দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি বিশেষ ১২
আমি নিউরোসাইকিয়াট্রি বি ৭৫৩ নম্বর কেবিনের রোগী। আমার কাছে আজ ভিজিটার আসবে। বাড়ির লোকেরা আসবেন। আর আসবে দামিনী। ডাক্তারের নির্দেশ প্রতিবারেই যেন দামিনীকে আনা হয়। এই রকমেরই চলছে বহু বছর ধরে। বাড়ির লোকেদের সাথে কথা সেরে আমি দামিনীর সাথে কথা বলি।
কী কথা? সব রকম কথা। আসলে না বলে দিলে আমি যে অসুস্থ চট করে কেউ ধরতেই পারবে না। শুধু মাঝে মাঝে আমি কে, কোথায় যাবার… কী করার কথা আমার… মনে করতে পারি না। শুধু মনে থাকে… সব সময় মনে থাকে, দামিনী আমাকে কিছু একটা বলবে বলেছিল। বেশ কয়েকবারই বলতে চেয়েছিল আগে। প্রত্যেকবার বাধা পড়েছে কিছু না কিছু।
প্রথম যে’দিন বলবে বলেছিল আমরা দু’জন তখন পার্কে। এ’কথা সে’কথার মাঝে হঠাৎ করে দেখা হয়ে গেল বিদেশ থেকে ফেরা দোলন আর বিকাশের সাথে। হইহই করে কেটে গেল বটে সময়টা। কিন্তু সেই কথাটা বলা হল না।
এ’রকমই বারবার। শেষ যে’দিন সে’বারও।
দামিনীর সঙ্গে দূরে কোথাও যাব। আমাকে আজ কিছু বলবেই সে। রওনা হলাম ভাড়া করা গাড়িতে। হাইওয়েতে পৌঁছতেই শুরু হল ঝড়। সেই তাণ্ডবের মধ্যে আমাদের গাড়ি প্রচণ্ড বেগে আছড়ে পড়ল একটা দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেলারের পেছনে। যমে মানুষে টানাটানি। সারজিক্যাল সমস্যা কাটিয়ে ওঠার পর থেকে আমি এ’খানে। ডাক্তারেরা সারাতে পারেননি। দামিনী না এলে আমি পাগলের মত হয়ে যাই। বেঁধে রাখতে হয়।
দামিনীকে আমি বলি এ’খানে দিন কাটানোর সব মজাগুলো। ও চোখ বড় বড় করে শোনে। দামিনীও আমাকে বাইরের পৃথিবীর গল্প বলে।
আমি ওকে যতবারই বলি,- দামিনী আমাকে সেই কথাটা আজ যাবার আগে বোলো কিন্তু,
সে বলে, – বলব সবটুকু বলব বলেই তো আমি এলাম অনিমেষ।
কিন্তু অবাক কাণ্ড কোনওবারই তার বলা হয়ে ওঠে না। হয় সিকিউরিটি তাড়া দেয় ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে গেছে বলে। নয় বাড়ির লোকেরা। হয়তো দামিনীই আগ্রহ করে মস্ত একটা গল্প ফেঁদে বসেছে। সেই আগ্রহে বাধা দিতে পারি না বলে আমার আর সেই কথাটা শোনা হয় না।
গত পাঁচশ’ বছর ধরে এই চলছে। বাড়ির লোকেরা ভাবে দামিনী যে একটা চতুর্থ শ্রেণীর রোবট আমি বুঝি সে’টা জানি না।
আমি এ’ও জানি সেই অ্যাকসিডেন্টে দামিনী বাঁচেনি। মারা যাবার ঠিক পরে তার সমস্ত স্মৃতি ডাউনলোড করে ভরা আছে এই নকল দামিনীর মাথায়। সব জানি।
তবু আশায় থাকি যদি স্মৃতির কোনও খাঁজ থেকে বেরিয়ে আসে সেই কথাটুকু, আমার দামিনী যা বলতে চেয়েছিল।