হাজারকে যে k বলতে হয় কেত মেরে, একথা বোধহয় এখন অনেকেই জানেন। মুহূর্মুহূ বাক্য হানেন–“স্যালারি? ওইইই.. ফর্টি কে অ্যাপ্রক্স”। বুকনি ঝাড়েন–“জামাটা, টু মাচ কস্টলি! টু কে! বাপ্স”
কিন্তু আমরা জানতুম না। আমরা হাজারকে হাজারই বলতাম, আর হাফ-প্যাডলিয়ে বড়ো হয়ে উঠতাম ন্যালাক্ষ্যাপার মতো, মাছে ভাতে আর ডালে। আমাদের খড়ি ওঠা পা, বাংলা মিডিয়াম জ্ঞান আর ইংরাজিতে নালে-ঝোলে!
তারপর তো একদিন কম্পিউটার গজালো দুনিয়াতে। ‘অ্যাপটেক’ এবং ‘এন আই আই টি’ স্যুইং ডোরওয়ালা পসরা সাজালো পাড়াতে পাড়াতে। দুয়ার-সামনে তার রাখা থাকতো সারি সারি হারকিউরিস ক্যাপ্টেন আর হিরো লেডিবার্ড ভিড় ক’রে। মাউস নামক যন্তরের তখনো আবিষ্কার হয় নি। আবিষ্কার হয় নি যেখানে খুশি সেখানে নিয়ে যাওয়ার কার্সার-ও। সি পি ইউ অথবা মনিটর নামক শব্দ তখন আমাদের কাছে অপরিচিত। আমাদের জন্য, সবটাই, সমস্তটাই কম্পিউটার। আমাদের তখন রয়েছে রমরমিয়ে “লাক্স প্রস্তুত করতা” শনিবারের হিন্দি ফিলিম, আমাদের তখন রয়েছে ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড রাতজাগা, আমাদের তখনও হট ফেভারিট “শ্বেত পাথরের থালা”।
এরই মধ্যে, সালটা তখন ১৯৯৯, গুজব রটলো রমরমিয়ে। ২০০০ সালে নাকি ধ্বংস হয়ে যাবে পৃথিবী। কাজ করবে না নাকি আর “জিরো এবং ওয়ান” এর বায়োনারি কোডেড কম্পুউটার। এবং সেই সময়েই সমাগত ২০০০ সালটির কেতাদুরস্ত নাম ছয়লাপ হলো পেপারে পেপারে– Y2K। অর্থাৎ ইয়ার টু কে। অর্থাৎ দু হাজার বর্ষ।
সেই প্রথম। সেই প্রথ্থমবার শিখলাম আমি হাজারকে k বলতে। এবং সেই আশ্চর্য বছরেই ভর্তি হলাম মেডিক্যাল কলেজ কোলকাতায়।
ভর্তির দিনটা এখনো মনে আছে হুবহু। কাউন্সিলিং হয়ে গেছে দিন কতক আগে। সেসব সেরে, বাড়ি ফিরে গেছি আমি। ফিরে, তারপর আবারও এসেছি কোলকাতায়, পুরুলিয়া এক্সপ্রেস ধরে। আজ, মেডিক্যাল ফিটনেসের ডেট। এশিয়ার শ্রেষ্ঠ মেডিক্যাল কলেজে অ্যাডমিশনের শেষ ধাপটুকু পেরোনোর দিন। চোখ এবং কান পরীক্ষা করিয়ে, দোতলার প্যাথলজি বিল্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে আছি পেচ্ছাপ হাতে করে। সেই প্রথমবার টেস্টটিউবে পেচ্ছাপ করা। বড্ডো ভজকট এবং চূড়ান্ত গা-ঘিনঘিনে একটা ব্যাপার। ইউরিনালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, প্রাণপণে দাঁত মুখ খিঁচাচ্ছি টেস্টটিউব তাক করে। ভয়েই হোক বা অস্বস্তিতে, হিসু হচ্ছে না একটুও। যদিও বা এক দু ফোঁটা পড়লো কোঁৎ পেড়ে পেড়ে, তারপর আবারও সেই পূর্ববৎ– চাক্কা জাম।
আমি চোখ বুজলাম। ভালো ভালো কথা কল্পনা করলাম। নিজেকে বোঝালাম–” রিল্যাক্স সব্য, রিলাক্স। মুততে হবে তো? ওক্কে! এটুকুই তো কাজ! শত সহস্র বছর ধরে মুতে আসছে মানুষ বিনা পরিশ্রমে, বিনা আয়াসে। আর আজ, সামান্য একটা টেস্টটিউবের ভয়ে তুই হিসু করতেই ভুলে যাবি??”
