ডাক্তারদের নিয়ে সারাক্ষণই সমালোচনা চলে- চায়ের দোকানে, ট্রেনে-বাসে, শ্মশানে- কবরখানায়। রোগীদের নিয়ে সমালোচনা তেমন শোনা যায় না। আমার সম্বল ফেসবুক। রোগীদের নিয়েও একটু সমালোচনা করি।
রোগীদের কল্যাণে আমাদের মতো খুপরির ডাক্তারদের ডাক্তারি করাটা দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে। কিছু কিছু রোগী আছেন, গুগুল থেকে জ্ঞান আহরণ করে আসেন এবং সেই আজগুবি জ্ঞান দিয়েই চিকিৎসকের পরীক্ষা নিতে চান। চিকিৎসককে অদ্ভুত প্রশ্ন করেন। সেইসব প্রশ্নের উত্তর মনঃপুত না হলে অন্য চিকিৎসকের কাছে যান।
আরেক দল রোগী বাড়ি গিয়ে গুগুল করেন, তারপর ফোন করেন। এনারা আরও বেশি বিরক্তিকর। ফোনে সরাসরি চিকিৎসককে অভিযুক্ত করতেও এনাদের বাধে না। ‘আপনি যে প্রেশারের ওষুধ দিয়েছেন, নেটে দেখছি, এটাতে শুকনো কাশি হতে পারে। আপনি এমন ওষুধ দিলেন কেন?’ মাঝে মাঝে প্রশ্ন এর থেকেও বেশি আক্রমণাত্মক হয়, ‘আপনি যে ব্যথার ওষুধ দিয়েছেন, গুগুল বলছে সেটায় কিডনি খারাপ হয়ে যেতে পারে। আপনি জেনে বুঝে আমার এমন সর্বনাশ করতে চাইছিলেন কেন?’
আগে এই সকল প্রশ্নকর্তাদের বোঝানোর চেষ্টা করতাম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সব ওষুধেরই থাকে। তবে সেসব নগণ্য সংখ্যক মানুষের হয়। কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে ওষুধ বন্ধ করলেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঠিক হয়ে যায়। সে তো কত খাবার দাবারেরও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। এইতো বিহারের মজফরপুরে এতগুলো বাচ্চা লিচু খেয়ে মরে গেল। তা বলে কি আমরা বাচ্চাদের লিচু খাওয়াবো না? নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সাথে কত রকম জীবাণু দেহে প্রবেশ করে। তাহলে কি নিঃশ্বাস নেওয়াও বন্ধ করে দেব?
তবে আজকাল আর কথা বাড়াই না। কারণ অভিজ্ঞতায় দেখেছি এনারা কিছুতেই বুঝতে চান না। সব শুনেও বারবার ঘ্যান ঘ্যান করেন, ‘আপনি অন্য ওষুধ দিতে পারতেন। কিডনি খারাপ হতে পারে এমন ওষুধ দিলেন কেন?’ শেষ পর্যন্ত আমার মাথাও গরম হয়ে যায় এবং ফোনেই কথা কাটাকাটি হয়। সারাদিন রোগী দেখার পর রাত দশটায় আর ঝগড়া করতে ইচ্ছে করে না।
আরেক ধরণের রোগী আছেন, যাঁরা ভেবেই নেন, ডাক্তারবাবু যা করছেন সবই কমিশন পাওয়ার জন্য করছেন। এনারা চারটে ওষুধ লিখলে ওষুধের দোকানের কর্মচারীর সাথে আলোচনা করে দুটো ওষুধ খান। কোনো পরীক্ষা নিরীক্ষা লিখলে করেন না। বরঞ্চ সে সব পরীক্ষার বদলে নিজের মনের মতো পরীক্ষা যেমন ইউরিক এসিড, এল এফ টি ইত্যাদি বন্ধুর ল্যাবরেটরি থেকে করে আসেন।
এভাবে লিখে চললে রোগীদের নিয়ে মহাভারত লেখা যায়। আজ আর সময় নেই। তাছাড়া আপনারাও অধৈর্য হয়ে যাবেন। তাই দুটো ঘটনা লিখে আজকের মতো শেষ করি।
কিছু কিছু রোগী এতো বিচিত্র কথাবার্তা বলেন, মাঝে মাঝে তাক লেগে যায়। বাড়ির খুপরিতে এক বৃদ্ধ রোগীকে জিজ্ঞাস করেছি, ‘বলুন, সমস্যা কী?’
