ঘাড় ঘুরিয়েছিলেন। না, সত্যেশকে দেখেনি। দেখলেও ফিরে তাকানোর যোগ্য মনে করেনি।
পরের দিনটা ছিল কয়েক মাস পরে। গাড়িটা রাস্তার বাঁকটা ঘোরার পরেই দেখেছিলেন, রেলিং থেকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ঘুরে ঘরের দিকে হাঁটা দিয়েছে। পরনে লাল-পাড় সাদা শাড়ি। এই বয়সের মেয়েরা সাধারণত এই রঙ পরে না। শুধু পুজোটুজোর দিনে। লম্বা বিনুনিটা প্রায় হাঁটুর কাছে দুলছে। ওই আর এক মুহূর্তের দেখা। ব্যাস। তারপর থেকে রোজ শুধু খালি বারান্দা, রেলিং আর বন্ধ একটা লাল দরজা।
কিন্তু আজ, এতদিন পরে সে কেন স্বপ্নে ফিরতে শুরু করল অনু চলে যাবার পরেই? অস্বস্তি নিয়ে পাশ ফিরলেন সত্যেশ। এতদিন মনের কোন কোণে লুকিয়েছিল সেই অপরিচিতা?
সত্যেশের চোখ বন্ধ হয়ে এল। গভীর ঘুমে কখন গুমোট আকাশ ভেঙে বৃষ্টি এল, জানতে পারলেন না।
**
পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে অস্বস্তিটা ফিরে এল। কেন হচ্ছে এমন? চোদ্দ বছর বয়সে যাকে দেখে মনে হয়েছিল সুন্দরী, সে কেন আজ স্বপ্নে ফিরে আসে? যে মুখটা সত্যেশের স্মৃতিতে রয়েছে, সেটা আসল না-ও হতে পারে। যাকে জীবনে দু’বার মাত্র দেখেছেন, তাও একবার পেছন থেকে, তাকে কি এত মনে রাখা সম্ভব? তবু, সে এত কেন ফিরে আসে, অসতর্ক স্বপ্নের আড়াল ধরে?
ছেলেবেলায় ডাকাবুকো ছিলেন না মোটেই। বরং ভীতু ছিলেন। বিদেশ যাবার খবরে মামা হেসেছিল। বলেছিল, “তুই যাবি অ্যামেরিকা? দেখিস ভয়ে প্লেনে অ্যা করে দিবি না তো?”
করেননি। কিন্তু সাহসের অভাব ছিল বইকি। জায়গাটা সত্যেশের পাড়া থেকে অনেকটাই দূরে। বয়ঃসন্ধিতে বন্ধুদের সঙ্গে যখন রাস্তা-হাঁটা অভ্যেস করছেন তখন কখনও ধারেকাছেও যাননি। শুধু একবার একা একা, সেদিন অন্য কেউ আসেনি কী কারণে, হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেছিলেন।
দোতলার বারান্দা খালি ছিল। লাল দরজা বন্ধ। বোকার মতন হেঁটে পেরিয়ে গিয়েছিলেন। পরের মোড়ে পৌঁছে আবার ফিরে এসেছিলেন। আড়চোখে দেখেছিলেন, বারান্দায় কেউ নেই। দরজাও খোলেনি। সেই সঙ্গে চোখে পড়েছিল, চোয়াড়ে চেহারার ছ-সাতটা ছেলে উলটো দিকের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ক্যারম খেলছে। সবাই তাকিয়ে ছিল বোর্ডের দিকে, কিন্তু একটা ছেলে, পেছনে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছিল, হঠাৎ সিগারেট জ্বালিয়ে দেশলাইটা ফেলতে গিয়ে মুখ তুলে চেয়েছিল সত্যেশের দিকেই। মনে হয়েছিল, একটা বেপাড়ার ছেলেকে এখানে ঘুরঘুর করতে দেখলে ওরা সহ্য করবে না। মাথা নিচু করে পা-চালিয়ে চলে গিয়েছিলেন।
অনেক ফন্দি করেছিলেন। যেমন, কাগজে একটা বানানো নাম লিখে নিয়ে গিয়ে বলবেন, “এই বাড়িতে অনুপ স্যার থাকেন? ফিজিক্স পড়ান? আমাকে একজন এই ঠিকানা দিয়েছে।” যাননি। সাহস হয়নি।
খবরের কাগজটা নামিয়ে রেখে টোস্ট তুলতে গিয়ে দেখলেন, প্লেট খালি। কাগজও পড়েননি, কখন টোস্ট খেয়েছেন, খেয়ালও করেননি। কফির কাপটা ভরে, নিয়ে গেলেন বসার ঘরে।
কাগজে মন বসছে না। টিভি চালালেন। সি-এন-এন চ্যানেলে মহিলার মুখ ভেসে উঠল। মিউট বোতামটা টিপে দিলেন কী বলছে শোনার আগেই।
মতলব করেছিলেন অনেকই। ভেবেছিলেন, কাঞ্চনকে বলবেন। কাঞ্চনের সাহস ছিল, বেপাড়ার ছেলেদের ভয়ে কাঁপত না। বন্ধু-বান্ধবও ছিল অনেক, হয়ত দেখা যেত ওদের কাউকে চেনেও। কিন্তু কাঞ্চনকে বলায় সমস্যা ছিল। পলুর ঘটনাটার জন্য। পলু একটা চিঠি দিয়েছিল, কুতুবদের পাড়ার কোঁকড়া চুলওয়ালা মেয়েটাকে দেবার জন্য। কয়েকমাস পরে পলু দেখে লেকে মেয়েটাকে আলুকাবলি খাওয়াচ্ছে কাঞ্চন। পলুকে বলেছিল, “আরে, দেখছিলাম মেয়েটা কেমন। যে-কোনও মেয়ের সঙ্গে তোকে যেতে দেব, এমন বন্ধু পেয়েছিস আমাকে?”
বলতে-পারা-যায় এমন আর কেউ ছিলই না। তারপরে ক্লাস ইলেভেনে ওই টিউশনে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল, ফলে রাস্তাটাই সত্যেশের জিওগ্রাফির বাইরে চলে গেল। তবে প্রায়ই মনে পড়ত। অনেক বেশিই মনে পড়ত। নতুন কো-এড স্কুলে মেয়েদের সঙ্গ ভালো লাগত না। ভাবতেন, হয়ত এই স্কুলেই অন্য ক্লাসে পড়ে, নাইন, বা টেন-এ? ভয়ও হত, যদি বয়স বেশি হয়?
অন্তু গল্প করত, কেমন বাসে উঠে একটা দারুণ দেখতে মেয়ের পেছনে পেছনে লেডিস সিটের দিকে চলে গেছিল। আশেপাশের মহিলারা যখন বলেছেন একটা ছেলে কেন মেয়েদের দিকে এসেছে? বাসের ওদিকে জায়গা নেই? তখন মেয়েটাকেই জিজ্ঞেস করেছিল, “ক্যান ইউ টেল মি, হোয়াই আই কেম দিস ওয়ে?”
তারপরে মেয়েটার পেছনে পেছনে নেমে, বাড়ি দেখে এসেছিল। তিন মাস পরে গল্প বলত, মেয়েটাও একই ক্লাসে পড়ে, অন্য স্কুলে। মেয়েটার মা’র কাছে ও-ও ইংরেজি শিখছে। কেমন মাঝখানে বসে মা পড়ান উল বুনতে বুনতে, আর ওরা দুজনে দু দিক থেকে মায়ের সামনে বই ধরে থাকে, বইয়ের আড়ালে আঙুলে আঙুল জড়িয়ে।
নপুংসক মনে হত নিজেকে।
ভুলেই তো গেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ কেন স্মৃতির সিংহদরজা খুলে গেল? হাত বাড়িয়ে রিমোটটা তুলে নিয়ে নিঃশব্দ টিভিটা বন্ধ করে দিলেন আবার। রাতের ঝড়ের পরে বাগানটা এলোমেলো হয়ে আছে। আকাশে বৃষ্টির সম্ভাবনা। তাই বাগানে না গিয়ে আবার দোতলায় ফিরে গেলেন। বারান্দাতেই পায়চারি করবেন খানিকক্ষণ।
ওপরের বসার ঘরের দরজা দিয়ে টেরেসে গেলেন। দরজা টেনে খুলতে গিয়ে মনে পড়ে গেল। শিক ছিল না। লোহার গ্রিল ছিল। আগেকার দিনের ডিজাইন। দুদিকে দুটো লোহার রড, তার নিচের দিক থামের পায়ার মতো চওড়া, আর মাথা দুটো নুয়ে পড়েছে যেন পদ্মের আকারে। মাঝখানে ওপর নিচে একসার ফুল, আলপনার মতো করে সাজানো।
বাঁ হাত তুলে চুলের ভেতর দিয়ে চালালেন সত্যেশ। কেন এত কথা মনে পড়ছে? কলেজ ছেড়ে বেরোবার পরে তো আর…
সম্বিত ফিরল ফোন বাজার শব্দে। শোবার ঘরের ফোন। এই নম্বরে ফোন করে কেবল ছেলেরা। পা চালিয়ে গিয়ে ধরলেন। “হ্যালো?”