শেষমেশ হলো। ভয়ে ভয়ে একটু একটু করে মুখ বাড়িয়ে, তারপর ছড় ছড় নির্ঘোষে ঝর্ঝরিত হলো ইষৎ হলুদ জলধারা। এবং তখনই শুরু হলো দ্বিতীয় ভজকট-টির।
মুতে এসেছি চিরকাল কোমরে ডান হাত দিয়ে, পায়খানার প্যানে। এখন মুততে হবে টিপ করে, টেস্টটিউবের পানে। নিশানা এতটুকু ভুল হয়েছে, কি মরেছো! হাত ভিজে যাবে আপন রেচন ক্ষরণে। ফুলশার্টের ডান হাতাটা ভিজে মিজে একশা! হিসুর ছিট ছিট জলবিন্দু বিরজমান আঙুলে, তালুতে, কব্জিতে।
এবং সত্যিসত্যিই সেইসব নিয়ে, টেস্টটিউব ভর্তি খড় ধোওয়া জল মাফিক পানি সমেত, লাইনে দাঁড়ালাম আমি কাঁচুমাচু মুখ করে। আমার ঠিক সামনেই, আমার পূর্ববর্তী রাঙ্কের ক্যান্ডিডেট। লম্বা বিনুনী। শালোয়ার কামিজ। পাম শ্যু। হাতে তার হুবহু সেম কালারের জল ভর্তি টেস্টটিউব। তার সামনে, আরো জনা পঞ্চাশ কিশোর কিশোরী। কেউ ঢোলা জামা, কেউ কেতাদুরস্ত। কেউ ঘাড় ঘুরিয়ে বোকা বোকা হাসি দিচ্ছে নার্ভাসিয়া, কেউ বা স্টোনফেস্ড গম্ভীরিয়া, কেউ কেউ আবার আমারই মতো ভীতু ভীরু কাঁচুয়া মাচুয়া। পেচ্ছাপ টিউব হাতে অপেক্ষমান, দন্ডায়মান সারিবদ্ধ, জয়েন্টের সেরা ছাত্র ছাত্রীরা, সিরিয়াল মানিয়া ।
“মেয়েরা কী ক’রে, টেস্টটিউবে মোতে” এইসব গূঢ় ভাবনা ভাবতে ভাবতেই একসময় দেখলাম আমার “টার্ন” এসে গেছে। সম্মুখের মেয়েটি, হিসু জমা করে দিয়ে, বাম হাতে বাঁক নিয়েছে ততক্ষণে। আমিও তাই-ইই করলাম। অর্থাৎ জমা। অর্থাৎ হিসু। আমিও নাম বললাম এবং মেধাতালিকা বাতলালাম তুতলিয়ে তুতলিয়ে। তারপর মেয়েটির মতোই বাঁয়ে মুড়ে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি, আড্ডা জুড়েছে দুই পুরুষ। পুরুষদ্বয়ের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে একটি কিশোরী। এ তিনজনের একজন আমার চেনা, আমার আত্মা, অর্থাৎ আমার পিতৃদেব। একজন মুখচেনা, বা বলা ভালো পিঠ চেনা, অর্থাৎ লাইন সম্মুখস্থ কিশোরী। আর তৃতীয় জন, সম্পূর্ণ রকমেই অচেনা, রোগা দোহারা একজন প্রৌঢ়। প্রৌঢ় এবং পিতা আড্ডা মারছে দাঁত কেলিয়ে। একে অপরকে বলছে–” তুই”।
আমি, পায়ে পায়ে এগিয়ে, দাঁড়ালাম গিয়ে বাবার ঠিক পিছনটাতে। অদ্ভুতুড়ে এই ক্যানভাসে এবার চতুর্থ ব্যক্তি যুক্ত হলো। এবং ক্রমে জানা গেলো বিনুনি চুলের মেয়েটির পিতা এবং আমার বাপ, কলেজের বন্ধু। সেই মেয়েটির নাম শাশ্বতী। শাশ্বতী সেনগুপ্ত। মেডিক্যাল কলেজে, আমার প্রথম বন্ধু।
এরপরের ঘটনাটা, আমি একটা বিশেষ স্টাইলে বলবো।
