হীরক রাজার দেশের একমুখ ঝুব্বুস দাড়িগোঁফওয়ালা উদয়ন পন্ডিত, কোনি’র কদমছাঁট গোলমরিচ চুলের খিদ্দা, আতঙ্কের কাঁধ ঝুলে যাওয়া মাস্টার মশাই … বলে শেষ করা যাবে না। ডিগ্ল্যামারাইসড সৌমিত্র। এককালের রূপবান নায়ক বেলাশেষের অভিনেতা যাঁর অভিনয়ের চওড়া কাঁধে ভর রেখে উৎরে গেছে একের পর এক বাংলা ছায়াছবি সেই অভিনেতা সৌমিত্র।
সত্যজিৎ নয়, তপন সিনহা নয়, এক সাক্ষাৎকারে যিনি বলেছিলেন, তাঁর কাছে ঢের বেশি চ্যালেঞ্জিং হ’ল একটা দ্বিতীয় শ্রেণীর ছায়াছবিতে তৃতীয় শ্রেণীর চিত্রনাট্যকারের তৈরি করা চরিত্রকে কেবলমাত্র অভিনয়ের জোরে বড় পর্দায় বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা, সেই সৌমিত্র।
সেই সৌমিত্র যিনি তিন ভুবনের পারে’তে “চ্যাংড়া” চরিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্য টুইস্ট নাচ শেখার জন্য পেশাদার ড্যান্স মাস্টার কাছে দিনের পর দিন যেতে দ্বিধাবোধ করেন না সেই সৌমিত্র, দ্বিধাবোধ করেন না ময়ূরবাহনকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য ফেন্সিং শিখতে, দ্বিধাবোধ করেন না অন্যমনস্কতার জন্য হুইলচেয়ারের শট এনজি হয়ে যাওয়ার দোষ অকপটে স্বীকার করে তপন সিনহার কাছে লিখিত ক্ষমা প্রার্থনা করতে সেই সৌমিত্র।
ক্যামেরা নড়ে না, মফস্বলের ছারপোকা অধ্যুষিত সিনেমা হলের বাংলা “বই” এর দর্শক থেকে অত্যাধুনিক ভিএফএক্স, ডলবী ডিজিটাল মাল্টিপ্লেক্সের “মুভি” গোয়ার দর্শকের কাছ থেকে, তিন প্রজন্মের দর্শকের কাছ থেকে স্রেফ পেশাদারি অভিনয় ক্ষমতার জোরে ভালবাসা, সম্মান হাততালি আদায় করে নেওয়া সৌমিত্র।
টাইগার পতৌদির সাথে রাত তিনটে অবধি হুইস্কি খেয়ে পরের দিন “খিড়কি থেকে সিংহ দুয়ার”এ লিপ দেওয়া সৌমিত্র আবার জুনিয়র আর্টিস্ট টেকনিশিয়ানদের আর্থিক নিরাপত্তার দাবিতে টলিউডের ধর্মঘটকারী সিনে টেকনিশিয়ান ওয়ার্কারস ইউনিয়ন তহবিলে আর্থিক অনুদানের প্রশ্নে অভিনেতৃ সঙ্ঘের সংগঠক বামপন্থী সৌমিত্র।
যে হাতে অনায়াসে হিরোইনকে জড়িয়ে ধরে আদর করছেন সেই হাতে অনায়াসে কমিউনিস্ট পার্টির পোস্টার মেরেছেন, যে হাতে ফিল্ম ফেয়ার লাইফটাইম এওয়ার্ড তুলে নিয়েছেন, সে হাতেই পার্টি পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখেছেন।
নাহ্ তিনি অপরাজিত নন, ওটা পর্দার চরিত্র, পর্দার বাইরে তাঁকেও শ্রেণী বিভক্ত সমাজে পরাজিত হতে হয়েছে, লিটল ম্যাগাজিনের প্রাবন্ধিক ইন্টেলেকচুয়াল সৌমিত্রকে সংসার চালানোর দায়ে রোগজর্জর শরীরে হনুমান চালিসার বিজ্ঞাপন করতে হয়েছে।
