(আমার এই কলমে আমি দীর্ঘদিন ধরে লিখছি। আমি আমার ডাক্তারি জীবনের নানান অভিজ্ঞতা কখনও ব্যঙ্গের মোড়কে, কখনও নিছকই ঠাট্টার ছলে, কখনও বা সিরিয়াস কিছু লিখে থাকি। ডাক্তারবাবুদের জন্য আমি লিখি না। আমি সাধারণ ফিজিশিয়ান। তাদের জন্য লেখার যোগ্যতা আমার নেই। তবু বিগত বেশ কিছুদিন ধরে আমার লেখাগুলো আমাদের ‘ডক্টরস ডায়ালগ’ নামে এক ফোরামে প্রকাশিত হচ্ছে সেটা ডক্টর ঐন্দ্রিল ভৌমিক-এর সৌজন্যে। সে আমার চেয়ে বয়সে ছোট। কিন্তু ডাক্তার ও লেখক দুই বিভাগেই তার জনপ্রিয়তা সীমাহীন।
আজকের পোস্টটিও ডাক্তারবাবুদের উদ্দেশ্য করে লেখা নয়। কারণ শিশুদের যে বিষয় নিয়ে আমি আপনাদের জানাচ্ছি তা জানাতে হলে নিদেনপক্ষে একজন শিশু বিশেষজ্ঞ হওয়া দরকার। আমি তা নই। তবু এই বিষয়ে আমি লিখছি কারণ বিগত কয়েকদিন ধরে আমার পরিবার এই অসুখ নিয়ে যুঝে চলেছে। আমি আমার পাঠক ও আমার রুগিদের সচেতন করার জন্যই লিখছি। আমি ডাক্তারি পরিভাষা যতটা কম পারি ব্যবহার করব। আপনারা আমার মূল বক্তব্য বোঝার চেষ্টা করবেন।
অনেকেকেই হয়ত ট্যাগ করলাম। যা আমি সচরাচর করি না। এটা পোস্টটা ছড়িয়ে দেবার জন্য। ডাক্তার হিসেবে এটা কিছুটা হলেও আমার সামাজিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।)
আমার পরিবারে একটি পাঁচ বছরের মেয়ের হঠাৎ জ্বর ও পেটেব্যথা শুরু হয়। ওরা দুই বোন। যমজ। ও ছোট। ওর বাবা মাস দুই আগে ইংল্যান্ড থেকে ফিরেছেন। কর্মসূত্রে একবছরেরও বেশি কিছু সময় ওখানে ছিলেন। আমাদের পারিবারিক ডাক্তার মূলত আমি। তা সে বাচ্চা হোক বা বয়স্ক। বাড়িতে ডাক্তার থাকলে যা হয়। আমি সেদিন মালদায় যাচ্ছি। ট্রেনে। অনেক রাতে ওর বাবা আমাকে ফোন করলে আমি ফোনেই ওষুধ বলে দিই। পেটে ব্যথার সাথে বাচ্চাটির খুব বমি শুরু হয় ও পেট ফুলে যেতে থাকে। পেট ব্যথা ও বমি না কমায় আমার পরামর্শে ওরা সোদপুরে ওদের বাড়ির কাছে এক ডাক্তারবাবুকে দেখান।
ডাক্তারবাবু বাচ্চাটিকে ভর্তি হতে বলেন কাছের নার্সিং হোমে। কিন্তু কোভিডের ভয়ে ও অন্য পিঠোপিঠি এক বোন থাকায় তারা ডাক্তারবাবুকে ওষুধ দিয়ে একদিন দেখতে বলেন। কিন্তু পরবর্তী দুদিন বাচ্চাটির কোনো উন্নতি না হওয়ায় তারা আবার ডাক্তারবাবুর কাছে গেলে উনি কাছাকাছি এক নামী নার্সিং হোমে বাচ্চাটিকে ভর্তি করেন।
তিনদিন পার হয়ে গেলেও বাচ্চাটির কোনো উন্নতি দেখা যায় নি। উলটে জ্বর যেখানে আগে দিনে দুবার করে আসছিল তা সারাদিন ধরে থাকতে শুরু করে। আমি দ্বিতীয় দিনে ওকে নার্সিং হোমে দেখতে যাই। গিয়ে দেখি ওর মুখে ঘা হচ্ছে, পেটটা যথেষ্ট ফোলা এবং শ্বাস নেবার গতিটা অনেক বেশি। সবকিছুই জ্বরের জন্য হতে পারে। আমি বাচ্চাটির মাকে বললাম মুখে ঘায়ের ব্যাপারটা ডাক্তারবাবুকে জানাতে। দ্বিতীয় দিন থেকে আমি ডাক্তারবাবুর সাথে ফোনে যোগাযোগ করতে শুরু করি। উনি আমাকে বলেন রিপোর্ট সাঙ্ঘাতিক খারাপ কিছু নয়। কিন্তু জ্বরটা কেন কমছে না উনি ঠিক বুঝতে পারছেন না।