এককালে, যখন ‘ভি.সি.পি’ ভাড়া করা হতো বাড়িতে পাড়াতে পালা পার্বণে, তখন, সেইসব কালে, ‘সপরিবারে দেখবার মতো ছবি’তেও নাচা গানা থাকতো আদিরসাত্মক। “আমি কোলকাতার রসগোল্লা” কিংবা “আজকে রাতে এসো শপথ করি” টাইপের। এসব গানগুলোকে তাই ফাস্ট ফরোয়ার্ডিয়ে টুঁই টুঁই পার করে দেওয়ার দায়িত্ব বর্তাতো, রিমোট নামক কন্ট্রোলের স্বত্তাধিকারী টেনিয়াদের। আমাদের বাড়ির ক্ষেত্রে যেমন আমি। গম্ভীর মুখে দ্রুত-অগ্রগামী/ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে দিতাম তাই আমিই, রিমোট দাবিয়ে অলক্ষ্য হতে অস্বস্তির।
ঠিক সেই রকমই। সেই রকমই এগিয়ে এগিয়ে, মূল বিষয়টা দেখে নেওয়া যাক। ফিরে তাকানো যাক স্মৃতি স্যুভেনিরের বুলেট পয়েন্টস।
হিসু পর্বের পরেই আমার যা মনে পড়ছে, সেটি হলো—
তোরঙ্গ ক্রয়। অথবা বলা ভালো, ট্রাঙ্ক কেনা। অন্তরে পুত্র গর্বে গর্বিত কিন্তু ব্যবহারে ‘হে গম্ভীর’ বাপ আমার, মম হাতখানিকে মুঠোয় ধ’রে নিয়ে যাচ্ছে কলেজ স্ট্রিট সংলগ্ন ট্রাঙ্কের দোকানে। দরদাম করে, খরিদ করছে টিনের তোরঙ্গ। তর্জনী এবং বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে ‘প্যাটপেটিয়ে’ মেপে নিচ্ছে টিনের পাতের গেইজ। আর তারপর, দোকানের ঠিক বাইরেটাতে সরু তুলি আর কৌটো ভর্তি লাল রঙ নিয়ে চট পেতে বসে থাকা কারিগরকে বলছে—“লেখো হে…সব্যসাচী সেনগুপ্ত। মেডিক্যাল কলেজ। কোলকাতা”।
আমার জাগতিক সম্পত্তিতে প্রথমবারের জন্য শীলমোহরিত হচ্ছে ‘আলমা ম্যাটার’।
এরপর খরিদ্দারি চলছে সিঙ্গল তোষক, শস্তার বালিশ আর পাৎলা কম্বলের। খরিদ্দারি চলছে ব্রাশ, টুথপেস্ট, লাইফবয় আর চপ্পলের। আর তারপর সবশুদ্ধ রিক্শার পা-দানিতে রেখে, ঠঙঠঙিয়ে চলেছি আমি-বাবা, ট্রামলাইন এবড়োখেবড়ো কলেজস্ট্রিট ধ’রে। গন্তব্য– মেডিক্যাল কলেজ মেইন বয়েজ হস্টেল।
ফাস্টফরোয়ার্ড অথবা জাম্পকাট –নাম্বার টু।
পাটভাঙা অ্যাপ্রন পরেছি আমি। অ্যাপ্রনের হাতাটা, বেখাপ্পার মতো নেমে এসেছে কনুইয়েরও নীচে। মধ্য অগস্ট অথবা ভরখোর ভাদ্রের দমবন্ধ গরমে দরদর ক’রে ঘামছি কুত্তার মতো। আমার, স্নান সেরে, সিঁথি কেটে, পাট ক’রে আঁচড়ানো চুল। আমার অ্যাপ্রনের ডান পকেটে আকাশী রঙের ‘ডিসেকশন বক্স’। আমার বুকে, ঢিপ ঢিপ ধড়কনের শব্দ। আমার সামনে, শায়িত ঢাউস লাশ। দাঁড়িয়ে আছি আমি এখন আরো গোটা কুড়ি অপরিচিত কিশোর কিশোরী সমেত ‘ডিসেকশন রুম’-এ।
এ জায়গাটা দ্বিতল। একতলার মস্তো চত্ত্বর থেকে ঘোরানো ঘোরানো লোহার সিঁড়ি উঠে গেছে, দোতলার গ্যালারিতে। সে সিঁড়ির পা ফেলবার ধাপগুলোতে ‘ফাঁক ফাঁক’ জাফরি। মাড়িয়ে যেতে হয় যে পথ, সেই পথও যে এত শৈল্পিক হতে পারে, সেখানেও যে কোনো অনামী কারিগর বহুযত্নে ফুটিয়ে তুলতে পারে লৌহ গাত্রে ‘ফুল পাতা লতা’ এ আমি দ্বিতলের ওই গ্যালারিতে না উঠলে জানতামও না কোনোদিনও। পা ফেললে সেখানে পদাঘাতে ঝঙ্কার ওঠে ধপধপ এবং ঝমঝম ধাতব।
