দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি বিশেষ ১১
গত চোদ্দ বছর ধরে সাপের কামড় নিয়ে দ্বদ সেটা বলার আগে আমরা শত শত বার যা বলি, একবার বলে নিই।
সাপে কামড়ালে কি করব আর কি করব না, এ নিয়ে বলতে হলে, প্রথমেই বলি যে, যুগ যুগ ধরে প্রচলিত ধারণাগুলি নিয়ে বসে থাকবেন না। যেটা করতে হবে, তার প্রথম পদক্ষেপটিই হল, হাসপাতালের ডাক্তারবাবু যে চিকিৎসাটা করতে চাইছেন, সেটা করতে দিন। আপনার রুগীকে সুস্থ করে তোলাটাই যে কোন চিকিৎসকের প্রথম লক্ষ্য। আপনার রুগীর ক্ষতি করার জন্য কোন ডাক্তারবাবু কোন পুরস্কারও পাবেন না।
এবার এক এক করে বলি কাউকে সাপে কামড়ালে কি করবেন, আর কি করা যাবেনা।
কাউকে, বা আপনাকে নিজেকেই যদি সাপ বা অজানা কিছু কামড়েছে মনে হয়; আশেপাশের কাউকে ডেকে ব্যাপারটা জানান। অন্ধকারে থাকলে, তাড়াতাড়ি একটা টর্চ আনতে বলুন। যাকে কামড়েছে, উনি স্থির হয়ে বসে থাকবেন। অন্যরা এক-দু মিনিট আশেপাশের জায়গায় কোন সাপ আছে কিনা দেখার চেষ্টা করবেন। সাপ খোঁজা বা মেরে ধরে আনার জন্য সময় নষ্ট করবেন না।
এখানে বলে রাখি, এখনকার চিকিৎসা পদ্ধতিতে, সাপের কামড়ের চিকিৎসার জন্য সাপ চেনার কোন দরকার নেই। যে সাপেই কামড়াক, চিকিৎসা হয়, রোগ লক্ষণ দেখে। এজন্য সাপটিকে খোঁজাখুঁজি করে সময় নষ্ট না করাই ভালো। সাপ যদি দেখতে পান, যদি কোন সর্পবিদ উপস্থিত থাকেন, তাঁর কাছে জেনে নিন সাপটির সঠিক পরিচয়। সাপ মেরে বা ধরে, কখনই হাসপাতালে আনবেন না। অনেক সময়ই তাতে হিতে বিপরীত হয়েছে।
যুগ যুগ ধরে চলে আসা, “বাঁধন দেওয়ার” কোন দরকার নেই। বাঁধনে বিষ আটকায় না। এতেও হিতে বিপরীত হয়েছে অনেক সময়।
কামড়ের জায়গায় কোন রকম ধোওয়া বা ওষুধপত্র দিয়ে পরিষ্কার করার দরকার নেই। কুকুরের কামড়ে জায়গাটা ভালো করে সাবান দিয়ে ধুতে বলা হয়। তার থেকেই ভ্রান্ত ধারণা তৈরী হয়েছে যে, সাপ কামড়েও বোধহয় ধুয়ে দিতে হয়; এটা একেবারে ভুল ধারণা। ধোওয়া বা ঘষাঘষি করলে বিষ আরও দ্রুত ছড়িয়ে যায়। হাতে কামড় হলে, তাড়াতাড়ি ঐ হাতের আংটি, চুড়ি, বালা ইত্যাদি খুলে ফেলুন। একটু পরেই হাত বা আঙুল ফুলে উঠলে ঐ সব গয়না কেটে বসতে পারে। যদি সম্ভব হয়; (আমরা স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে উচ্চতর হাসপাতালে পাঠানোর সময় এটা করে ভালো ফল পেয়েছি), হাসপাতালের কাউকে ফোনে জানিয়ে রাখুন যে, একজন সাপ কামড়ের রুগী ওখানে যাচ্ছে।
যদি খুব কাছাকাছি আম্বুলেন্স থাকে, ডেকে নিন। বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকলে আম্বুলেন্সের জন্য দেরী না করে, মোটর বাইকে আহতকে বসিয়ে নিকটবর্তী প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দিকে রওনা দিন।
এই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ব্যাপারটি সম্বন্ধে অধিকাংশ মানুষের ধারণা পরিষ্কার নয়। প্রথম কথা হল, ঐ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চব্বিশ ঘন্টা ডাক্তার থাকতে হবে। ওখানে রুগী ভর্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের যে কোন প্রাথমিক স্তরের স্বাস্থ্যকেন্দ্র, যেখানে ঐ দুটি ব্যাপারে নিশ্চয়তা আছে, সাপের কামড়ের চিকিৎসা সেখানে হবেই। অন্য যে কোন রোগের ক্ষেত্রে, শহরের