সায়ক। “সেল ফোনটা সাথে রেখো বাবা, কত বার বলেছি, আমিও, দাদাও – একটা সমস্যা হলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে না।”
খেয়াল থাকে না। সকালে উঠে গেছেন, বেডসাইড টেবিলে সেল-ফোনটা পড়ে আছে।
বললেন, “জানিস তো, খেয়াল থাকে না। তুই কোথায়? ফিনিক্সেই?”
সায়ক এর আগে ছিল হার্ভার্ডে। বছরখানেক হল এসেছে ফিনিক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে কী কাজ নিয়ে। বোঝেন না সত্যেশ। বুঝতে চানও না। দুই ছেলেই বায়োটেকনোলজি নিয়ে পি-এইচ-ডি করে বাপের জ্ঞানবুদ্ধি থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। একসময় ভাবতেন, যতই বায়ো হোক, টেকনোলজি তো – ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বুঝবেন না? কিন্তু ছেলেরা কলেজে থাকাকালীনই পরস্পর কথা বললে একবার এর দিকে, আর একবার ওর দিকে চেয়ে থাকতেন হাঁ করে।
“ফিনিক্সেই। তুমি বাড়ি আছ তো? আমি আসছি।”
“এখন?” একটু থতমত খেলেন সত্যেশ।
“এখন রওয়ানা দিচ্ছি। সন্ধের আগে পৌঁছব না।”
“আচ্ছা। রাতে খাবি তো?” এদেশে খাবার-দাবার নিয়ে চিন্তা করতে হয় না, তবু, সত্যেশ আর অনু দুজনেই ছেলেরা এলে বাইরে থেকে খাবার আনাতেন না।
“না-না,” ওদিক থেকে সায়কের গলা এল। “তুমি রান্না করবে না। আমি এসে রান্না করব। আমি ধরো আর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই বেরোব। সুতরাং সন্ধে সাতটা সাড়ে-সাতটার মধ্যেই পৌঁছে যাব। তুমি এখনও সাড়ে নটাতেই খাও তো?”
তা খান। “রাতে বৃষ্টি হয়েছে। একটু সময় হাতে নিয়ে বেরোস।”
“জানি। ওয়েদার দেখে নিয়েছি। চিন্তা কোরো না। লবস্টার খাও তো এখনও? না কি সিওয়ার্ড বারণ করেছে?”
করেনি জেনে নিশ্চিন্ত হয়ে সায়ক বলল, “আর তাহলে… আচ্ছা থাক। গিয়েই কথা হবে।” বলে লাইন কেটে দিল।
কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। ছেলেদের চেনেন সত্যেশ। ফোন রেখে সেল ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলেন, আর কোনও ফোন কি এসেছিল?
না। কেবল সায়কই করেছিল। ফোনটা পকেটে নিয়ে আবার নিচে গেলেন সত্যেশ। সায়ক রান্নাবান্না করতে ভালোবাসে। মায়ের কাছে শিখত ছোটো থেকে। বলেছে যখন, সবই নিয়ে আসবে, তবু একবার ফ্রিজটা খুলে দেখে নিলেন। ফ্রোজেন ডিনার, স্যালাডের উপকরণ, স্যুপ, কোনওটারই অভাব নেই। দু’জনের মতো হয়ে যাবে। রান্না সত্যেশ করেন না, তবে ভ্যারাইটির অভাব থাকে না।
বেলা হয়নি বেশি। সকালে ভেবেছিলেন দুপুরে ম্যাডেলিন’স বা রবিন’স-এ গিয়ে খেয়ে আসবেন। ম্যাডেলিন’স-এর সী-ফুড – সী বাস, স্ক্যালপ, কাঁকড়া আর লবস্টার সবই দারুণ। ফিলে মিঁয়ঁর-ও তুলনা নেই। তুলনায় রবিনের গোটা আম্বিয়েন্স, সেই সঙ্গে লবস্টার এঞ্চিলাডা, বিস্ক – এগুলোও অনেকদিন খাননি। আগে অনুর সঙ্গে প্রায়ই যাওয়া হত…
কিন্তু সায়কের রান্না বেশ রিচ। দুপুরে হালকা খাওয়াই উচিত।
ফ্রিজে আধখাওয়া খোলা স্যুপের প্যাকেটগুলো কী কী আছে জানেন। তবু আর একবার দেখে নিলেন। নাহ, বিফ-স্টু, স্টেক-অ্যান্ড-পটেটো, কোনওটাই খেতে ইচ্ছে করছে না। নতুন প্যাকেট খুলতেই হবে। রান্নাঘরের লাগোয়া লার্ডারের তাকে সাজানো স্যুপের প্যাকেটগুলোর আঙুল বুলিয়ে দেখলেন। গোটা ত্রিশেক প্যাকেট। সবকটা আলাদা। একই জিনিস বেশি রাখা পছন্দ করেন না সত্যেশ। সৌখিন খাইয়ে। কোনটা নেবেন? খানিক ভেবে তুলে নিলেন চেডার-ব্রকলি স্যুপ মিক্স। রান্নাঘরের কাউন্টারে রেখে চান করতে গেলেন। বললেন, “সিওয়ার্ড, দেখো। সত্যেশ আজ লাঞ্চ করবে ভেজিটেব্ল স্যুপ দিয়ে।”
**
খেয়ে একবার ভাবলেন শোবেন। দুপুরে শোয়া অভ্যেস নেই, মনে হল, যদি আবার দেখতে পান! লোভ সামলাতে হল। বয়স হয়েছে, ঘুম কমেছে। দুপুরে ঘুমিয়ে পড়লে রাতে জেগে থাকতে হয় অনেকক্ষণ। সত্যেশ সেটা পছন্দ করেন না।
বেরিয়েই পড়লেন। গাড়ি করে ঘুরলেন এদিক ওদিক। প্যাসিফিক কোস্ট হাইওয়ে ধরে খানিকটা গিয়ে মেঘলা আকাশের নিচে সমুদ্রের ভেজা হাওয়া খেলেন কিছুক্ষণ। পাশ দিয়ে শেরিফ গেল। প্যাক্সটার গাড়ির গতি কমিয়ে কাচ নামিয়ে জিগেস করল, “এভরিথিং অল রাইট?”