সেই টপকেই, সিঁড়ি ঘুরে ঘুরেই দোতলায় এসেছি আমি। এসে, দাঁড়িয়েছি আমারই মতো বেখাপ্পা অ্যাপ্রন পরিহিত আরো জনা কুড়ি ছেলেমেয়ের সাথে, যাদের সকলেরই পদবী S দিয়ে শুরু। সামনে, মার্বেল স্ল্যাবে শায়িত এক বৃদ্ধা। মাথার খুলির আদ্ধেকটা হাপিশ। খুলি রয়েছে, কানের আগা থেকে বাকিটা। বৃদ্ধার থলথলে স্তন দু’টো অবহেলায় কেৎরে আছে দু ধারে। বৃদ্ধার বৃহদাকার পেটে মস্তো নাভি। বৃদ্ধার যোনিতে সামান্য সফেদ রোমের আভাস।
আমার এক ঝটকায় মনে পড়ে গিছলো ইস্কুলের কথা। “নিষেক” পড়ানো হবে যেদিন, অথবা পড়ানো হবে “পরাগমিলন” কিংবা ” ব্যাঙের জননতন্ত্র” সেই দিনগুলোতে, ক্লাসের অ্যাটেনডেন্স ছিলো এক্কেবারে ‘ফুল’। গাল কামড়ে হাসি কন্ট্রোল করতে করতে আমরা শুনেছিলাম, লুকিয়ে পড়া সানন্দা ম্যাগাজিনের ‘কানে কানে’ বিভাগের বাইরে, প্রথমবার যৌনতা-কথা।
সেই আমরাই দাঁড়িয়ে আছি সম্পূর্ন উলঙ্গ, উন্মুক্ত এক নারীর সামনে, ছেলে মেয়ে পাশাপাশি। লিঙ্গ এখন আর যৌনতা নয়। লিঙ্গ এখন ‘অবজেক্ট’ মাত্র।
আমার প্রথম শিক্ষয়ত্রী ছিলেন ইন্দুমতী ম্যাডাম। ভাবলেশহীন মুখে, শায়িত বুড়ির ঠ্যাঙে স্ক্যালপেল চালিয়ে কেটেছিলেন চামড়া। টুথ ফরসেপ দিয়ে সরিয়েছিলেন চামড়ার নিচের মুসম্বির মতো হলুদ হলুদ খুদি খুদি দানা । বলেছিলেন–” ক্লাস….ইট ইজ ফেত। সিম্পল ফেত ফেত”।
হস্টেল ফিরে বই খুলে জানতে পেরেছিলাম ‘ফেত’ হলো আদতে ‘ফ্যাট’। চামড়ার ঠিক নীচেই অবস্থিত সাবকিউটেনিয়াস ফ্যাটি ল্যেয়ার। আর সেদিন, সেইদিন থেকেই “নারী পুরুষ”, “শরীর লিঙ্গ” ফ্যান্টাসি উধাও হয়ে গিছলো আমাদের মন থেকে এক ঝটকাতে। শরীরকে জানতে শিখেছিলাম রক্তমাংস কঙ্কাল হিসাবে।
মেডিক্যাল কলেজে, এটাই আমার প্রথম পাঠ।
ফাস্ট ফরোয়ার্ড অথবা জাম্পকাট থ্রি।
কলেজ ক্যান্টিনে ভাত খাচ্ছি আমি শান্তনু সন্দীপ। এটা, মেডিক্যাল কলেজের দশম বা একাদশতম দিন। হাঁক মেরে বলেছি– “তিনটে ওমলেট কারি, ভাত..জলদি”। হাত ধুয়ে এসেছি, বেসিনের বাঁ পাশে রাখা ক্ষয়াটে, পিচ্ছিল, গোলাপী, সাবান-টুকরোয়। তারপর বেঞ্চিতে বসে, হাপসে মেখে, গরাস তোলার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে লক্ষ্য করেছি, আমার অ্যাপ্রনের বাম হাতায় নড়ে নড়ে হাঁটছে একখানি ম্যাগট। পচে যাওয়া মানবশরীরের কৃমিকীট জাতীয় পরজীবি। ডান তর্জনীর এক টুসকিতে সেই ম্যাগট-কে হঠিয়ে, ভাত মেখেছি আমি। শান্তনু ততক্ষণে ভাত-মুখে বিকৃত স্বরে গান ধরেছে “কাঞ্চনজানা…. কাঞ্চনঘর…অঞ্জন দত্তের এই গানটা শুনেছিস? সব্য? স্যান্ডি?”
