তখন সদ্য মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ, তার সাথে আসানসোল রামকৃষ্ণ মিশনে দশ বছরের নাট্যমঞ্চেও আকস্মিক যবনিকাপাত। সবার কপালে চিন্তার ভাঁজ- এর পর কোথায়! কেউ নরেন্দ্রপুর, কেউ পুরুলিয়া, কেউ দুর্গাপুর- বিভিন্ন মতামতের মাঝে দিগ্ভ্রান্ত পরিস্থিতি তখন।
“আসানসোলের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, এখানে পড়ানোর মত টিচারও নেই”- এসব কথার ফাঁকে দ্বারস্থ হলাম হেড-মহারাজের কাছে আর উত্তরও পেলাম মনমতো – “যেখানেই যাও, যেখানেই পড়ো, নিজেকেই পড়তে হবে। কেউ তোমার পড়া তোমাকে পড়িয়ে দিতে পারবে না।” কথাটা আজও অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলি।
যাই হোক, সেই কথা মেনে এই ক্ষুদ্র আমি, ক্ষুদ্র এক স্কুলে পদার্পণ করলাম, নাম আসানসোল চেলিডাঙা হাই স্কুল। ‘ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখ-কথা’, ছোট নাম, ছোট ঐতিহ্য। ‘ছোট’ নামের স্কুলে পড়ছি তাও সমাজ মেনে নিয়েছিল- কিন্তু বারবার একটা কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল স্কুলে কিন্তু বেশি যাওয়া চলবেনা। ঘরে বসে পড়বে, টিউশন যাবে আর স্কুলে প্র্যাকটিক্যাল করবে- এর বেশি কিছু করতে গেলেই আর জয়েন্ট দেওয়া হবেনা।
স্কুল শুরু হল। আগেকার স্কুলের সাথে নিয়ম-কানুন, পরিবেশ-পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা- মানিয়ে নিতে সত্যিই সমস্যা হয়েছিল। এমন অবস্থায় জীবনে এলো কয়েকজন মানুষ- প্রথম নামটা আমাদের ক্লাস ইলেভেনের ক্লাস টিচার কৃষ্ণেন্দু দাশগুপ্ত স্যার। সাহিত্য পছন্দ ছিল, সাহিত্য-অনুরাগী মানুষদেরও- তাই প্রথম স্যারের সাহিত্যে ব্যুৎপত্তিই নজর কেড়েছিল। স্যারও ভালোবাসতেন আমাদের, ভালোবাসেন বলা চলে। পারস্পরিক সম্পর্কটা এতটাই কাছের ছিল যে স্যারকে রাগের বশে স্কুলের পরিস্থিতি নিয়ে কথা শুনিয়েছিলাম, এমন কি হেড স্যারকে নিয়েও। স্যার অনেক কথা বলেছিলেন সেদিন, বুঝিয়েছিলেন- আজ সরকারি হাসপাতালে এক বছর কাজ করে সেই কথাগুলো খুব মেলাতে পারি।
আরেকজন মানুষ দেবাশিস স্যার, দ্বাদশ শ্রেণীর ক্লাস টিচার- রসায়ন পড়ালেও ‘রাসায়নিক’ ছিলেন না একদমই, খুবই খোলা মনের মানুষ। স্যার একটা কথা খুব বলতেন, “যারা ভালো রেজাল্ট করেছে এই স্কুল থেকে, তারা কিন্তু ক্লাস করেই করেছে। স্কুল কামাই করে ভালো রেজাল্ট হয়- এটা খুব ভুল ধারণা।” স্যার যেমন নিয়মিত পড়াতেন, তেমনি খুব সুন্দর গল্প বলতেন, তেমনি ছিল তাঁর বিজ্ঞান মঞ্চের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ। ছোলা ভিজিয়ে শিবলিঙ্গ স্থাপনের গল্প, বেড়াল দেখে গাড়ি থামিয়ে স্বর্গপ্রাপ্তির গল্প- আজও জীবন্ত হয়ে আছে স্যারের বলার নাটকীয়তায়।
জীবন বিজ্ঞানের স্যার কৃষ্ণেন্দু পাল স্যার- যাঁর জন্যে স্কুল কামাই করার কোনো উপায় ছিল না। একদিন না গেলেই এমন কিছু একখানা জিনিস পড়িয়ে দিতেন, যেটা পরে গিয়ে আবার শিখে আসতে হতো। স্যারের হাত ধরে প্রথম Guyton -র বইয়ের সাথে পরিচয়। Cardiac cycle ওই সময় স্যারের পড়ানো, আজও সেভাবেই মনে রেখেছি।
পদার্থ বিজ্ঞানে এই ‘অপদার্থ’কে আশার আলো যাঁরা দেখিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন হিমাদ্রি স্যার। স্যারের সাথে আমার প্রথম কথোপকথন “তুমিই শুভাংশু পাল? আচ্ছা তুমি সত্যি রায়-মার্টিন পড়তে না এমনি বলে দিয়েছিলে?” আর বিদায়ী অনুষ্ঠানের দিন বক্তব্য রাখার পর স্যার বলেছিলেন, “তোমার কথাগুলো যেন তোমার কাজের মধ্যেই সব চেয়ে বেশি প্রতিফলিত হয়”। যদিও সেইসব প্রতিশ্রুতি রাখা সম্ভব হয়নি- কিছু নিজের দোষে, কিছু ভাগ্যের পরিহাসে- কিন্তু এই দুই সংলাপের মাঝে অনেকখানি পথ চলা ফিজিক্সের হাত ধরে- সে সব মনে থাকবে আজীবন।