হাত নেড়ে আস্বস্ত করলেন। অনেক দিন পাশাপাশি থাকার সুবাদে সকলেরই মুখ চেনা। অনুর শেষ সময়ে প্যাক্সটারও এসেছিল। টুইন সিটিজ কমিউনিটি হসপিটাল থেকে ফিনিক্সে মেয়ো হসপিটালে নিয়ে যাবার জন্য হেলিকপ্টার আনাতে ফোন করেছিল ও-ই।
অস্থির লাগছে। গাড়ি চালিয়ে গেলেন আরও মিনিট দশেক দূরে মরো-বে সিনিয়র সিটিজেন সেন্টারে। কেউ নেই দিনের এই সময়ে, কোনও অ্যাকটিভিটিও হচ্ছে না, তবে কিছুদিন আগে একটা বুক-ক্লাবের কথা আলোচনা করেছিলেন বারবারা গিলেস্পির সঙ্গে। তারই বাহানা নিয়ে হাজির হলেন।
অফিসে নেই বারবারা। আজ আর ফিরবে না। গাড়ি ঘুরিয়ে আবার ফিরলেন, আগেই লাইব্রেরি যাওয়া উচিত ছিল।
পাব্লিক লাইব্রেরির রিডিং রুমটা সত্যেশের খুব প্রিয়। আজকাল সপ্তাহের অনেক ঘণ্টাই কাটে এখানে। আজও একটা বই নিয়ে বসলেন। বই খোলাই রয়ে গেল সামনে।
হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে ফিরে গিয়েছিলেন সেই রাস্তায়। সে দিন ফুটপাথে ক্যারমের আসর ছিল না। তবে ছাদও খালি ছিল। লাল দরজাটা খোলা ছিল। রোদে জ্বলে যাওয়া একটা পাতলা পর্দা – বোধহয় পুরনো শাড়ি সেলাই করে বানানো – হালকা বাতাসে নড়ছিল অল্প অল্প। উলটো ফুটপাথে পানের দোকানে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন একটা মিঠা পান বানিয়ে দিতে। মা যেরম চাইত, তেমন। চুন কম, খয়ের, মিষ্টি সুপারি, চমনবাহার, আর কী কী এখন মনে নেই… হাতে নিয়ে কী মনে হয়েছিল, পানটা মুখে দিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আর একটা বানাও। সেটা সঙ্গে নিয়েছিলেন মা-কে দেবেন বলে। কিন্তু বারান্দায় কেউ আসেনি। আরও একটু সময় কাটানোর জন্য এক প্যাকেট ফিলটার উইলস চেয়েছিলেন। তারপর একটা দেশলাই চেয়েছিলেন। তারপরে একটা বড়ো নোট দিয়েছিলেন, যাতে ভাঙানি পেতে দেরি হয়। তাও বারান্দা খালিই রয়ে গিয়েছিল। প্রায় সারাক্ষণ আড়চোখে খোলা দরজার দিকে চেয়েছিলেন সত্যেশ। হাওয়ায় পর্দার নড়ায় চমকে চমকে উঠেছিলেন। বুঝি এল…
আসেনি। সে দিনই শেষ গিয়েছিলেন…
সাইলেন্ট ফোনে আলো জ্বলে উঠল। সায়ক। বাইরে দিনের আলো যথেষ্ট রয়েছে। এরই মধ্যে বাড়ি এসে দরজা বন্ধ দেখেছে তা হতে পারে না। দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গিয়ে ফোন ধরলেন।
সায়ক এখনও ঘণ্টা দেড়েক দূরে। রাস্তায় বৃষ্টি নেই বলে দেরি হয়নি। সত্যেশ ফিরলেন। লাইব্রেরিতে কিছুই পড়েননি। কোন বইটা হাতে নিয়েছিলেন তাও মনে নেই। বাড়িতে একা থাকলে সামান্য কিছু আলো জ্বালেন। আজ ছেলে আসবে, তাই গেট থেকে ড্রাইভ-ওয়ে, পোর্চ, বসার ঘর আর ডাইনিং রুমের আলো জ্বেলে রাখলেন। দোতলার ঘরের আলো জ্বাললেন সামান্য, যাতে বাইরে থেকে অন্ধকার না লাগে। টেরেসের আলো জ্বাললেন। পাঁচিলের নিচে কনসিলড আলোর সারি, বাইরে ভেতরে দু-দিক থেকেই মোহময়ী লাগে। অনুর খুব প্রিয় ছিল এই আলোগুলো।
আরও ঘণ্টা দেড়েক সময় পার করে সায়কের গাড়ি যখন গেটের সামনে এসে দাঁড়াল, সত্যেশ তখন সন্ধের ঘনায়মান অন্ধকারে পোর্চে বসে। রিমোট দিয়ে গেট খুলে দিয়ে পোর্চের দরজা খুলে ছেলেকে স্বাগত জানাতে বাইরে সিঁড়িতে এলেন।
দুই ছেলেই কলেজে পড়ায়। তাদের চেয়ে সত্যেশের ঠাট-বাট অনেক বেশি রিটায়ার্মেন্টের পরেও। সায়কের কাদামাখা তোবড়ানো গাড়িটা দেখে অল্প বিরক্ত লাগল সত্যেশের। সত্তরের দশকে এরকম গাড়ি চড়ে বেড়াত প্রফেসররা। জমানা পালটেছে, কিন্তু সত্যেশের দুই ছেলে ওঁর সৌখিনতার ছোঁয়াও পায়নি। শুধু সায়ক তবু ভালো খেতে পছন্দ করে। সন্দীপ তাও নয়।
সায়ক গাড়ি থেকে মাথা বের করে বলল, “হাই, ড্যাড, তুমি সন্ধের পরে বাইরে বসে আছ কেন?”
“তুই আসবি বলে বসে আছি,” বলে জ্যাকেটের পকেট থেকে গ্যারেজের দরজার রিমোটটা বের করে বললেন, “গাড়ি কি পেছনে নিয়ে যাবি? মালপত্তর অনেক আছে? বের করে নিয়ে গ্যারেজ করিস?”
সায়ক নেমে বলল, “হ্যাঁ, পেছনে নিয়ে যাব। দাঁড়াও। তার আগে একটা কাজ আছে।”
সায়কের কথা শেষ হতে না হতে সত্যেশ দেখলেন, গাড়ির ডানদিকের সামনের দরজাও খুলতে লেগেছে। থতমত খেলেন। সায়ক সঙ্গে কাউকে আনছে বলেনি। সত্যেশ দুজনের খাবার মত থালা বাটি বের করেছেন। টেবিলে এখন আর একটা জায়গা করতে হবে।
দরজা খুলে বেরোল একটা মেয়ে। একে সত্যেশের থেকে অনেকটা দূরে, তায় গাড়িটা সায়ক দাঁড় করিয়েছে ছায়ায় – পোর্চের বাইরের আলোটা ওখানে ম্লান। তবু বুঝলেন মেয়েটা ভারতীয়, বা ভারতীয় বংশোদ্ভূত। ওরকম কালো চুলে লম্বা এক-বিনুনি আর কোনও জাতির মেয়ে করে বলে উনি জানেন না।
সেই সঙ্গে একটা অসহায়তা এসে বসল মাথা জুড়ে। না-বলে একটা মেয়েকে নিয়ে এল সায়ক? এখন রাতে থাকবে কোথায় মেয়েটা? না কি এই অজুহাতে সায়কও হোটেলে গিয়ে রাতে থাকবে?
মেয়েটা একটা ক্যাসেরোল হাতে গাড়ির পেছন দিক থেকে হেঁটে এগিয়ে আসছে, সায়ক ওর ডান পাশে পৌঁছে হাত বাড়িয়ে দিল। মেয়েটা ওর কনুইয়ের ভাঁজে ডান হাত রেখে আসছে, মাথা নিচু, হিল তোলা জুতো… পোর্চে ওঠার জন্য চারটে সিঁড়ি, তার নিচে এসে মেয়েটা মুখ তুলে তাকাল আর সত্যেশের মনে হল যেন ক্যালিফোর্নিয়ার কুখ্যাত ভূমিকম্প পায়ের নিচের মাটি নড়িয়ে দিয়ে গেল। এ সেই মুখ। যে মুখের ছবি গত চার দশকেরও বেশি বয়ে বেড়াচ্ছেন সত্যেশ। যে মুখ গত তিন মাস রোজ রাতে দেখা দিয়ে যাচ্ছে স্বপ্নে।
হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে উঠতে উঠতে চারটে সিঁড়ি পেরিয়ে দুজনে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। হাত থেকে গ্যারেজের দরজার রিমোটটা নিয়ে সায়ক বলল, “এ হল প্রমিতি। আমি গাড়ি পেছনে নিয়ে যাচ্ছি।”
সত্যেশ কিছু বলার আগে সায়ক স্ক্রিন ডোর ঠেলে খুলে বলল, “কাম ইনটু মাই ফাদার্স পার্লার।” সত্যেশও হাতটা বাড়িয়ে বললেন, “প্লিজ, কাম ইন,” আর প্রমিতিও ভেতরে গেল। বসার ঘরে ঢুকে এদিক ওদিক দেখে বলল, “আঙ্কল, আমি ফুল আনতে চেয়েছিলাম, সায়ক আমাকে বলল, আপনি ফুল-টুলের ধার ধারেন না। তাই আমাকে দিয়ে এটা আনাল।” বলে হাতে ধরা ক্যাসেরোলটা বাড়িয়ে দেবার মুহূর্তে সায়ক এসে, “এতে ডিনার আছে,” বলে নিয়ে নিল। প্রমিতি বলে চলল, “অবশ্য ফুল আনলে অতিরিক্ত হত!”