কিন্তু তাতে তাঁর এই পরিচয় ক্ষুন্ন হয় নি যে তিনি সবটা মিলিয়ে গ্রেট আর্টিস্ট। যাঁর গ্রেটনেসের পরিচয় হ’ল তাঁর ক্রিয়েটিভ ডিসস্যাটিসফ্যাকশন, অসন্তোষ। তাঁর নিজের ভাষায়, “আমি একটু অসন্ত্তষ্ট লোক৷ সারাক্ষণই খুঁতখুঁত করি৷ ঠিক করে যেন কাজটা করা হল না৷ অথচ কেউ যখন এসে প্রশংসা করেন তখন দারুণ লাগে৷ মনে হয়, আরে! এর জন্যেই তো এত খাটলাম৷ তার পর আবার খোঁজ শুরু৷ মাঝে-মাঝে মনে হয় দ্য সার্চ ইটসেল্ফ সিজেজ টু এক্সিস্ট…।”
এই মহান শিল্পী তাঁর অসন্তোষ ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন দর্শকদের মধ্যেও। এতটাই যে জেনারেশনের পর জেনারেশন ফেলুদা দেখবে আর বলবে, ভালোই তবে ঠিক সৌমিত্র-র মতো ফেলুদা নয়। একটা কাল্পনিক চরিত্রকে পর্দার রক্তমাংসে নড়াচড়া করতে দেখলে এতটা বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা একজন ডেডিকেটেড আর্টিস্টই কেবল পারেন। গ্রেট আর্টিস্ট বলেই পাঙ্গা নিতে ভয় পাননি জীবনে, সে পর্দার কল্পিত ভিলেন মগনলাল মেঘরাজই হোক বা CAA বিল নিয়ে আসা বাস্তব জীবনের মগনলালদের।
নগদ টাকাই হোক বা পুরষ্কার, পর্দার মধ্যের আর পর্দার বাইরের মগনলালরা কোনো দিন তাঁকে কিনতে পারেনি এতটাই সৎ সাহসী ছিলেন। ম্যাটিনি আইডলদের জন্য নিষিদ্ধ কাজ করে গেছেন খ্যাতির মধ্য গগনে। জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়ে নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শ কোনোদিন গোপন করেন নি। সিনেমার মতো কেউ তাঁকে কোনোদিন বলার সাহস পায়নি যে “মাস্টারমশাই আপনি কিছুই দ্যাখেন নি”।
প্রকৃত বামপন্থী ছিলেন বলেই বলেই জানতেন যে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল থেকে কোন্নগরের দর্শক সবার দাবি সমান একজন অভিনেতার কাছে। প্রকৃত সৎ অভিনেতা ছিলেন বলেই “গণদেবতা” থেকে শুরু করে “বাবা কেন চাকর” জাতীয় ছবিগুলিতে, সব সিনেমাতেই একই প্রাণ ঢালা অভিনয় করে গেছেন, মুগ্ধ করে গেছেন ডান-বাম নির্বিশেষে সমস্ত দর্শকদের, কাউকে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেন নি।
ডেডিকেশনের গল্প শেষ, সাহসের গল্প শেষ। যেমন সব গল্পই শেষ হয়।কেবল মুগ্ধতার গল্পের কোনো শেষ হয় না। সেই তিন ঘন্টা কবেই শেষ হয়ে গেছে। হলের আলো নিভে গেছে। সুদূর মফস্বলের সেই সিনেমা ঘরের দর্শকরা হল ছেড়ে বেরিয়ে চলে গেছে। ঘটাং ঘটাং শব্দে কেবল পাখাগুলো ঘুরে যাচ্ছে। আর শেষ শো-এর শেষ দর্শক এক মোহাবিষ্ট কিশোর কেবল বসে রয়েছে ফেলুদাকে আরেকবার দেখা যায় না? আর একটি বার?