জীবন বিজ্ঞানের আরেক জন স্যার- কৃষ্ণ মল্লিক স্যার। স্যারের মুখ, চক আর হাত এক সাথে চলতো! এই মানুষটার কাছে আমি এই জন্যে সারা জীবন ঋণী থাকবো কারণ উনি না পড়ালে বটানি পড়ানোর কেউ ছিল না। আর স্বভাবতই ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় ডাক্তার হওয়ার জন্যেও জাইলেম-ফ্লোয়েমের বিন্যাস জানা বাঞ্ছনীয়। তাই স্যার না থাকলে আজ ডাক্তারি পড়াটাও হতো কিনা সন্দেহ! টেস্ট পরীক্ষায় bradycardia -র সংজ্ঞা ঠিক উল্টোটা লিখে আসায় কত কথাই বলেছিলেন ডেকে- এতো যত্ন করে পড়ানোর মানুষ পাওয়া ভার।
অঙ্কে আমার উৎসাহের অভাব ছিলনা!! যদিও খাতাটা ক্লাসেই বন্ধ হতো, আবার সেখানেই পরের দিন খুলতো। তাতেও পূর্ণচন্দ্র স্যার প্রত্যাশার ডালি সাজিয়ে থাকতেন- পরীক্ষা ভালোই হবে!! গোটা স্কুলের দায়িত্ব সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে স্যারের ঘাড়েই ছিল মোটামুটি, তার সাথে সমান তালে পড়িয়ে যাওয়া- স্যারের পক্ষেই সম্ভব। সুদর্শন স্যার, অনেক কিছুই পড়ানোর চেষ্টা করতেন- কিন্তু অনুশীলনের অভাবে আর যাই হোক অঙ্ক শেখা হয়না, আমারও হয়নি। সেই পরীক্ষার খাতায় একটা করে ছোট ভুল, তাতে গোটা অঙ্কটা কেন কাটা হবে- সেই নিয়ে স্যারের সঙ্গে দরাদরি- মনে পড়লে এখনো হাসি পায়।
সাহিত্য দিয়ে শুরু করেছিলাম, সাহিত্য দিয়েই শেষ করি- হিমাংশু স্যার ছিলেন আমাদের বাংলার শিক্ষক। তা বিজ্ঞানমনস্ক ছাত্রদের বাংলার রস সেবন করাতে তাঁকে যথেষ্টই বেগ পেতে হয়েছিল। এখনো মনে পড়ে, ক্লাসের অধিকাংশ ছাত্র ‘ধ্বনি’, ‘শব্দ’, ‘দল’, ‘অক্ষর’- এগুলোর মানে বলতে পারেনি- সেইসব প্রতিকূলতার মধ্যেও স্যার চেষ্টা করে যেতেন আমাদের পড়ানোর।
বিমল স্যার, চণ্ডীদাস স্যার- নিয়মিত ক্লাস করলেও হয়তো বয়সের ব্যবধান কাটিয়ে স্যারদের সঙ্গে ততটা ঘনিষ্ঠতা আমাদের হয়নি। কিন্তু এই বয়সেও জোর করে স্কুলে আসা ছাত্রদের পড়ানোর অদম্য চেষ্টা- শ্রদ্ধা জাগে এখনো।
এই মানুষগুলো দৃষ্টিভঙ্গিটা বদলে দিয়েছিলো। স্কুল বা যে কোনো প্রতিষ্ঠান, নাম বা তার অবয়ব দিয়ে চিহ্নিত হয়না, হয় তার ভেতরের মানুষগুলোকে দিয়ে। শুরুতে স্কুলের নাম বলতাম, অনেকেই চিনতে পারতো না- দায়িত্বও নিতাম না চেনানোর। কিন্তু সময়ের সাথে স্কুলটা কেমন নিজের হয়ে গেলো, তখন চেনানোর দায়িত্বটাও আবার নিজের হয়ে গেলো। স্কুলে এসেছিলাম দু’টো বছর কাটানোর জন্যে। স্কুলের শেষ দিন আবার মন খারাপ হয়ে গেছিল এটা ভেবে “দুটো বছর দেখতে দেখতে কেটে গেলো!” না স্কুলবাড়িটা ঠিকঠাক চিনতে পারলাম, না স্কুলের বাকি ছাত্রদের, না সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের।
ছ’টা বছর কেটে গেছে- রাস্তাগুলো এখনো আছে। জয়দীপের অটো ধরার রাস্তা, ময়ূখ-রৌনকদের ফেরার রাস্তা, সৌরদীপ-দেবপ্রিয়-আবির-সুমন-অনীশদের সাথে মোড়ে দাঁড়িয়ে গল্প করার রাস্তা, পুলিশ লাইনের মাঠে খেলতে যাওয়ার রাস্তা- রাস্তাগুলো ফিরিয়ে নিয়ে যায় ছয় বছর আগের একটা দুনিয়ায়, যখন রাস্তাগুলো আমাদের ছিল। এখনো সেগুলো আছে, তবে আমাদের নয়- সাদা জামা- মেরুন ট্রাউসার পরিহিত নতুন একদল ছেলের। স্কুলটা এভাবেই স্মৃতিতে বেঁচে থাকুক, এই নতুন নাম-না-জানা ছেলেদের হাত ধরে।
এই ‘ছোট’ স্কুলের শিক্ষক হিসেবে স্মৃতিচারণ মন ছুঁয়ে গেল। ছাত্র হিসেবে ডঃ শুভাংশু পাল’কে পাওয়া আমার শিক্ষক জীবনের এক বড় প্রাপ্তি।