আমি শিখে যাচ্ছি, সন্দীপকে কায়দা মেরে “স্যান্ডি” ডাকতে হয়। আমি পরিচিত হচ্ছি হেমন্ত মান্নার বাইরেও অঞ্জন এবং সুমনের সাথে। আমি উদাসীন হচ্ছি, আপাত ঘিনঘিনে কীটের প্রতি।
মেডিক্যাল কলেজে, আমার দ্বিতীয় পাঠ।
ফাস্ট-ফরওয়ার্ড অথবা জাম্পকাট ফোর।
ফুটপাথে পা পিছলে পড়ে গিয়ে, চোয়াল ভেঙে গেলো আমার। হস্টেল তো বটেই, হস্টেল বহির্ভূতরাও ভীড় জমালো সদলবলে। সেলাই করা হচ্ছে যখন আমার থুতনি, তখন কাঁদতে কাঁদতে বাইরে বেরিয়ে গেলো সুজয় বালা। দাঁতে দাঁত চিপে, আমার যন্ত্রনায় কুঁকড়ে যাওয়া ডান হাত, তালু বন্দি করে রাখলো সৌগত আর অভিষেক। চিবিয়ে খেতে পারবো না ব’লে, চাঁদা তুলে হরেক রকম ‘স্যুপ’ কিনে নিয়ে এলো আপাত স্বল্প পরিচিতরাও সদলবলে। বললো–“রাখ তোর পয়সা। এটা, আমাদের তরফ থেকে ট্রিট।” আর পঁচিশে ডিসেম্বর আমাকে একলা ফেলে রেখে পার্ক স্ট্রিটে “মাগী দেখতে” চলে গেলো হৈ হৈ করে।
আমি বুঝে গেলাম, বন্ধুরা আদতে হারামি। এবং হারামি বিনা আমি বড়ো একলা।
মেডিক্যাল কলেজে, আমার তৃতীয় পাঠ।
ফাস্ট ফরোয়ার্ড অথবা জাম্প কাট ফাইভ।
সেকেন্ড ইয়ার। সেকেন্ড প্রফেশনাল এম বি বি এস পরীক্ষা।
‘সিট পড়েছে’ আর.জি.কর-এ। ফরেন্সিক মেডিসিনের পরীক্ষার দিন প্রশ্ন এসেছে লং কোয়েশ্চেন ‘অ্যান্টি মর্টেম ড্রাউনিং’ এবং ‘এক্সামিনেশন অফ রেপ এক্যুউজড’। যেকোনো একটা লিখলেই হবে। আমি, স্বভাব হারামি, দ্বিতীয়টা লিখতে বসলাম। আর লিখলাম, গরুর রচনার মতো। দশ পনেরো লাইন আগড়ম বাগড়ম লিখেই, সরাসরি চলে গেলাম পোটেন্সি অর্থাৎ ‘দাঁড়ায় কি না’-তে। কল্পনার ঘোড়া ছোটালাম সপ্তসমুদ্দুর। ঘষঘষিয়ে লিখলাম— এই ‘দাঁড়ানোর’ একটা পরীক্ষা হলো, পর্নোগ্রাফিক বই দেখিয়ে এক্সামিন করা। এক্ষেত্রে, পর্নোগ্রাফি, বা পানু হলো ‘গরু’। কোনোভাবে উত্তরটা ওই অব্দি নিয়ে যেতে পারলেই ব্যাস! কেল্লাফতে!
তা নিয়ে বা আমি গেলামও। এক্সট্রা পাতা নিলাম প্রথম প্রশ্নের উত্তর লিখতেই। এবং পরীক্ষা শেষে স্বর্ণালী সেন, আমার আগের আগের রোল নাম্বার বললো হাসতে হাসতে–“পানু পেয়েই ফাটিয়ে দিয়েছিস! বল?”
