২৮.০৯,২০২৪
৯৬. সব আন্দোলনের একটা শুরু হয়, একটা ক্লাইম্যাক্স হয়, আবার কালের নিয়মে সেই আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়। সরকার প্রতি মুহূর্তে অপেক্ষা করেছে কখন সেই মুহূর্ত আসবে! আসেনি, বরং প্রতি ধাপে তা তীব্রতর হয়েছে। কতটা অসহায়তা থেকে মমতা ব্যানার্জির মতো একজন দাম্ভিক মহিলা ধর্ণামঞ্চে এসে উপস্থিত হন, সেটা সহজেই প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন ২৬দিন ধরে তাঁর অনশনে কোনো বাম নেতা তাঁকে দেখতে আসেনি। উনি ভুলে যাচ্ছেন ন্যায্য চাকরির দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষকদের কয়েক বছরের আন্দোলনেও তাঁর ঘুম ভাঙেনি। আজ যখন অভয়ার খুন-ধর্ষণে তাঁর সরকারের প্রত্যক্ষ অংশীদারিত্ব প্রকাশ্য দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়েছে, আন্দোলনের প্রতিটা ক্ষণ তাঁর গলায় কাঁটার মতো বিঁধেছে। তাই তিনি মঞ্চে এসেছেন, পাঁচ বার বৈঠকের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন- কোনোটাই তাঁর বদান্যতা নয়, তাঁর অপরাধবোধের এবং গদি হারানোর আশঙ্কারই ফল। অবশেষে কর্মবিরতির ইতি যখন টানা হলো, স্বস্তির নিঃশ্বাস তো নিশ্চয়ই ফেলেছেন তিনি।
৯৭. স্বাস্থ্যভবন থেকে সিজিও কমপ্লেক্স পদযাত্রার মাধ্যমে স্বাস্থ্যভবন অবস্থান তুলে নেওয়া হয়। চল্লিশ দিন ধরে আন্দোলনের পরও সেই মিছিলে উদ্দীপনার কোনো অভাব ছিলনা- না ডাক্তারদের, না অ-ডাক্তারদের। কিন্তু সেই মিছিলের প্রতি পদক্ষেপে যেন ছিল এক অদ্ভুত বিষাদের ছাপ। জীবনের যত শিক্ষা যেন এই রাস্তায় পূর্ণতা পেয়েছে, এই মিছিলে গেয়েছি জীবনের জয়গান। সেই মেডিক্যাল কলেজের কোঁকড়া চুলের ছেলেটা- যে আমায় শেখালো পুলিশের চোখে চোখ রেখে স্লোগান দিতে; সেই যে ন্যাশনালের একদল দামাল ছেলেমেয়ে- লালবাজার থেকে স্বাস্থ্যভবন যাদের স্লোগানের তীক্ষ্ণতা কমেনি এক মুহূর্তের জন্যও; সেই ছেলেটা যে নিজের বাপকে সদ্য সিসিইউ-তে হারিয়ে ফেলেও ক্রমাগত লড়ে গেছে, নেতৃত্ব দিয়েছে আন্দোলনে; সেই যে বালক অঝোর বৃষ্টিতেও ক্রমাগত বোতল বাজিয়ে স্লোগান দিয়ে গেছে, এমনকি আজও দিয়ে চলেছে- আপাতত সেই পথ চলায় সাময়িক ইতি। কিন্তু যারা এই আন্দোলনে সামিল হয়েছেন তাদের সকলের মধ্যে প্রতিবাদের যে বীজ বপন হয়েছে, তার ফল হবে সুদুরপ্রসারী। এই বীজ যখন মহীরূহ হবে, সব অন্যায়ের বেড়াজাল কাটিয়ে আকাশের দিকে এগোবে- হাইল্যান্ড পার্ক থেকে শ্যামবাজারের সুদীর্ঘ মশাল মিছিল সেই প্রতিশ্রুতিই মনে করিয়ে দেয়।
৯৮. অনেকের কাছে এই আন্দোলন অনেকাংশে ব্যর্থ, অনেকটা পর্বতের মূষিক প্রসবের মতো। কার্যত আন্দোলনের ফল বলতে কিছু আধিকারিকের পদ পরিবর্তন। আপাতদৃষ্টিতে তাই। কিন্তু যারা প্রথম দিন আরজিকরে ছিল তারা জানে, অভয়া একজন ডাক্তারের আত্মহত্যা হয়েই থেকে যেত। সেখান থেকে এই যে জন-আলোড়ন, তা নিকট অতীতে কেউ দেখেছে বা শুনেছে বলে মনে হয়না। হ্যাঁ, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়নি। কিন্তু গদির লড়াই শেষ কথা নয়।
চেয়ারে যেই থাক, একজন প্রান্তিক মানুষও যেন নিজের অধিকারের লড়াইটা লড়ে নিতে পারে, সেটাই গণতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য। আর এই আন্দোলন এটাই শিখিয়েছে। “আর কবে কণ্ঠ শক্তি পাবে!!” মানুষের এই নবজাগরণের তাৎপর্য ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়।
১০০. অনেকেই ভাবছেন এই আন্দোলন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, কেউ কেউ ভাবছেন ভেতরে ভেতরে সেটিং হয়ে গেছে!! কেউ কেউ মনে করেছেন এই আন্দোলন থেকে কিছু মানুষ শুধু জনপ্রিয়তা হাসিল করতে নেমেছে। এসব মনে হওয়া ভুল কিছু নয়, কারণ পূর্বে এরকম দৃষ্টান্ত বিরল নয়। তবে এটুকু বলতে পারি, এই আন্দোলনের কোনো মুখ ছিল না- মিডিয়ার সামনে যাদের দেখা গেছে, তাদের থেকেও অনেক বেশি জড়িত ছিল কিছু মানুষ আন্দোলনের পরতে পরতে। আন্দোলনের প্রত্যেকটা সিদ্ধান্ত কলেজ স্তর থেকে শুরু করে জেনারেল বডি মিটিংয়েও গণতান্ত্রিকভাবে গৃহীত হয়েছে, কারো একার বা কোনো দলের অঙ্গুলিহেলনে এই আন্দোলন চলেনি এবং ভবিষ্যতেও চলবেনা।
আন্দোলন প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক নয়, কারণ কোনো রাজনৈতিক দলকে বা গোষ্ঠীকে আন্দোলনের স্বার্থেই এতে যোগ দিতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু বৃহত্তর অর্থে অরাজনৈতিক শব্দবন্ধটিই অলীক। একটা রাজনৈতিক খুন, রাজনৈতিক মদতপুষ্ট তথ্যলোপাট- এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ কোনোদিন অরাজনৈতিক হতে পারেনা। তবে এটুকু বলে যেতে চাই, ওই রক্তস্নাত চেয়ার আমাদের লক্ষ্য কোনোদিন ছিলনা- আমাদের একটাই দাবি ন্যায়বিচার, তাই থাকবে, সবচেয়ে বড় কথা আন্দোলন এখনো অনেক বাকি…