সায়কও এদিক ওদিক চেয়ে বলল, “তাই তো, এত ফুল আমি আগে কখনও দেখিনি… বাবা ফুল দিয়ে ঘর সাজাচ্ছে… বাপরে!” সত্যেশ কিছু বললেন না। অনুর শেষ ক’বছরের এই সখটা গত তিন মাসে আর বদলাননি। বরং গেল মাসে আবার ফ্লোরিস্টের সঙ্গে কনট্র্যাক্টটা রিনিউও করেছেন।
বসার ঘরে বসে সত্যেশের মনে হল, এই মুখ যতই একই রকম হোক না কেন, এটা সায়কের জেনারেশনের মুখ। সত্যেশের স্মৃতির মুখ এর চেয়েও কমবয়সী। কিন্তু আজ সে মুখ এমন অল্পবয়সী আর নিশ্চয়ই নেই।
পরিচয়ের পালা শেষ হয়নি। সায়ক বলে চলল, “প্রমিতিও আপাতত ফিনিক্সে। ও ইথাকায় কোর্নেলে আর্কিটেকচার নিয়ে পি-এইচ-ডি করছে। ওর স্পেশালাইজেশন ইন্টিরিয়র। থিসিসের সাব্জেক্ট মোজাইকস অফ অ্যামেরিকান পাস্ট। ওকে বললাম হার্স্ট কাস্ল্-এর মোজাইক শুনেছি বিশ্ববিখ্যাত। চলো দেখে আসি।”
সত্যেশ বলেই ফেললেন, “আমাকে একবার বলবি তো! স্পেয়ার বেডরুমটা একেবারে অগোছাল হয়ে রয়েছে…”
থেমে গেলেন। যদি বলে – আমরা দুজনে আমার ঘরেই থাকব – কী করবেন সত্যেশ? কী বলবেন? কিন্তু সায়ক হেসে বলল, “ও আজ দাদার ঘরেই শোবে। দাদা পারমিশান দিয়েছে।”
ও।
পরদিন সকালেই ওরা হার্স্ট কাস্ল্ যাবে। সারা দিন ওখানেই কাটিয়ে সন্ধের কন্ডাকটেড ট্যুর দেখে চলে যাবে ফিনিক্স। আরও এক দিনের ছুটি। সে দিন ওরা দুজনে যাবে স্যান ডিয়েগো। প্রমিতির মা-র সঙ্গে দেখা করতে।
বললেন, “তোমার বাবা…?”
প্রমিতি বলল, “বাবা নেই। মা এখন একাই থাকে। আমার দাদা থাকে ক্যানাডায়। টরোন্টো।”
ভীষণ লোভ লাগছিল আরও কথা জিজ্ঞেস করতে। কী ভাবে করবেন? জানতে চাইলেন, “দেশে কে আছে? আমাদের আর কেউ নেই। আমার ভাইবোন ছিল না, আর ওদের মা-র একমাত্র দাদাও আর নেই। দাদার ছেলেমেয়ের সঙ্গে শুধু ই-মেইলেই যোগাযোগ। তাই দেশে ফেরা হয় না।”
প্রমিতিও দেশে যায়নি বহুদিন। সুতরাং ওরা কোথা থেকে এসেছে, কোথায় বাড়ি ছিল, ইত্যাদি জানা গেল না। এদেশের রীতি নয় সেটা, তবে দেশজ-রা করে থাকে। সন্দীপের বউ লাটভিয়ান। ওর ক্ষেত্রে কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগই ছিল না। আগ বাড়িয়ে কতটা জিজ্ঞেস করা যায় ভেবে পাচ্ছিলেন না। কথাটা ঘুরিয়ে নিলেন হার্স্ট কাস্ল-এর দিকে। খানিকক্ষণ একথা-সেকথার পরে সায়ক উঠল গাড়ি থেকে বাজার বের করে এনে রান্না করতে। এক ফাঁকে বাবা-সুলভ প্রশ্ন করে নিলেন একটা। বললেন, “লবস্টার-ইন-বাটার বানাচ্ছিস, শার্ডনে বের করব, না শ্যাম্পেন খুলব?”
সায়ক বলল, “শার্ডনেই খোলো।”
ডিনার ভালোই হয়েছিল। কিন্তু আড্ডা জমল না। কী বলবেন দুজনকে, কী জিজ্ঞেস করবেন প্রমিতিকে, ভেবে পেলেন না। অনু থাকলে এমন অসহায় লাগত না। সায়ক আর প্রমিতিও জমাতে পারল না। কথা হোঁচট খেতে খেতে চলল, শেষে যখন শুতে গেলে আর অভদ্রতা হবে না, তখন সত্যেশ গুডনাইট বলে চলে গেলেন নিজের ঘরে।
শুতে না গিয়ে টেরেসে বসে রইলেন অনেকক্ষণ। গ্রীষ্মে বৃষ্টি এখানে কমই হয়। কাল রাতের মেঘ উড়ে গেছে, আকাশ পরিষ্কার, গরমও নেই। কী মনে হল, ফোনটা বের করলেন পকেট থেকে। চমকে দেখলেন, ফোন বাজছে। সন্দীপ। ধরলেন।
“আবার ফোন দূরে রেখেছিলে?” সন্দীপের নালিশভরা গলা ভেসে এল।
সায়ক আর প্রমিতি এখনও ওঠেনি সিঁড়ি দিয়ে। বললেন, “না রে ছিল পকেটেই। কিন্তু দুপুরে সেই যে লাইব্রেরিতে গিয়ে সাইলেন্ট করেছি, সেটা আর বদলানো হয়নি।”
“বড্ডো দুশ্চিন্তা করাও। ভাগ্যিস আজ সায়ক আছে বাড়িতে…” বলে গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হল? পছন্দ হয়নি তোমার?”
একটু অবাক হলেন। “কী পছন্দ হবে?”
তেমনই ফিসফিস করে সন্দীপ বলল, যেন সামনেই বসে আছে, “আরে মেয়েটাকে। কী নাম – ওই যে, প্রমিতি…”
এবার সত্যেশও গলা নামালেন। বললেন, “কে বলল পছন্দ হয়নি? বেশ মেয়ে।”
“কিন্তু ঠিক করে কথা টথা বললে না, সায়ককেও কিছু বললে না…”
এবার বাবা-সুলভ গাম্ভীর্য এনে বললেন, “সায়কও তো আমাকে কিছু বলল না। তাও তো আমি জিজ্ঞেস করেছি শার্ডনে, না শ্যাম্পেন? বলল, শার্ডনে।”
মহাদেশের ওপার থেকে সন্দীপের হাসির শব্দ ভেসে এল। “বাবা, ও তোমার এই সব ধাঁধা-মার্কা প্রশ্ন কোনওদিন বুঝতও না, আজও বোঝেনি। যাই হোক। আমি ওকে জানিয়ে দিচ্ছি, চিন্তা নেই – বাবা অ্যাপ্রুভস, তাই তো?”
তাই। সায়ক সবসময়েই সত্যেশের অ্যাপ্রুভাল খুঁজত। ওর ক্লাস টিচার বলেছিল, “হি থিঙ্কস দ্য ওয়ার্ল্ড অফ ইউ। ও ভাবে ওর দাদা তোমার প্রিয়। তাই তোমার ভালোবাসা পেতে আরও একটু খাটে।”
তার দরকার ছিল না। দুজনকে কখনওই আলাদা চোখে দেখেননি সত্যেশ। মাথা নেড়েছিল ক্লাস টিচার। “হি ডাজ নট নো দ্যাট। ও ভাবে আরও একটু এফর্ট দিলেই বাবার চোখে অ্যাপ্রুভাল পাবে। ইট ইজ আপ টু ইউ টু প্রুভ ইওরসেলফ ইন হিজ আইজ।”
সন্দীপ ফোনে আগে জানিয়েছিল লাটভিয়ার জোয়ানার কথা। তারপরে নিয়ে এসেছিল দেখা করতে। সায়ক দাদার সঙ্গে কথা বলেছে। এখনও বিয়ে ঠিক করেনি। আগে বাবার কাছে নিয়ে এসেছে প্রমিতিকে। বাবা অ্যাপ্রুভ করলে তবেই কথা এগোবে।
“বাবা?” লাইনের ওপারে সন্দীপ এখনও রয়েছে। ভাবছিলেন এখনই যাবেন কি সায়ককে বলতে? কিন্তু সন্দীপের ঘাড়ে দায়িত্বটা দিয়ে দিলে কাজ কমে। বললেন, “হ্যাঁ। আমার আপত্তি নেই। মেয়েটা দেখতে শুনতে ভালোই। কিন্তু ওর বাড়ির সম্বন্ধে কিছুই জানি না…”
“সে জেনে নেওয়া যাবে। ওর মা তো দূরে থাকে না। বলে দিচ্ছি তাহলে?”
রাত তিনটেয় ঘুম ভাঙল আজ। বাইরে তারাভরা রাত উজ্জ্বল। আজ গাড়ি চালাচ্ছিলেন সত্যেশ নিজেই। আর আজ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল প্রমিতি।
**
সকালে ঘুম ভেঙে আর ভালো করে মনে করতে পারলেন না। প্রমিতি কি ছিল বারান্দায়? না কি ছেলেবেলায় দেখা সেই মুখটাই? বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে বারান্দার দিকের ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর পর্দা সরিয়ে দেখলেন টেরেসে দাঁড়িয়ে প্রমিতি আর সায়ক।
আড়াআড়ি দরজা টানার শব্দে মুখ ফিরিয়ে তাকাল দুজনেই। এক ঝলক উদ্বেগ কি দেখা গেল চোখেমুখে? সত্যেশ একগাল হেসে বললেন, “গুড মর্নিং। তোমরা কি তাড়াহুড়ো করে বেরোবে, না কি ধীরেসুস্থে ব্রেকফাস্ট করে?”