বড় হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা ভালো থাকতে পারে। কিন্তু এই একটি মাত্র ক্ষেত্রে গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসাই সব সময় ভালো। কারণ, সাপের কামড়ের ক্ষেত্রে প্রতিটা মিনিট গুরুত্বপূর্ণ। শহরের বড় হাসপাতালে যেতে যদি পনের মিনিট বেশী লাগে, সেটাই প্রাণঘাতী হতে পারে। অবশ্য যদি, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া বা বর্ধমানের মত গ্রামীণ মেডিক্যাল কলেজের দু-চার কিমির মধ্যে সাপে কামড়ায়, সেক্ষেত্রে ঐসব হাসপাতালেই তাড়াতাড়ি পৌছন সম্ভব।
মাত্র মাস দুই আগে, গত সাতাশে অক্টোবর ২০২১, উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার ধান্যকুড়িয়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটেছে, তা আমাদের হতাশ করার জন্য যথেষ্ট। ঐ দিন সকালে, একটি বছর পনের বয়সের কিশোরীকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আনা হয় চিকিৎসার জন্য। কি অসুবিধা? মেয়েটি একবার পাতলা পায়খানা করে ঝিমিয়ে পড়েছে। কর্তব্যরত ডাক্তারবাবু রুগীকে দেখেই বুঝেছেন, এটি সাধারণ পেট খারাপের রুগী নয়। রুগীর দুই চোখের পাতা পড়ে গেছে, অর্থাৎ শিবনেত্র দেখা যাচ্ছে। এটি কালাচ সাপ কামড়ের নিশ্চিত রোগ লক্ষণ। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, মেয়েটির বাড়ীর লোক সে কথা মানতে নারাজ। তাদের বক্তব্য হল, ডায়েরিয়ার চিকিৎসাই করতে হবে। ডা বিশ্বাস শত চেষ্টা করেও ওদের বোঝাতে পারলেন না যে, রুগিটি সাপের কামড়ের চিকিৎসা না করলে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যাবে। ঐ যে, যুগ যুগ ধরে চলে আসা ভ্রান্ত ধারণা, বিষধর সাপ কামড়ালে দুটি দাঁতের দাগ থাকবেই! কলাচের কামড়ে যে প্রায়শই কোন দাগ থাকে না, এটা ওনারা মানতে নারাজ।
রুগীর শিবনেত্রের ছবি তুলে, বিশেষজ্ঞ-এর মতামত নেওয়ার জন্য আমাদের কাছে পাঠান, ডা বিশ্বাস। ঐ রকম একগুঁয়ে বাড়ীর লোকদের বোঝানো, স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডাক্তারবাবুর কাজ না; এটা বুঝেই, আমি জেলার এক উচ্চ পদাধিকারী স্বাস্থ্যকর্তাকে বিষয়টি জানাই।
জেলা স্তরের দুইজন ডাক্তারবাবু, ডা বিশ্বাস-এর মোবাইলে ফোন করে, রুগীর বাড়ীর লোকের সাথে কথা বলে, বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। মেয়েটির বাড়ীর লোক এতই অবুঝ ছিলেন যে, সাপের কামড়-এর চিকিৎসা করতে দেবেনা বলে লিখিত ভাবে জানিয়ে দেন। এর পর তারা রুগীকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে ছুটি করে, বসিরহাট জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য রওনা হন। মেয়েটি রাস্তায় মারা যায়।
এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা আমাদের সাপের কামড় নিয়ে গত চোদ্দ বছরের ব্যাপক প্রচারকে ব্যর্থ বলে প্রমাণ করল। শুধু আমাদের এই একটি কাজেই ব্যর্থতা নয়, এই মেয়েটির দুর্ভাগ্যজনক মৃত্য আরও মারাত্মক কিছু সামাজিক অবক্ষয়-এর দিক উন্মুক্ত করে দিল। এক শ্রেণীর প্রচার মাধ্যম-এর নিরলস অপপ্রচার, সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর থেকে মানুষের সামান্য বিশ্বাসকেও সমুলে উৎখাত করে দিচ্ছে, এই ঘটনা আর একবার তা প্রমাণ করল।