‘ডাক্তারবাবু, আপনের বগলে একটা টসটসে ঘা হয়েছে।‘
শুনে হতবাক হয়ে গেলাম। বললাম, ‘কী যা তা বলছেন?’
বুড়ো ভদ্রলোক বললেন, ‘সত্যি বলছি ডাক্তারবাবু, ব্যথায় আপনের দু-রাত্তির ঘুম হয়নি।‘
ঘুম আমার সত্যিই হয়নি তবে সেটা ফোড়ার অত্যাচারে নয়, রোগীদের অত্যাচারে। এই হতভাগা রোগী নিশ্চয়ই ঘন ঘন হাই তোলা দেখে সেটা বুঝে গেছেন। বললাম , ‘আমাকে নিয়ে চিন্তিত না হয়ে আপনি নিজের সমস্যা বলুন।‘
ভদ্রলোক ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘তবে আজ সকালে উঠে দেখলাম শুধু বগলে নয় আপনের ইয়েতে… মানে পাছাতেও একখানা ফোঁড়া বেড়িয়েছে।‘
আর সহ্য করা মুশকিল। পার্থকে ডেকে বললাম, ‘ভদ্রলোকের কাছ থেকে তুমি ভালো করে সব শুনে আমাকে বলো। ইনি সর্বত ভাবে সর্বনাম পদের সর্বনাশ করছেন। ভাগ্যিস সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় কখনো এনার সামনা সামনি হননি।’
পরের রোগীকে দেখে আরও মুষড়ে পড়লাম। ব্যায়াম করা গাঁট্টাগোট্টা চেহারা। একটা টাইট গেঞ্জি পরে এসেছেন। বাইসেপস, ট্রাইসেপস, পেক্টোরালিস মেজর সব গেঞ্জি ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
চিকিৎসকদের জন্য পরিস্থিতি অত্যন্ত অশান্ত। রোজই দু চারজন চিকিৎসক শারীরিক নিগৃহীত হচ্ছেন। এমনকি ঘরে ঢুকেও জনগণ চিকিৎসক ও তাঁর পরিবারকে মেরে হাতের সুখ করছেন। সেসময় এরকম ব্যায়ামবীরের চিকিৎসা করার চাইতে চিররুগ্ন অ্যানিমিক রোগীর চিকিৎসা করা সন্তোষজনক।
ভদ্রলোক আমার সামনের চেয়ারে বসলেন। চেয়ারটা ক্যাঁচ করে আর্তনাদ করে উঠল। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। চেয়ারের যা হয় হোক, এই ব্যায়ামবীরকে ভালো ভাবে বুঝিয়ে শুনিয়ে বিদায় করতে পারলে বাঁচি।
তবে সমস্যা হচ্ছে দীর্ঘদিন ব্যায়াম টেয়াম করে এনাদের মস্তিষ্কও বাইসেপের মতোই শক্তপোক্ত হয়ে ওঠে। সেখানে সহজে কিছু সেঁধানো মুশকিল। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনার কী হয়েছে?’
সাথে সাথে ব্যায়ামবীর তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর আমার দিকে একটু ঝুঁকলেন। ডান হাতের তর্জনী আর অনামিকা দিয়ে আমার বুকের ঠিক মাঝখানে চাপ দিয়ে বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, এইখানটায় খুব ব্যথা।‘
আমার বুকের মধ্যে একটা মট করে আওয়াজ হলো। স্টার্নাম হাড়খানা নিজের জায়গা থেকে সরে গেলো কিনা কে জানে। ব্যথায় ককিয়ে উঠে বললাম, ‘এটা কী হল?’