প্রমিতির মুখ থেকে মেঘটা কেটে গেল। উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল, “আঙ্কল্ আপনার এই ছাদটা না, জাস্ট দারুণ। মা দেখলে একেবারে ফিদা হয়ে যেত। মা বারান্দা খুব পছন্দ করে।”
খুব সাবধানে, যাতে গলার সুরে কিছু ধরা না পড়ে, বললেন, “তোমাদের বাড়িতেও বারান্দা আছে?”
ঠোঁট উলটে প্রমিতি বলল, “বারান্দা নেই। ওই, স্যান ডিয়েগোর অ্যাপারটমেন্ট। তবে মা নাকি ছোটোবেলায় বারান্দাওয়ালা বাড়িতে থাকত। ভাড়া বাড়ি ছিল। তারপরে অবশ্য সল্ট লেকে ফ্ল্যাটবাড়িতে চলে যায়।”
সায়ক বলল, “আমি কফি বানিয়ে আনি। বাবা, কোন কফি বানাব?”
আগে তিন চার রকম কফি থাকত, এখন নেই। বললেন, “অ্যারাবিকাই আছে খোলা। দেখ, কিচেন কাউন্টারে।”
সায়ক চলে গেলে প্রমিতি বলল, “কী দারুণ আপনার বাড়িটা! বাগানটাও খুব সুন্দর। গাছের ফাঁক দিয়ে সমুদ্রটা কী অদ্ভুত ভালো!”
সত্যেশ বললেন, “আগে গাছগুলো যখন ছোটো ছিল, তখন আরও সুন্দর দেখাত। তখন খেয়াল হয়নি, হলে সামনের গাছগুলো লম্বা হবার মত লাগাতাম না। এখন তো আর কাটার উপায় নেই, আর এগুলোর আয়ু আমার চেয়ে বেশি। ফলে আর আমি আগের মত সমুদ্র দেখতে পাব না।”
প্রমিতি বলল, “মা সমুদ্র খুব ভালোবাসে। সেই জন্যই বাবা খুঁজে খুঁজে চাকরি নিত সমুদ্রের তীরেই। ইচ্ছে ছিল কোনও দিন নিজের বাড়ি করবে এরকমই কোথাও।”
আবার সাবধানে, অতি উৎসুক ভাব যাতে প্রকাশ না পায়, বললেন, “তোমার বাবা…?”
“আমার বাবা ডাক্তার ছিল। সার্জন। মারা গেছেন প্রায় ন’বছর হল। হঠাৎই হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। হাসপাতালেই। ওয়ার্ড থেকে আই-সি-ইউ-তে নিয়ে যাবার সময়ও পাওয়া যায়নি।”
এক ধাক্কায় পেছিয়ে গেলেন কতগুলো দশক। জয়েন্ট এন্ট্রান্সে চান্স পাওয়ার পর ডাক্তারি ভার্সাস ইঞ্জিনিয়ারিং-এর টানাপোড়েন। শেষে, ‘মড়া-কাটতে-পারব-না’ বলে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছিলেন সত্যেশ।
“আর মা?” এবার সাহস পেয়ে আরও কনফিডেন্টলি প্রশ্ন করলেন।
“মা হোম-মেকার। আগে টুকটাক কাজ করত, আজকাল বাড়িতেই থাকে।”
“তুমি তো অনেক দূরে। তোমার দাদাও টরোন্টোতে…” এটা প্রশ্ন নয়, কিন্তু এর উত্তর আর পাওয়া হল না। কফি নিয়ে ছাদে বেরিয়ে এল সায়ক। বলল, “আঃ, যা গন্ধ বেরিয়েছে! মাঝে মাঝে মনে পড়ে আর ভাবি সব ছেড়েছুড়ে এসে বাবার হোটেলেই বাসা বাঁধি।”
সত্যেশ বললেন, “কেন, কাছেপিঠে কাজ নিয়ে আয় না?”
সায়ক বলল, “কাছেপিঠে বলতে তো লস এঞ্জেলস। সেও সাড়ে তিন ঘণ্টার রাস্তা। রোজ সাতঘণ্টা গাড়ি চালানো পোষাবে না।”
কথাটা আবার ঘুরে গেল হার্স্ট কাস্ল্-এর দিকে। কখন বেরোবে, কী কী করবে, কোথায় খাবে… আস্তে আস্তে আলোচনাটা থেকে সত্যেশ বেরিয়ে গেলেন কখন, তারপরে ব্রেকফাস্ট, তারপরে টা-টা, তারপরে গাড়িটা গেট থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে মোড় নিয়ে চলে যাওয়া… সত্যেশ দেখলেন বাগান পরিচর্যা করতে এসেছে কেয়ারটেকার, তাই ফুলগাছের তদারকির জন্য সে দিকে এগোলেন।
**
এক সপ্তাহর মধ্যেই সন্দীপ জানাল যে প্রমিতির মা ‘হ্যাঁ’ বলেছেন। “কিন্তু তোমার সঙ্গে দেখা করতে চান। বলেছেন, আজকালকার পাকামি মারা বিয়েতে রাজি নন। মা-বাবার অ্যাপ্রুভাল প্রতি পদে লাগবে।”
সত্যেশ কী বলবেন বুঝতে না পেরে বললেন, “হুঁ…”
“যাই বলো, এই সব ঝামেলার হাত থেকে তোমাদের আমি মুক্তি দিয়েছিলাম।”
তা দিয়েছিল। কিন্তু প্রমিতির মা আসবে, সেটা কি ঝামেলা? সত্যেশের স্বপ্ন কমে এসেছে। কিন্তু এখন যখনই দেখেন, তখনই প্রমিতি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। আর স্বপ্ন তখনই শেষ হয়। বললেন, “দেখাসাক্ষাতের উপায় কী হবে?”
সন্দীপ সে সব জানে না। বলল, “তুমি যাবে, না কি উনি আসবেন?”
হাসলেন সত্যেশ। “ট্র্যাডিশনালিস্ট হলে কিন্তু ওনার আসা উচিত। কনে পক্ষ।”
টেলিফোনের ওপারেও সত্যেশ সন্দীপের মুখ বাঁকানোটা দেখতে পেলেন। বলল, “সে উনি আসতে পারবেন। এমনিতে শক্তসমর্থ। বয়স তোমার চেয়ে একটু বেশি হলেও চলাফেরায় অসুবিধে নেই।”
“তুই বয়সও জানিস?”
ওপার থেকে হাসল সন্দীপ। বলল, “আরে তুমি তো সায়ককে পাত্তাই দিচ্ছ না। তাই ও বেচারা আমাকেই ফোন করে করে বলে।”
সায়কের ভুল ভাঙেনি এখনও। তবে এখন সে আর বাচ্চা নেই। তার ভ্রান্তি নিয়ে সে চললে তার খেসারত নিজেকেই দিতে হবে।
সন্দীপ বলে চলেছে, “অবশ্য ভদ্রমহিলা আসার জন্য উৎসুক। মেয়ে এমন টেরেসের গল্প শুনিয়েছে…”
ফোন রেখে ঘড়ি দেখলেন। বিকেল হয়নি। সায়ক এখনও ইউনিভার্সিটিতেই। হয়ত ক্লাস নিচ্ছে। ফোন করলে যদি দুশ্চিন্তা করে, বাবার কী হল? তাই ভেবেচিন্তে একটা ই-মেইলই লিখলেন। বক্তব্য সামান্য – কল মি হোয়েন ফ্রি।
পাঠানর দু মিনিটের মধ্যে মোবাইল বাজল।
“বাবা?”
“স্যান-ডিয়েগো গিয়েছিলি? কী বললেন প্রমিতির মা?”
খানিকটা অস্বস্তিভরা নৈঃশব্দের পরে সায়ক বলল, “ইয়ে, না, মানে ঠিক আছে, মানে…”
সন্দীপ ফোন করেছিল কি বলবেন? এক লহমা ভেবে ঠিক করলেন, না। বললেন, “দিন-টিন ঠিক হয়েছে?”
“না… ইয়ে… মানে… উনি তোমার সঙ্গে কথা বলবেন…”
“উনি মানে প্রমিতির মা?”
“হ্যাঁ। মানে সামনা সামনি। ফোনে না…”
“বেশ তো। কে যাবে কোথায়? আমি যাব, স্যান ডিয়েগো?”
