কোন প্ল্যান না করেই এবার আসা হয়েছে দার্জিলিঙয়ে। কেজো জীবনের ব্যস্ততার মাঝে আচমকাই পেয়ে যাওয়া দিন কয়েকের ছুটিতে,কাছাকাছি কোথায় যাওয়া যেতে পারে ভেবেই কেটে নেওয়া হয়েছিল ফ্লাইটের টিকিট। বাগডোগরা তো পৌঁছাই, তারপর চিন্তা করবো কোথায় যাওয়া যায়, এটাই ছিল আইডিয়া। আর ঠিক সেভাবেই দার্জিলিঙয়ে এসে পড়েছি আমরা তিন জন।
কাল কার্শিয়াং হয়ে বিকেলে এসে পৌঁছেছি শৈলশহরে। কলকাতার ডিসেম্বরের শীতের মতো ঠাণ্ডা এখানে। তবে মাঝে মাঝে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে বলে, উত্তুরে হিমেল হাওয়া হঠাৎই কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে সারা শরীরটাকে।
ভিড় এড়াতে হোটেল বেছেছি দার্জিলিং মল থেকে একটু দূরে,হিলকার্ট রোডের উপর। ছিমছাম নতুন হোটেল, স্বাভাবিক কায়দাকানুন। কোন কলোনিয়াল হ্যাংওভার নেই। দেশের আর পাঁচটা তিন তারা হোটেলের মতোই। তবে বৈশিষ্ট্য একটাই, এদের দাবি সবকটা ঘরের ব্যালকনিতে বসেই নাকি দর্শন পাওয়া যাবে কাঞ্চনজঙ্ঘার। আর ঠিক সেই আশাতেই এই হোটেলের ঘরের বুকিং ।
তবে সবাই জানেন এই শহরের খামখেয়ালি আবহাওয়ার মতোই, বড্ড অনিশ্চিত তেনার দেখা পাওয়া। বিধি বাম হলে, হত্যে দিয়ে পড়ে থাকলেও দেখা যাবে না তার শ্রীমুখের। মেঘ আর বৃষ্টির খেলা চলতে চলতেই এসে যাবে আপনার ফেরার পালা।
আর কাল সন্ধ্যে থেকেই আকাশের মুখ ভার। মাঝেমধ্যে শোনা যাচ্ছে মেঘের গর্জন। তাই অতি সহজে যে পাহাড় চূড়া দৃষ্টি গোচরে আসবেন না তা বলাই বাহুল্য। তাই সে দর্শনকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে, সন্ধ্যা থেকেই পায়ের উপর পা তুলে বসে ছিলাম হোটেলের ব্যালকনিতে। দু পাশের পাহাড়ে হাজার জোনাকির মতো জ্বলে থাকা আলো চোখ ফেরাতে দিচ্ছে না। মাঝে মাঝে অবশ্য মেঘেদের ভেসে যাওয়া, নিভিয়ে দিচ্ছে সে আলোর আল্পনা। তবে মেঘ সরে গেলে আবারও জেগে উঠছে স্বপ্নালু আবেশ। ঠিক লুকোচুরি খেলার মতো যেন এই আলো আঁধারের খেলা।
ঘুম থেকে উঠে আজ সারা সকাল জুড়েও সেই একই মেঘে ঢাকা আকাশ। ছাদসমান কাঁচের দরজার পর্দা সরিয়ে দিলেও শুধু শ্বেতশুভ্র বিশ্বচরাচর। গিরিরাজের কোথাও দেখা নেই।
নীচের উপত্যকা দিয়ে খেয়ালি মেঘের দলের ভেসে বেরানো দেখতে দেখতে, ঠিক করলাম অনেক হয়েছে, এবার বেরিয়ে পড়ি।
গাড়ি বলাই ছিল।গন্তব্য দার্জিলিং থেকে আরেক শৈলশহর মিরিক। যদিও সে শহরের তাপমাত্রা এবং উচ্চতা দার্জিলিঙয়ে র তুলনায় অনেকটাই কম।
মিরিক যাওয়ার শুরুতে প্রত্যাশা ছিল না বিশেষ। সুমেন্দু লেক ছাড়া সেখানে বিশেষ কিছুই নেই দেখবার, এটা জানাই ছিল আমাদের।
কিন্তু সবটা জানা ছিল না।পাহাড়ের ড্রাইভ যে কতটা আকর্ষণীয় আর রোমাঞ্চকর হতে পারে, সেটা আমাদের মত সমতলের মানুষদের পক্ষে সবসময় বুঝে ওঠা কঠিন।