মেয়ে মানুষ, আর পুরুষ মানুষ যে আদতে স্রেফ মানুষই, তাদের জেন্ডার আলাদা হলেও যে, তারা আড্ডা মারতে পারে যা খুশি, জেনে গিছলাম আমি। জেনে গিছলাম, বন্ধু অথবা রোগীর কোনো জেন্ডার হয় না।
মেডিক্যাল কলেজে, আমার চতুর্থ পাঠ।
ফাস্ট ফরোয়ার্ড অথবা জাম্পকাট সিক্স।
অ্যাকুয়াটিকা কোলকাতায় তখন গভীর রাতের রঙবিরঙ্গি আলো জ্বলে উঠেছে সাড়ম্বরে। খড়ের ছাউনি দেওয়া একটা চাতালে, একটু আগেই গ্রুপ ফটো তোলা হয়েছে ওয়াই টু কে অথবা মিলেনিয়াম ব্যাচ অফ কোলকাতা মেডিক্যাল কলেজের। সমস্ত দিন, সেই সক্কাল বেলা থেকে এখানে হুল্লোড় করেছি আমরা। মদ খেয়েছি, গান গেয়েছি, গলা জড়িয়ে কেঁদেছি নাকের জলে চোখের জলে। এটা, এই রাতটা, আমাদের একত্রতার শেষ রাত। পাঁচ বছরের এম.বি.বি.এস এবং এক বর্ষীয়া ইন্টার্নশিপ, আজ রাতেই খতম। কন্টাইয়ের স্বরাজ, কাঁচরাপাড়ার সৌগত, জামশেদপুরের দেবযানী, বিহারের বিকাশ, পাইকপাড়ার শাশ্বতী, নেপালের সুভাষ কে.সি., আজ অফিসিয়ালি উড়াল মেলবে এদিক ওদিক সেদিক। তার আগে, এই একটা রাত আমাদের। স্রেফ আমাদের। আজ শেষবার আরো একবার–” আমরা”।
ডিনার শেষ হয়ে গেছে একটু আগেই। বেস্টফ্রেন্ড সৌগতকে খুঁজে পাচ্ছি না হাজার ঢুঁড়েও। তন্ময় মাইতি জীবনে প্রথমবার মাল খেয়ে, ঘিয়ে রঙের প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে বসে হেঁচকি তুলছে। চুলগুলো সম্পূর্ণ রকমের এলোমেলো। আমিও চূড়ান্ত রকমের নেশাগ্রস্ত। আমার চোখে, টানেলড ভিসন। ঠিক যেন খবরের কাগজ পাকিয়ে, তার একপ্রান্ত দিয়ে ফুটোস্কোপে দেখছি দুনিয়াটাকে। এবং চোখে পড়ছে স্রেফ ওই তন্ময়ের মুখটুকুই। টসটসে, ফর্সা, আলুথালু, করুণ। আমার সহসা বড্ডো ইচ্ছে হলো জাপটে জড়িয়ে ধরি ওকে। ইচ্ছে হলো, ঘেঁটে দি আরেকবার ওর অলরেডি ঘেঁটে যাওয়া চুলগুলো। এত সুতীব্র সেই ইচ্ছে যে, এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আমি আমার অঙ্গুলিপ্রান্তে পরশ পেলুম সিল্কি মসৃণ। এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আমার আঙুলে চিপচিপালো তন্ময়ের চুলের ঘামে।
অথচ…অথচ…. এমন প্রবল ইচ্ছা সত্ত্বেও আমি উঠলাম না এপাশের চেয়ার ছেড়ে। পার হলাম না দু’কদম পথ। উল্টে, দিশেহারার মতো তাকালাম এদিক ওদিক। আমার সুড়ঙ্গ দৃষ্টিপথে একের পর এক দেখতে পেলাম অভিষেক, সুজয়, পুনম, দীপঙ্কর, ‘প্রাফুল’কে। আর একটার পর একটা স্মৃতি মনে পড়ে যেতে লাগলো ঝরঝরিয়ে। এরা, এই ছেলেমেয়েগুলো, আমার বিগত ছয়বছরের সবটা। আমার সমস্তটুকু। কারো সাথে পায়খানা করা নিয়ে স্মৃতি তো কারো সাথে ফ্লার্ট ফ্লার্ট খুনসুটি। এরা ছিলো আমার ডালে, ভাতে, পাদে, নাক খোঁটায়, স্নান করায় এমন কি স্বমেহন মুহূর্তেও জড়িয়ে। এবার থেকে, আজ থেকে, আচমকা ড্রপসিন।