সায়কের উত্তর শুনে বুঝলেন সায়ক এই সম্ভাবনাটায় হাতে চাঁদ পেয়েছে। “তুমি যাবে? তাহলে তো খুব ভালো হয়। না কি…”
“যে কেউ একজন গেলেই হল। এ তো দেশের বিয়ে নয়, যে উভয়পক্ষকে ঘর-দুয়ার দেখতে হবে, ফ্যামিলি কী রকম জানতে হবে। দাদা বলল এসব ঝামেলা থেকে আমাদের মুক্তি দিয়েছিল। আসলে মুক্তিটা যে আমি দিয়েছি অ্যামেরিকায় সেটল্ করে, সেটা তোরা জানিস না।”
“তাহলে আমি ফোন করে…”
“নম্বরটা আমাকে দে…” সাহস করে বলেই ফেললেন।
সায়ক হতবাক। “নম্বর, মানে প্রমিতির মার নম্বর? তুমি ফোন করবে?”
সত্যেশ বললেন, “কেন, অসুবিধে কী? বরং তুই ফোন করে দিন ঠিক করবি, সে দিন আবার আমার যদি সিওয়ার্ডের সঙ্গে বা অ্যাকাউন্টেন্টের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকে, যেগুলো ক্যানসেল করা ঝামেলা, তখন আবার ফিরে ফোন করতে হবে। তারচে’ আমিই যদি ফোন করে কথা বলে দিন ঠিক করে তোকে জানিয়ে দিই?”
সন্দীপ হলে ঠিক বলত, আর সেদিন যদি আমার অসুবিধে থাকে? সায়ক সে কথা বলল না। নম্বরটা বলে দিল। সত্যেশ লিখে নিয়ে বললেন, “কখন ফোন করা উচিত?”
সায়ক বলল, “সন্ধের পরে সাধারণত বাড়িতেই থাকেন।”
সন্ধে অবধি একবার এঘর একবার ওঘর, একবার টিভি, একবার বারান্দা করে কাটল। সন্ধের পর ফোন করলেন। পরিচয় দিতে হল না। বোঝা গেল খবর পৌঁছে গেছে। বললেন, “আপনার সুবিধেমত একদিন আমি যেতে পারি। তবে আমার একটা সাজেশন আছে। চাইলে এখানে দু’দিন ছুটি কাটিয়ে যেতে পারেন। সুন্দর শহর, আমার বাড়িতে আপনাদের দুজনের থাকার ব্যবস্থা হবে অনায়াসে। আগে এসেছেন এখানে?”
এক কথায় রাজি হয়ে যাবেন এটা ভেবেছিলেন, হয়েও গেলেন।
যেদিন সন্ধেবেলা সায়কের গাড়িতে আবার প্রমিতি আর প্রমিতির মা এসে পৌঁছল, সেদিন সারা বাড়ি আর বাগান আলোয় ঝলমল করছে। রাই বাড়িতে ঢোকামাত্র যেন আনন্দ আর খুশি ঝড় বয়ে গেল। সায়ককে এত হাসতে কখনওই দেখেননি সত্যেশ। নিজেও এত হইহই কবে শেষ করেছেন মনে পড়ে না।
টেরেস দেখে মুগ্ধ রাই। বলল, “আমার ছোটোবেলার বাড়িতে এমন একটা ছাদ ছিল, জানেন? দৈর্ঘে-প্রস্থে এত বড়ো না। এত সুন্দর দৃশ্যও ছিল না। ছোটোবেলায় বাবা-মা ছাদে গানের আসর করতেন। পরে দুপাশের বাড়ি এত উঁচু হয়ে গেল, আর সামনের রাস্তায় আজেবাজে ছেলেপিলের ভীড় বাড়তে শুরু করল…”
সত্যেশের মনে সন্দেহ নেই আর। ভাবলেন বলেন, তারা সামনের ফুটপাথে ক্যারম খেলত?
এ প্রশ্ন করা যায় না। রাই বলে চলেছে, “পরে বাড়ির ভেতরে গানের আসর হত, কিন্তু অত জমত না। পরে অবশ্য সল্ট লেকের ছাদে আসর হত – তখন সল্ট লেকে ভীড় ছিল না, আকাশ অনেক পরিষ্কার থাকত…”
সারা সন্ধে রাই আর প্রমিতি দাপিয়ে গল্প করল। সত্যেশ কখনওই বেশি হইচই করতেন না, কিন্তু বিশেষত রাইয়ের কী একটা অদ্ভুত শক্তি আছে, সত্যেশের বাকসংযম ভেঙে গেল রাত বাড়ার আগেই। কত গল্প করলেন সত্যেশ নিজেও। অবাক হয়ে গেলেন এত কথা মনে আছে দেখে। প্রথম ইউ-এস-এ আসা, তখন এমনই হাবা-গোবা, যে আসার আগে বাটার দোকানে গিয়ে বলেছিলেন, “আমি বরফের দেশে যাব, একটা উপযুক্ত জুতো দিন তো…”, বলে সেলসম্যানের বুদ্ধিতে অ্যাম্বাসেডর কিনে নিয়ে তিন দিনে সে জুতোর দফা রফা করা…, প্রথম তিন মাস কী ভাবে কেবল পাউরুটি খেয়ে ডিনার করা…
“কেন, কেবল পাউরুটি কেন?” অবাক হয়ে জানতে চাইল প্রমিতি।
“প্রথম যখন এসেছি, আমার এমপ্লয়ার আমার থাকার ব্যবস্থা করেছে একটা মোটেলে। সামনে মস্তো ফ্রি-ওয়ে। আট লেন, না বারো লেন, মনে নেই। উলটো দিকে সুপারমার্কেট, কিন্তু রাস্তা পেরোন’র উপায় নেই। অন্তত মাইল দুয়েক গেলে তবে পেডেস্ট্রিয়ান ক্রসিং। নতুন অ্যাম্বাসেডর জুতোর যা অবস্থা, ওই পরে অত হাঁটা সম্ভব না। আর রাক্ষসের মতো স্পিডে দানবের মতো বিশাল বিশাল ট্রাক যাচ্ছে, যেখানে সেখানে পার হওয়া যায় না! ফলে কী করি, দুপুরে অফিসে ক্যান্টিনের লাঞ্চ খাই, আর সন্ধেবেলা মোটেলের গায়ে একটা স্যান্ডুইচ বার – তাতে ঢুকে দেওয়ালে লাগানো ছবি দেখে, যেটা মনে হয় সবচেয়ে কম অখাদ্য হবে, সেটাই খাই। শেষে এক দিন ঘরে এসে স্যান্ডুইচে কামড় দিয়েছি – প্যাৎ করে এক তাল কাঁচা রক্ত পড়ল আমার জামায়। সঙ্গে সঙ্গে যতটুকু খেয়েছি, সব বমি হয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে বহুদিন, যতদিন না গাড়ি কিনে নিজে চলতে শিখেছি, ওখান থেকে স্যান্ডুইচ কিনতাম, মাংস-টাংস সব ফেলে দিতাম, আর শুধু রুটি খেয়ে ফেলতাম।”
অবাক হয়ে সায়ক বলল, “কিন্তু তুমি তো কোনওদিন রেয়ার ছাড়া বিফ্-স্টেক খাওনি। কাটলে রক্ত বেরোত। আমার গা গোলাত।”
ততোধিক অবাক হয়ে সত্যেশ বললেন, “কোনওদিন তো বলিসনি? আমি তো তোদের জন্মের অনেক আগেই পাকা সাহেবি খানায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। সে দিকে আমার কোলিগ, স্যামুয়েল-এর অবদান অনস্বীকার্য। আমাকে হাতে ধরে স্টেক খেতে শিখিয়েছিল। ধাপে ধাপে।”
এসব গল্প ছেলেরা কেন, অনুও শোনেনি কোনওদিন।
প্রমিতি বলল, “বাবাও বলত, শুরুতে খুব অসুবিধা করে থেকেছে। ভোরবেলা গ্যাস-স্টেশনের অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজ করত। তখন বড়োলোক মহিলারা বেরোতেন, তাঁরা কখনও নিজে হাতে গাড়িতে গ্যাস ভরতেন না, আর অনেক টিপস-ও দিতেন।”
রাই বলল, “আর খাওয়াদাওয়ায় এমনই অসুবিধে যে শেষে ওর বাবা টেলিফোন ডিরেক্টরি খুলে খুঁজে খুঁজে বাঙালি পদবীওয়ালা লোকেদের ফোন করতে শুরু করেছিল – একদিন আপনার বাড়িতে ডেকে আমাকে ডালভাত খাওয়াবেন?”