‘কোথায় ব্যথা হচ্ছে, সেটা দেখালাম। না হলে আপনি বুঝবেন কী করে?’
রীতিমত কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম, ‘কোথায় ব্যথা হচ্ছে সেটা বললেই চলতো। কতটা ব্যথা হচ্ছে দেখানোর কী খুব প্রয়োজন ছিল? এই ভাবে সবাই যদি নিজের নিজের ব্যথা দেখাতে আরম্ভ করে তাহলে ডাক্তারি করাই বন্ধ করে দিতে হবে।‘
ব্যায়ামবীর বললেন, ‘সরি ডাক্তারবাবু, আপনার যে ওই সামান্য চাপেই এত লেগে যাবে বুঝতে পারিনি।‘
‘এটা সামান্য চাপ! আমি চিকিৎসক, সোয়ারজেনেগার নই। আপনার আর কী সমস্যা? না না… আর উঠে দাঁড়াবেন না। বসে বসেই বলুন।‘ আমি নিজের চেয়ারটা নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিই।
ব্যায়ামবীর বলেন, ‘বুকে ব্যথা তো আছেই। রাতেও ঘুম হয়না সার। সারা রাত মাথায় হাজার গণ্ডা দুশ্চিন্তা ঘোরে।‘
বললাম, ‘আপনার গায়ে এত জোড়। আপনার আবার দুশ্চিন্তা কিসের। দুশ্চিন্তা তো আমাদের মতো দুর্বল খুপরিজীবি ডাক্তারদের।‘
ব্যায়ামবীর মুখ নিচু করে বললেন, ‘দুশ্চিন্তা কী সাধে আসে সার। আমার স্ত্রী, চার বছর সংসার করার পর আমারই জিমনেশিয়ামের এক ছাত্রের সাথে পালিয়েছে।‘
আমি মনে মনে ভাবলাম, বুদ্ধিমতী মহিলা, পালিয়ে বেঁচেছেন। নাহলে ব্যায়ামবীর নিজের বউকে বেখেয়ালে চেপে ধরলে বেচারার হাড়গোড় আস্ত থাকত না।
ব্যায়ামবীর আরও অনেক কিছু বললেন। বুঝতে পারলাম বাইরে তাঁকে যতই গাঁট্টাগোট্টা দেখাক, মানসিক ভাবে তিনি একেবারেই ভেঙে পড়েছেন। তাঁর স্ত্রী পালিয়ে গেছেন, কিন্তু দেড় বছরের মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যাননি। আপাতত একরত্তি মেয়েটাকে নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছেন। দূর সম্পর্কের এক বিধবা পিসি আপাতত তাঁর মেয়েকে সামলাচ্ছেন। তিনি বললেন, ‘দেখবেন আমার মেয়েকে? বাইরেই আছে, পিসি নিয়ে এসেছে।‘
ব্যায়ামবীর বাইরে উঁকিঝুঁকি মেরে পিসিকে ডাকলেন। রুগ্ন পিসি খুপরিতে ঢুকেই অভিযোগ করলেন, ‘তোর মেয়ে তো কেঁদে ভাসিয়ে দিলে। থামানোই যাচ্ছে না।‘
‘দাও, আমার কোলে দাও।‘
প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে দেখলাম, একটা ফুটফুটে পরীর মতো মেয়ে হাত বাড়িয়ে ব্যায়ামবীরের কোলে চলে গেল। ব্যায়ামবীরের বুকে মুখ গুঁজে শান্ত হয়ে আমার দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে থাকল আর ফ্যাকফ্যাক করে হাসতে লাগল।
বুকে ব্যথা এখনও হচ্ছে। ওই ব্যায়ামবীরের উপর রাগ করাই উচিত। কিন্তু কিছুতেই রাগ করতে পারছি না। একটু নড়লেই বুকে ব্যথা হচ্ছে। আর তখনই পুঁচকি মেয়েটার ফ্যাকফেকে হাসি মুখ মনে পড়ছে।
মিষ্টি ছবিটা নেট থেকে সংগৃহীত