তার ইউরিন ও ব্লাডে বেশ খানিকটা ইনফেকশন ধরা পড়েছিল। সেটা অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করার পর নর্মাল হয়ে গেছিল। ওর বুকের এক্স-রে, ইকোকার্ডিওগ্রাফি, আল্ট্রাসোনোগ্রাফি কোথাও কোনো অসুবিধে ছিল না। চতুর্থ দিন সকালে যখন বাচ্চাটির পা ফুলতে শুরু করল, পেচ্ছাপ কমে গেল এবং পেট আরও ফুলতে শুরু করল (যদিও এর মধ্যে ওর বমি আর পায়খানা স্বাভাবিক হয়ে গেছিল) আমি আর ঝুঁকি নিতে পারলাম না। এর মধ্যে ডাক্তারবাবুও আর ওকে হাতে রাখতে চাইলেন না।
কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কোথায় নিয়ে যাব? টাকা পয়সার সমস্যা নেই। কিন্তু কোথায় গেলে ঠিক চিকিৎসা পাব? আমি এর মধ্যে আমার দুই শিশু চিকিৎসক বন্ধুর সাথে কথা বললাম। একজন আমার ব্যাচমেট, আরেকজন আমার প্রাক্তন সহকর্মী। দুজনেই বলল এক্ষুণি কোথাও একটা নিয়ে যেতে। আমার বন্ধুর থেকে আমার এক বছরের জুনিয়র আরেক শিশু চিকিৎসকের নাম্বার নিলাম। ও এখন ইন্সটিটিউট অফ চাইল্ড হেলথ (আই.সি.এইচ), পার্ক সার্কাসে আছে। আমিও আমার শুরুর দিকে ওখানকার ডিরেক্টর ডক্টর অপূর্ব ঘোষের সাথে বেশ কিছুদিন কাজ করেছিলাম। স্যার শুনলাম এখন ডায়াবিটিসের জন্য অসুস্থ। তাই আমার সেই জুনিয়র ভাইকে ফোন করায় ও আমাকে ভর্তির ব্যাপারে খুব সাহায্য করল।
নার্সিং হোমের ফর্মালিটি মিটিয়ে বাচ্চাটিকে নিয়ে আসতে অনেক দেরি হয়ে গেছিল। সন্ধ্যে সাতটার সময় ওকে এমারজেন্সিতে নিয়ে এলাম। দেখি এর মধ্যেই ওর পেটে জল আসতে শুরু করেছে। চোখদুটো ফোলা, চোখ লাল। হাত পা দুটোই ফুলতে শুরু করেছে। তিনজন ডাক্তারবাবু ওকে দেখলেন। ওর ব্লাড প্রেসার কমতে শুরু করেছিল। ওরা সিদ্ধান্ত নিলেন ওকে পি.আই.সি.ইউ. বা পিডিয়াট্রিক ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ভর্তি করতে হবে। ওখানে এগারোটা বেড। একটাই ফাঁকা ছিল। কিছুটা আমার জুনিয়র ভাইয়ের রেফারেন্স ছিল বলে আর কিছুটা আমি ডাক্তার বলে পরিচয় দেওয়াতে ওনারা ওকে পিকুতে ভর্তি করলেন।
যে লেডি ডাক্তার ছিলেন তার সাথে কথা বলে বুঝলাম ওনারা পোস্ট কোভিড পি.এম.আই.এস. বা পিডিয়াট্রিক মাল্টিসিস্টেম ইনফ্ল্যাম্যাটরি সিন্ড্রোম ও স্ক্রাব টাইফাস এই দুটোর কোনো একটা বলে সন্দেহ করছেন। লেডি ডাক্তার বললেন তাদের কাছে গত চার-পাঁচ মাস ধরেই এই অসুখে আক্রান্ত বাচ্চারা আসছে। একজন ছাড়া বাকিরা ভেন্টিলেটর ছাড়াই সুস্থ হয়ে গেছে। আমার দুই শিশু চিকিৎসক বন্ধুরাও বললেন ওখানে ডক্টর গিরির তত্ত্বাবধানে ওরা যে প্রোটোকলে ইন্ট্রাভেনাস ইমিউনোগ্লোবিউলিন ও স্টেরয়েড দিচ্ছেন তাতে ওদের সাফল্যের হার কলকাতায় সবচেয়ে বেশি।