উৎসুক হয়ে সত্যেশ বললেন, “তার কী ফল হল? তখন কি বাঙালিরা এমন আতিথেয়তা করত আজকের মত?”
মাথা নেড়ে রাই বলল, “মোটেই না! বরং উলটো। কেউ কেউ দুটো বাজে কথাও শুনিয়েছিল। অবশ্য এও ঠিক, যে বেশিরভাগই বলেছিল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্য অবশ্য, আমি ফোন করব। বলে আর করেনি।”
রাইয়ের কথার রেশ ধরে প্রমিতি বলে চলল, “শেষে একদিন কাকে ফোন করেছে বাবা, বাড়ির মালিকের মা সবে দেশ থেকে দু’দিন হল এসে পৌঁছেছে। বিদেশে বাঙালি ছেলের এই দুর্দশা শুনে সেদিনই ছেলেকে পাঠিয়েছে – যা গিয়ে নিয়ে আয়। মজা হচ্ছে, এই অপরিচিত বাঙালি মহিলা আমার মায়ের আপন পিসি… সুতরাং এর পরের গল্পটাও বোঝা যাচ্ছে…”
প্রমিতির হাতের ডানায় আলতো থাপ্পড় মেরে রাই বলল, “ধ্যাৎ, চুপ কর তো!”
এই বয়সেও মানুষ এমন ব্লাশ করতে পারে? অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন সত্যেশ।
**
পরদিন সকালে, ব্রেকফাস্টের পরেই চলে যেতে হল ওদের। স্যান ডিয়েগোতে মা-কে নামিয়ে আবার ফিনিক্স – পৌঁছতে ভোর রাত। পরদিন সকাল সকাল সায়ক আর প্রমিতিকে ইউনিভার্সিটি যেতে হবে। ওরা বেরিয়ে যাবার পরে সত্যেশের মনে হল চিরকালের শান্ত, নির্বাক বাড়িটার নিস্তব্ধতা যেন আরও বেড়ে গেছে। কোথাও গিলে খেতে আসছে সত্যেশকে। বাধ্য হয়ে বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে।
সন্দীপ ফোনে বলল, “ভাইকে বেশ নিশ্চিন্ত শোনাল, বুঝলে? মনে হল, তুমি অ্যাপ্রুভ করেছ।”
“অ্যাপ্রুভ তো করেইছিলাম। এই ভিজিটের সঙ্গে তো তার সম্পর্ক কিছু ছিল না,” বললেন সত্যেশ।
“তবু…”
“বিয়ে কবে তার কিছু ঠিক করেছে দুজনে?” জানতে চাইলেন সত্যেশ।
সন্দীপকে এবার একটু বিরক্ত শোনাল। “আরে, এ বিষয়েও মায়ের কথা মেনে বিয়ে করবে। প্রমিতির মা আর দাদা এখন আলোচনায় মগ্ন।”
সত্যেশ তামাশা করে জানতে চাইলেন, “পাঁজি দেখা চলছে?”
সন্দীপ হাসল। “হয়ত। জানি না। তবে না চললেই আশ্চর্য হব। সবাই তোমার মতো নয়, বাবা। মা-ও আমার বিয়ের দিন পঞ্জিকা দেখেই ঠিক করতে চেয়েছিল।”
তা বটে।
দিন কাটে। বিয়ে নিয়ে অফিশিয়াল পারিবারিক ইনভলভমেন্ট প্রমিতির দিক থেকে বেশি। ফলে সন্দীপকে প্রমিতির দাদার সঙ্গে নানা আলোচনা করতে হয়, আর কখনও কখনও রাই ফোন করে সত্যেশকে। নানা ছোটোখাট সমস্যা আলোচনা হয়। এগুলো কোনওটাই সত্যেশের কাছে জরুরি নয়। তবু শোনেন। রাইয়ের ফোন পেতে ভালো লাগে।
এই বয়সে এসে নতুন করে প্রেমে পড়েছেন, ভাবতেই অবাক লাগে সত্যেশের। আবার ভাবেন। নতুন প্রেম কি? নাকি পুরোনো প্রেম? আগে ওটা কি প্রেম ছিল? কী ছিল প্রেম না হলে?
উত্তর পান না।
ভালোও লাগে। মনে মনে বাড়িতে নানা জায়গায় রাইকে দেখতে ভালো লাগে। কিচেনে ব্রেকফাস্ট বানাতে বানাতে ভাবেন, ওই চেয়ারে…, বসার ঘরে দেখেন ঘর সাজাচ্ছে… সবচেয়ে বেশি দেখতে পান টেরেসে। সেটা জেগে নয়, ঘুমিয়ে। স্বপ্নে আজকাল সেই রাস্তা দিয়েই যান সত্যেশ। কিন্তু রাস্তার পাশের বাড়িটা আর ওই পুরোনো, রং জ্বলা দোতলা বাড়িটা নয়। ওটা সত্যেশের বাড়ি। ছাদটা সত্যেশের টেরেস। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হল, টেরেসের শেষে দরজাটার রং লাল।
সাহস করে রাইকে জিজ্ঞেস করতে পারেননি ওর ছোটোবেলার ছাদওয়ালা বাড়িটার কথা। অনেকবার ভেবেছেন, জিজ্ঞেস করবেন, “তোমাদের বাড়িটা দোতলায় ছিল? তার দরজার রং লাল? তার ঠিকানা…”
যদি বলে, “কই, না তো?” ছাদওয়ালা বাড়ি কি একটাই হয়?
সায়ক বেশি ফোন করে না। সন্দীপ জানায়। কথা চলছে। সবই ছোটোখাট কথা। এত সত্যেশের না জানলেও চলে। বললেন, “সাজানো গোছানো এত চলছে, বিয়ে কবে?”
সন্দীপ অপছন্দের সুরে বলল, “জানি না। আজ দাদা, কাল মামা, নানা ইস্যু উঠে আসছে। সায়ক বুঝছে না। আমিও না।”
“আমি কি একবার ওর মা-কে ফোন করে দেখব?”
“না, থাক। ভাই চাইছে না আমরা এর মধ্যে ঢুকি।”
বেশ।
কয়েকদিন পরে, প্রথম দিনের পর কয়েক মাস কেটেছে, আবার সন্দীপের ফোন। “বাবা, বিয়ে হবে না।”
ধক্ করে একটা ধাক্কা লাগল যেন। বললেন, “সে কী রে! কেন?”
“অত জানি না। তবে গত মাস তিন চারেক হল দুজনে ঠিক পরস্পরের সান্নিধ্য পছন্দ করছে না। ঠিক কী হয়েছে সেটা সায়ক আমাকে বলেনি।”
মনে হল, রাইকে ফোন করেন একবার? তারপরে ভাবলেন, থাক। অতিরিক্ত কৌতুহল দেখান ওঁর স্বভাবসিদ্ধ নয়। এটা সায়কের পার্সোনাল ব্যাপার। সায়কই এর সল্যুশন খুঁজবে। সায়কের বাবা নয়।
তবে সত্যেশ না করলেও, রাই করল। রাই যতদূর বুঝেছে, প্রমিতিই সম্পর্কে যতি টেনেছে। কেন, তা রাই জানে না। প্রমিতি নাকি বলেনি।
সত্যেশ কী বলবেন ভেবে পেলেন না। হুঁ, হাঁ করে কাটিয়ে গেলেন। রাই লাইন কেটে দেবার পরে মনে হল, কত আরও কথা ছিল। কোনওটাই বলা হল না।
**
দিন কাটে। সত্যেশের রাতে ঘুমোন দায় হয়ে ওঠে। চোখ বুজলেই আজকাল চমকে জেগে ওঠেন। লাল দরজা আর বারান্দা ছাড়া আর কিছুই দেখেন না। আর সে স্বপ্নে আজকাল রাই সেই বারান্দা থেকে পড়ে যাচ্ছে, সত্যেশ গাড়ি থামাবার চেষ্টা করছেন, কিন্তু ব্রেক লাগছে না। রাই পড়ছে… পড়ছে… পড়ছে…
রোজই ঘেমে নেয়ে ঘুম ভাঙে।
সায়ক এল একদিন। ফোন-টোন না করেই। বেশ ক’দিন দাড়ি কামায়নি। ঘুমও হচ্ছে না ভালো করে। চোখের কোণে কালি। বলল, ছুটি নিয়ে এসেছে। পাঁচ দিন বাড়িতে থাকতে পারে কি? তিন দিনের দিন সায়ক বাবার সঙ্গে জীবনে প্রথম কথা বলল। বলল, প্রমিতির জীবনে অন্য কেউ ছিল আগে। সেই ছেলেটা ফিরে এসেছে বলেই প্রমিতি এক কথায় সায়ককে বিদায় দিয়েছে।
অবাক সত্যেশ জানতে চাইলেন, তার জন্য এই দশা? এর আগে সায়কের জীবনে প্রেম শেষ হয়নি কখনও?