দার্জিলিং শহর ছেড়ে ঘুম থেকে ডানদিকে বাঁক নেয় মিরিক যাওয়ার রাস্তা। তারপর লেপচাজগৎ, সুখিয়াপোখরি, সীমানা ছাড়িয়ে নেপালের সীমান্তে গোপালধারা টি এস্টেট পার করে পৌঁছাতে হয় মিরিকে।
সকালে যাওয়ার পথে মেঘ রৌদ্রের খেলা চলেছে সর্বক্ষণ। লম্বা লম্বা শতাব্দী প্রাচীন নিশ্চুপ পাইন গাছের সারির মধ্যে দিয়ে ভাসমান মেঘের দল উপচে এসে পড়েছে সে যাত্রাপথে।
ছিটেফোঁটা রোদ্দুর পাত্তা পায়নি বিশেষ। সেরকম ভাবে আলোকিত করে রাখতে পারে নি রাস্তাগুলিকে।
আর গোটা রাস্তায় রয়েছে অনেকগুলি ‘হেয়ার পিন বেন্ড’। তাই পাকদণ্ডী বেয়ে নামা ওঠার সময় ড্রাইভারকে সতর্ক হয়ে থাকতে হচ্ছে সর্বদা।
যেটা বলার, আলো অন্ধকারের অসম্ভব মায়াবি হয়ে উঠেছে এই যাত্রাপথ, শেষ মুহূর্তে যাকে আরও সুন্দর করে তুলেছে গোপালধারা চা বাগানের অদ্ভুত সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। যেখানে নেমে একবার ছবি তুলতে হবেই আপনাকে।
মিরিকে পৌঁছে লেক দেখতে সময় লাগলো না বিশেষ। সেখানে ঘোড়সওয়ারি বা বোটিং কোনটাতেই আমাদের আকর্ষণ ছিল না।
টুকটাক মার্কেটিং করে আমরা লেক পার্শ্ববর্তী গুডরিকের ক্যাফে লেক সাইডে ঢুকে পড়লাম।
একটু সময় নিয়ে ভালো চা আর খাবার খেয়ে এবার ফেরার পালা। কারণ দার্জিলিং থেকে মিরিকের দূরত্ব কম নয়, প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটারের কাছাকাছি, যা পাহাড়ি পথের পক্ষে অনেকটাই। সন্ধ্যার আগেই আমাদের ঢুকে পড়তে হবে হোটেলে।
ফেরার সময় লক্ষ্য করলাম গোমড়া মুখো আকাশে মেঘের আস্তরণ অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। আর যতটা উপরে উঠছি দার্জিলিঙয়ের পথে, মেঘ যেন আরও ঘন হয়ে এসে বসছে এক্কেবারে রাস্তার উপর। এতটাই যে বেলা পড়ে আসার সাথে সাথে বেশ কিছু টার্ণে ‘ভিসিবিলিটি ‘
হয়ে উঠছে প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। আবার তার পরেই বেশ কিছুটা রাস্তা হয়তো পরিষ্কার।
বেলা চারটেতেই ফগ আর হ্যাজার্ড লাইট জ্বলছে সব গাড়ির। তার সাথে জানালা খুললেই টের পাওয়া যাচ্ছে ঠান্ডা হাওয়ার বেগ।
লেপচাজগতের কাছে এসে তাই থামতেই হলো আমাদের। দামাল পাহাড়ি বাতাস আর ঘন মেঘে আচ্ছন্ন ছোট্ট লোকালয়টি যেন পরিষ্কার দৃশ্যমান নয় এই মুহূর্তে। পাগলা হাওয়া জাস্ট কাঁপিয়ে দিচ্ছে সারা শরীর। কলকাতায় বসে যা ভাবাও সম্ভব নয় এখন।
ঝট করে তাই ঢুকে পড়লাম রাস্তার পার্শ্ববর্তী এক চায়ের দোকানে। মালকিনের হাতে তৈরি গরম গরম এক কাপ চা খেয়ে, মন আর শরীর চাঙ্গা হলো বেশ। মেঘ সামান্য সরে গিয়ে, রাস্তা আবার দৃশ্যমান হলে,বেরিয়ে পড়লাম ফের। হোটেলের নিশ্চিন্ত ঠিকানায়।