আমি সেদিন সারারাত ও পরেরদিন বিকেলবেলা অবধি ওখানে ছিলাম। ডক্টর গিরির সাথে আমার কথা হয়। ওনারা খুব আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে বাচ্চাটি সুস্থ হয়েই বাড়ি যাবে।
আজ থেকে আর ওর জ্বর আসছে না। পিডিয়াট্রিক ইকো করে দেখা গেছে হার্ট ভালো আছে। হয়ত আর আই.ভি.আই.জি. দিতে নাও হতে পারে। সবই ভগবানের ইচ্ছে ও ডাক্তার হিসেবে আমার সহকর্মী ও অন্যান্য পরিচিত বা অপরিচিত ডাক্তারবাবুদের সাহায্য যে কারণে বাচ্চাটার ঠিকঠাক চিকিৎসা ঠিক সময়ে শুরু হতে পেরেছে। একটু দেরি হলেই অনেক সমস্যা হতে পারত। এর মধ্যেই ওর হার্ট, কিডনি, লিভার গন্ডগোল হতে শুরু হয়েছিল। যেহেতু এটা মাল্টিসিস্টেম মানে শরীরের বিভিন্ন সিস্টেমকে ক্ষতি করতে শুরু করে তাই ক্ষতি একবার শুরু হলে তা খুব দ্রুত হারে শুরু হয়ে যায়। তাই যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু হবে সাফল্যের হার তত বেশি।
তাই আমার যারা এই কলম পড়ছেন সেইসব সাধারণ মানুষের জন্য বলছি এই পি.এম.আই.এস. কিন্তু নতুন অসুখ। কোভিডের পরপর জুন-জুলাই মাসে বিদেশে এই অসুখের কথা ডাক্তারবাবুরা জার্নালে লিখতে শুরু করেন। প্রায় সেই সময় থেকেই আমাদের দেশেও বাচ্চাদের মধ্যে এই অসুখের কথা শোনা যায়। এই অসুখে আক্রান্ত বাচ্চাদের অনেকেরই কোভিড ধরা পরে। কিন্তু চার ভাগের এক ভাগের মধ্যে কোভিড ধরা পড়েও না। আমার আত্মীয়া এই শিশুটির কিন্তু সার্স আর.টি.পি.সি.আর. নেগেটিভ। এখানে ওর কালকে অ্যান্টিবডি টেস্ট হয়। তাও নেগেটিভ। অর্থাৎ কোভিড হয়েছিল বলা যাচ্ছে না। কিন্তু বাচ্চাদের ক্ষেত্রে কোভিড এত কম লক্ষণ নিয়ে আসছে যে তার অ্যান্টিবডি টাইটার পরিমাপযোগ্য নাও হতে পারে।
তবে তার ইনফেকশনের কারণ কি? কেনই বা তার সব সিস্টেম এত তাড়াতাড়ি গন্ডগোল হতে শুরু করল এটা ধোঁয়াশা। কোভিড যেহেতু নতুন অসুখ। তার লক্ষণ ও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও খুব গোলমেলে। আর বাচ্চাদের যেহেতু কোভিড খুব কম হচ্ছে, তাদের ক্ষেত্রে তা আরও সমস্যার। তবে এই অসুখ কার হবে, কখন হবে এটা অনুমান করা খুব কঠিন। তবে কোনো অবস্থাতেই ধরা পড়লে তাকে ভালো কোনো হাসপাতালে যত তাড়াতাড়ি হয় স্থানান্তরিত করুন।
বাচ্চাদের জ্বরের সাথে নিচের বিষয়গুলোর দিকে নজর দিন-
১. বাচ্চার বয়স ছয় মাস থেকে চোদ্দ বছর অবধি হতে পারে। তবে সাধারণত পাঁচের বেশি।
২. জ্বর কিছুতেই না কমা। তার সাথে শরীরে কোথাও কোনো ইনফেকশন ধরা পড়া। আমার আত্মীয়ার শিশুটির যেমন ইউরিনে একটু ইনফেকশন ধরা পড়ে।
৩. পেটের সমস্যা, বমি, পায়খানা, পেট ব্যথা, পেট অতিরিক্ত ফুলে যাওয়া। বাচ্চা যদি একেবারেই মুখে খাওয়া বন্ধ করে দেয়।
৪. মুখে ঘা, ঠোঁট ফুলে যাওয়া, জিভে টকটকে লাল ভাব, মুখে খাবার দিলেই মুখে গলায় অতিরিক্ত জ্বালা।
৫. বাচ্চা খুব যদি ঝিমিয়ে পড়ে, বিশেষ করে হাত-পা-মুখ-পেট ফুলতে শুরু করে সতর্ক হন।