হয়েছে। কিন্তু এবারে সায়ক ভাবেনি প্রমিতি চলে যাবে।
পাঁচ দিন পরে চলে গেল সায়ক। দেড় মাস পরে ফোন করে জানাল, আয়ারল্যান্ড চলে যাচ্ছে। ওখানে ইউনিভার্সিটিতে ফ্যাকালটি হয়ে। সন্দীপ ফোন করল। বলল, এটাই ভালো হল, জানো, ড্যাড?
হল? হবে হয়ত। এমনিতেই সন্দীপ বছরে একবার আসে ক্রিসমাসের ছুটিতে, বউ বাপের বাড়ি গেলে। সায়ক তবু কয়েকবার ঘুরে যেত। রান্নাবান্না করত।
সত্যেশের বাড়িতে আলো জ্বলা কমে গেল আরও। সিনিয়র সিটিজেন ফোরামে সময় কাটে আরও বেশি। বাড়িতে ফিরেও অন্ধকারে টেরেসে বসে থাকেন, আর ভাবেন।
সে দিন রাতে, ব্রেক না লাগা গাড়ির স্বপ্ন থেকে উঠে বুকের ধড়ফরানি থামতে দিলেন। বাঁ দিকে হাত বাড়িয়ে টেনে নিলেন জলের বোতল। মনে হল, গাড়ির ব্রেক নিজের পায়েই থাকে। ব্রেক লাগালেই গাড়ি থামে। এত বছরে ব্রেক লাগিয়েও গাড়ি থামেনি এমন কখনও হয়নি সত্যেশের।
জীবনটা চলে যাবে এইভাবেই? ব্রেক আর লাগাবেনই না?
পরদিন, সকাল দশটায় ফোন করলেন বহুদিন ফোন না-করা নম্বরে।
রাই একটু অবাক হয়ে বলল, “আপনি? কেমন আছেন? সায়কের খবর কী?”
কেমন আছেন বললেন, সায়কের খবর দিলেন। রাই কেমন আছে, প্রমিতির খবরও নিলেন।
তারপরে বললেন, “একটা কথা জানার ছিল। যদি কিছু মনে না করেন?”
একটু চুপ করে থেকে রাই বলল, “বলুন…”
“আপনার ছোটোবেলার যে বাড়িটার কথা বলেছিলেন – যার ছাদ ছিল আমার ঘর-লাগোয়া ছাদের মত – সেটা কোথায় ছিল? মানে রাস্তার নামটা…”
আবার খানিকক্ষণের স্তব্ধতা। রাই বললেন, “কেন বলুন তো?”
এবার প্রায় বাঁধভাঙা তোড়ে সত্যেশ বলে ফেললেন, “হলদে রঙের দেওয়াল, তাতে শ্যাওলা ছিল? ছাদের রেলিং ছিল লোহার গ্রিল, তার ওপর সবুজ কাঠের ব্যানিস্টার? আর… আর ছাদে আসার দরজার রং ছিল লাল…? আর ছাদের কোণায় একটা…”
কথা কেটে রাই বললেন, “বোগানভিলিয়ার গাছ। গোলাপি আর হলুদ দুটো রঙেরই ফুল হত।”
ঠিক। সত্যেশ জানতেন কী শুনবেন, তবু শরীর ছেড়ে দিল চেয়ারে।
রাই বললেন, “আপনি…?”
সত্যেশ বললেন, “আমি আমার ক্লাস এইট থেকে টেনের শেষ অবধি, তিন বছর ওই রাস্তায় যাতায়াত করেছি। সপ্তাহে তিন দিন। বাবার গাড়িতে যেতাম, ফিরতাম। বাবা নিয়ে যেতেন। ও বাড়িতে আপনি ছাড়া আর কোনও কাছাকাছি বয়সের মেয়ে ছিল?”
প্রায় অস্ফূটে রাই বললেন, “না…”
“তাহলে আপনাকে আমি দেখেছি। দু’বার। প্রথম দিন আপনি ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রেলিঙে ভর দিয়ে। আর অন্য এক দিন আপনি হেঁটে চলে যাচ্ছিলেন। পেছন ফিরে। লাল পাড় সাদা শাড়ি।”
“সেই, কত… পঞ্চাশ বছর আগের কথা আপনার মনে আছে এত পরিষ্কার?”
পঞ্চাশ না। ষাট। উনষাট বছর আগে এই যাত্রার শুরু। শেষ ছিল ছাপ্পান্ন বছর আগে। বললেন, “তিন বছর, সপ্তাহে তিন দিন আপনাকে খুঁজতাম ওই রাস্তায় যাবার পথে। এত সহজে ভুলে যাব?”
রাই বললেন, “গাড়িতে করে চলে যেতেন। হুশ করে। তাকে কী খোঁজা বলে?”
বলে না? চোখ দিয়ে খোঁজার সময় কম হলেও, মন দিয়ে কম খুঁজেছেন?
সে কথা বললেন না। বললেন, “পায়ে হেঁটেও গিয়েছি…” কবার গেছেন না বললেও চলবে…
রাই বললেন। “সে মাত্র একদিন। উলটোদিকের পানের দোকান থেকে পান কিনে খেয়েছিলেন, সিগারেট কিনেছিলেন। তারপরে হেঁটে চলে গেছিলেন…”
“না, মাত্র এক দিন না…” বলতে গিয়ে থমকালেন সত্যেশ। বললেন, “আপনি কী করে জানলেন?”
একটু হাসির শব্দ ভেসে এল। তারপর রাই বললেন, “সবুজ অ্যাম্বাসেডর। নম্বর ফোর থ্রি থ্রি ওয়ান।”
সত্যেশ কিছু বললেন? না কি কেবল অব্যক্ত শব্দ বেরিয়ে এল মুখ থেকে?
“আমি রোজ দেখতাম। মানে সোম, বৃহস্পতি, শুক্র। ঠিক তো?”
ঠিক। কিন্তু, দেখতাম মানে? “কোথা থেকে দেখতেন?”
“ছাদের পাশের ঘরটা আমার ছিল। জানলা ছিল মাটি থেকে ছাদ অবধি। ওই জানলায় বসে গল্পের বই পড়তাম। আপনার গাড়ি চলে গেলে পড়তে বসতাম। কেন জানি মনে হত, আপনি খুব পড়ুয়া ছেলে। তাই আপনার সঙ্গে কম্পিটিশন করে পড়তাম।”
সত্যেশ এবারে আর অস্ফূট শব্দও করতে পারলেন না।
“যেদিন আপনি সামনের দোকানে এসেছিলেন, আমি বাড়ির পোশাকে ছিলাম। আমি প্রাণপনে পোশাক বদলে শাড়ি পরে মাকে শর্মিষ্ঠার বাড়ি যাচ্ছি বলে বেরিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে বেরিয়ে দৌড়েছিলাম আপনার পেছনে। অনেকক্ষণ হেঁটেছিলাম। পাইনি।”
পায়নি তো বটেই। হনহনিয়ে হাঁটা সত্যেশের চিরকালের অভ্যেস। এখনও নাকি সমবয়সীরা পাল্লা দিয়ে পারে না।
দুজনেই খানিকটা চুপ করে রইলেন। তারপরে রাই বললেন, “কে জানে, সেদিন আপনাকে পেয়ে গেলে কী হত!”
সে কথা ভেবে আর লাভ নেই। সত্যেশ বললেন, “এতদিন পরে এভাবে দেখা হবে সেটা কখনও ভেবেছিলেন?”
“না। তবে আমি দেখেই আপনাকে চিনতে পেরেছিলাম। বসার ঘরে ম্যানটেলপিসে আপনার ছোটোবেলার ছবি আছে। সেও দেখেছি। কিন্তু আপনি আমাকে কোনওদিন দেখেছিলেন, মনে রেখেছেন, সেটা বুঝিনি।”
আবার খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে সত্যেশ বললেন, “তাহলে আর একটা কথা…”
“বলুন।”
সত্যেশ মাথা নাড়লেন। বললেন, “না। এটা এখানে না। অনুমতি দিন, আমি এবার স্যান ডিয়েগো যাই। একটা প্রপার্টি বিষয়ক কথা আছে। অন্য একটা টেরেসের সহ-মালিকানার কথা। সেখানে একসঙ্গে বসে কফি খাওয়ার কথা। বাকিটা না হয় ফোনে না বলে সামনাসামনিই বলি?”