হঠাৎ আমার কলার-এ টান পড়লো। মুখ ফিরিয়ে দেখলাম স্বরাজ। স্বরাজ মাইতি। বাঁ হাতে বিয়ারের বোতল, ডান হাতে সিগারেট। ফিসফিস করে বললো— “আয়। হাঁটি। আর তো হবে না…, সেই যে সেই মাঝরাত্তিরে পড়তে পড়তে উঠে চা খেতে যেতাম শিবুর দোকানে…. ট্রাম লাইনে তুই আমি….সেই একবার ট্রামের ভূত দেখেছিলাম মনে আছে…চাকা আর পাটাতন…ছাদ মাদ কিছু নেই… সেদিন শালা….।”
স্বরাজ বকে যাচ্ছিলো একটানা। আমি শুনবার চেষ্টা করছিলাম খুব মন দিয়ে। কিন্তু ফোকাস করতে পারছিলাম না একটুকুও। তাই হাঁটছিলাম এলোমেলো পায়ে, স্বরাজের কাঁধে মাথা দিয়ে। আর স্বরাজ মাঝেমধ্যেই ডান হাতটা আমার ঠোঁটের সামনে এনে ধরছিলো। আমি টান দিচ্ছিলাম বন্ধুর থুতুতে ভেজা ফিল্টারে।
এভাবেই পায়ে পায়ে এগিয়ে এসেছি আমরা অনেকটা। ছাড়িয়ে এসেছি ‘ডি.জে’ ঘিপঘাপ কোলাহল। এপাশটাতে কেবল জোনাক জ্বলা, ঝিঁঝিঁ ডাকা নৈস্তব্ধ্য। চেকার্স টাইলসে মোড়া আঁকাবাঁকা রাস্তা। আর তার দুইপাশে ছোট্ট ছোট্ট রডের ওপর বসানো, গোল্লা গোল্লা রাত-বাতি। কোনোটা জ্বলছে, কোনটা আবার জ্বলছে না। যেগুলো জ্বলছে, সেগুলোর কাচের গায়ে শ্যামাপোকার ইকিড়মিকিড়। গঙ্গাফড়িং আর উচ্চিংড়ের শ্যিলুয়েট। আলো আঁধারিতে হীরের মতো ঝকমকাচ্ছে দুপাশের ঘাস-জমিনের শিশির বিন্দু। আর সেসবেরই মাঝখানে, হঠাৎ চোখে পড়লো একটা পিঠ ফেরানো ছায়ামূর্তি। সামনের দিকে ইষৎ ঝুঁকে থাকা। বেঁটে। রোগা। এ ছায়ামূর্তিকে আমরা চিনি। আমরা যে আদতে চিনি আমাদের প্রত্যেককে হাতের তালুর মতোই। এটা, নির্মাল্য। নির্মাল্য হোড়। ফ্রম দুর্গাপুর।
নির্মাল্য কথা বলছে নিজের মনেই। না…না….কথা নয়…কথা নয়…নির্মাল্য গান গাইছে … বিড়বিড় করে…স্খলিত কন্ঠে…বেসুরো…। ক্রমশ সুস্পষ্ট হচ্ছে সেই গানের লিরিক্স…
“সোজাসুজি আজ তর্ক হোক, চোখে চোখে দিই ধমক, হয়ে যাক ফয়সালা, ট্রা লা লা লা, ট্রা লা লা” ….ফসিলস…রূপম … শোনো আমরা কি সবাই/ বন্ধু হতে পারি না….
খপ করে গিয়ে ধরলাম নির্মাল্যকে লাফ মেরে। বিনা বাক্যব্যয়ে নির্মাল্যও ঘুরে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো আমাদেরকে তীব্র। জাপটে ধরলো আমাকে আর স্বরাজকে। জড়ানো গলায় বললো—“ওহঃ ..কী পেচ্ছাপ পেয়েছে মাইরি…মাইরি সব্য…. মাইরি স্বরাজ মাইটিপি…মাইরি একটু ধরবি…আমি পেচ্ছাপ করতে গেলেই পড়ে যাবো…ধর না…প্লিজ…. কিন্তু ….. কিন্তু …. এরপর থেকে আমায় আর কে ধরবে রে…”
আশ্চর্য্য সেই রাতে, নির্মাল্য ঘাসে মুতছে ছড়ছড়িয়ে। আমি বাম হাতে খামচে ধরে আছি নির্মাল্যর কলার, আর টেনে রেখেছি পিছনের দিকে। আমার কানে একইসঙ্গে এসে ঢুকছে হিসুর শব্দ আর স্বরাজের প্রলাপ—“বোনটা…আমার বোনটা… গোড়ালিটা ওর ভেঙে গেলো রে…. ঠিক তো হলো না আর কিছুতেই … এখনো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে …. জানিস ….”