ওপরের সব লক্ষণগুলোই অনেক বাচ্চাদের অসুখেই হতে পারে। টাইফয়েড বা ইউরিনে ইনফেকশন এসব ক্ষেত্রেও হতে পারে। অনেক সময় ডাক্তারবাবুরা বুঝতেও পারেন না সব রিপোর্ট ঠিক থাকলেও কেন বাচ্চা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমার শিশুটির ক্ষেত্রে যেমন হয়েছিল। এই পি.এম.আই.এস.-এর ক্ষেত্রে তাই কারণ জানাটা আগে দরকার নয়, যেহেতু অসুখটির বয়স বেশিদিন নয়, তাই অনুমান নির্ভর চিকিৎসা শুরু করাটা খুব জরুরি। এক্ষেত্রে আমাদের শিশুটিকে আই.সি.এইচ.-এর ডাক্তারবাবুরা অত্যন্ত তৎপর হয়ে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করেছিলেন বলেই আজ দেড় দিন পরেই বাচ্চাটির জ্বর কমে গেছে। তার খিদে কাল থেকেই ফিরে এসেছে। আজ সকালে বেডে উঠে বসতে চাইছে।
এর সাথে কোভিডের যোগ কতটা? আমার এক ডাক্তার বন্ধুর শিশু চিকিৎসক স্ত্রীর মতে ৪৫% বাচ্চার সার্স কোভিড আর.টি.পি.সি.আর. পজিটিভ, ৭৫% বাচ্চার সার্স কোভিড অ্যান্টিবডি পজিটিভ। আমাদের শিশুটির দুটোই নেগেটিভ। তাই তার যে কোভিড হয়েছিল তা বলা যাচ্ছে না, বা যে হয় নি তাও হয়ত বলা যাচ্ছে না। ‘হয়ত’ বললাম কারণ এই ব্যাপারটায় আমি নিশ্চিত নই। আমার বন্ধুরা হয়ত আমাকে নিশ্চিত করবেন।
যা হোক আমার এই লেখার উদ্দেশ্য আপনাদের বাচ্চার এরকম কোনো লক্ষণ দেখলে আপনারা সতর্ক হোন। অসুখটি যেহেতু নতুন এবং এতে আক্রান্ত রুগিদের সংখ্যা অনেক কম। তাই হতেই পারে আপনার শিশু চিকিৎসক হয়ত এখনও পর্যন্ত এমন রুগি দেখেন নি। তাই তার পক্ষে তৎপর হওয়া কঠিন। ডাক্তারবাবুরাও প্রতিনিয়ত পরিস্থিতির সাথে, নতুন জ্ঞানের সাথে নিজেদের পরিচিত করেন। তাই তাদের সাময়িক অজ্ঞানতা অপরাধ নয়। তেমন হলে ডাক্তারবাবুকে পি.এম.আই.এস.-এর কথা জিজ্ঞাসা করুন। আমি আমার রুগিদের থেকেও জীবনে অনেক কিছু শুনেছি ও শিখেছি। উনি নিশ্চিত আপনাকে হতাশ করবেন না।
সবশেষে আমাদের পরিবারের সবচেয়ে ছোট কন্যারত্নটির জন্য আপনারা প্রার্থনা করুন। ওর বাবা মা অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে ওদের দুই বোনকে পৃথিবীতে নিয়ে এসেছেন। ও যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ফিরে আসে। ও ফিরে এলে ওকে হয়ত কিছুদিন হার্টের নিয়মিত ইকো করিয়ে যেতে হবে। সেটা ডাক্তারবাবুর ওপর নির্ভর করছে। উনি মনে করলে তাই করা হবে।
এখনও আমরা ও ডাক্তারবাবুরা আশাবাদী। ও হয়ত কদিনের মধ্যেই বাড়িতে ফিরে আসবে। আপনারা সকলে আপনাদের বাচ্চাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। কারণ ট্রেনে-বাসে- বি.এস.এন.এল. মোবাইলের কলার টিউনে অমিতাভ সবসময় বলছেনঃ কোভিড নাইন্টিন আভি খতম নেহি হুঁইয়ে হ্যাঁয়। তাই যবতক দাওয়াই নেহি তবতক কোনো অবহেলা নয়। সাবধানে থাকুন। নিজেদের চোখ কান খোলা রাখুন।
আপনার এই পোস্ট মাঝে মাঝে পড়ি… সাবধানে থাকার জন্য… অসাধারণ