হঠাৎ হিসু-শব্দ আর স্বরাজ-বিলাপের যুগলবন্দীর মাঝে বেসুরো কন্ঠের আগমন ঘটলো বেতালা।– “সব্যওওওওও.. সব্যওওওওওও ….. কোথায় তুই ….. আমাকে যে বাঁড়া ওরা বললো …. তুই এদিকে এসছিস ….. তুই কোথায় … এই তো… এইইইইউ ত্তো …. সব্যওওওও …. আমি আইসক্রিম সবটা শেষ করি নি সব্য ….. তুই আমার থেকে এক চামচ খা …. স্বরাজ … বোকাচোদা … তুইও খা … আর তো খাওয়া হবে না রে..”।
সৌগত এসেছে ছুটতে ছুটতে রলিক আইসক্রিমের বাটি হাতে। চামচে করে খাইয়ে দিচ্ছে গলে যাওয়া ভ্যানিলা আমাদের নাকে মুখে। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে হেসে উঠছি আমরা। আমার আইসক্রিম-ঠোঁট ঘষে যাচ্ছে স্বরাজের বুকে, সৌগতর আইসক্রিম-হাত লেবড়ে যাচ্ছে আমার ঘাড়ে। এবং তখনই খেয়াল হচ্ছে সহসা, নির্মাল্যর কলার ছেড়ে দিয়েছি আমি। সচকিতে পিছু ফিরে দেখছি, নির্মাল্য সটান উপুড় হয়ে শুয়ে আছে প্রস্রাব সিক্ত ঘাস-জমিনেই। তুলে ধরছি তিনজনে মিলে হুড়মুড়িয়ে ওকে। তালু দিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছি মুখে চোখে লেগে থাকা পেচ্ছাপ অথবা শিশির বিন্দু বড়ো আদরে। আর নির্মাল্য অনুযোগ করছে–“আমার? আমার?… আমার জন্য আনলি না?… বাল !… আমার জন্য আইসক্রিম নেই..”।
অদ্ভুত সেই রাতে, নিজেদের ঠোঁট অথবা জামার হাতায় লেগে থাকা এক দু বিন্দু রল্যিক ভ্যানিলা চেঁছে নিয়ে আমরা খাইয়ে দিচ্ছি নির্মাল্যকে তিনজনেই। আর আক্ষরিক জড়াপুটলি হয়ে গেয়ে উঠছি বেসুরো–“দিল চাহতা হ্যায়… ওও ওও ও। ও ।ও ।ও”
মেডিক্যাল কলেজের শেষ দিনে, এ হলো, আমার কিছুই না শেখার পাঠ।
তারপর তো পেরিয়ে গেলো আরো অনেক অনেকগুলো দিন। আঠারো বছর বয়সে ভর্তি হয়েছিলাম, পরিচিত হয়েছিলাম আমরা। বন্ধু হয়েছিলাম, প্রথমবারের জন্য। আর আজ এই দু হাজার উনিশ-এর ষোলোই অগস্ট আমরা পার করে ফেললাম সেই প্রথম পরিচয়ের উনিশ বছর। অর্থাৎ, যে বয়সে তৈরি হয়েছিলো, জমাট বেঁধেছিলো ‘ওয়াই টু কে’ অথবা ‘মিলেনিয়াম ব্যাচ’ একদা, সেই বয়স আরো একবার পার করে ফেললাম আমরা সক্কলে। এখন তো আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপও আছে ‘CMC Y2K BATCH’ শিরোনামে। আড্ডা হয়, ঝগড়া হয়, ‘গ্রুফ লেফ্ট’ এবং ‘অ্যাডেড ইউ’ হয় মুহূর্মুহূ। আর পরিকল্পনা হয় — দি গ্র্যান্ড রিইউনিয়ান-এর। কোনো বছর সত্যি হয়। কুড়ি তিরিশ অথবা চল্লিশজনের সমাবর্তন। কোনো বছর হয়তো চল্লিশ কিংবা পঞ্চাশ। এ বছরেও হওয়ার কথা ছিলো নিয়মমাফিক।
হয় নি। কিম্বা হবে না আগামী বছরগুলোতেও।
গ্র্যান্ড রিইউনিয়ান আদতে হওয়া সম্ভব নয় কোনোদিনই।
প্রভঞ্জন, সঞ্জীব, স্বরাজ, বিকাশ, শ্রবণকান্তি…. তোরা ভালো আছিস? আকাশের ঠিকানায়?
দিল চাহতা হ্যায়…
কভি না বিতে, চমকিলেঁ দিন,
দিল চাহতা হ্যায়,
হাম না রহেঁ কভি ইয়ারোঁ কে বিন….
ওও ওওয়ো ওয়ো ওয়ো ওয়ো ওয়ো…………
…………………….
…………………….
…………………….
And so long….
So long …………
My souls……
( ফটো কার্টেসি– Puspen Mandi )