আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত সালতামামি
যেদিন সুপ্রিম কোর্ট আরজি কর তরুণী চিকিৎসককে নৃশংস ধর্ষণ এবং নৃশংসতম খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে কলকাতা হাই কোর্টে চলাকালীন কেসকে suo moto মামলা হিসেবে নিজের হাতে তুলে নেয়, সেদিন আমার উত্তমর্ণাকে বলেছিলাম – “কেসটা ঠাণ্ডা ঘরে চলে যাবেনা তো?”
আমার সংশয় থেকে গেল গতকালের (৩০.০৯.২০২৪) শুনানির পরেও। আইনানুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট suo moto মামলা ৫টি ক্ষেত্রে যার মধ্যে একটি “পাবলিক ইন্টারেস্ট” রক্ষা করার জন্য এবং একই সাথে “আইনের শাসন”-কে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। আরজি করের “অভয়া”র ধর্ষণ ও খুনের মামলায় এই দুটি বিষয়ই ওতোপ্রোতভাবে জড়িত।
এক অর্থে রাষ্ট্রশক্তির বিপুল ক্ষমতার সামনে আপাত-অসহায় জুনিয়র ডাক্তারেরা (যাদের পুঁজি কেবলমাত্র মেধা, সততা, নিষ্ঠা, সৌভ্রাতৃত্ব তথা camaraderie এবং চিকিৎসা করার বিশেষ ‘এক্সপার্টাইজ’) আজ অবধি সরকার এবং আইনী ব্যবস্থা থেকে কী কী পেল?
আজ (১.০১০.২০২৪) কলকাতার রাজপথে যখন লাখো মানুষের জনপ্লাবন তৈরি হয়েছে, সেসময় এখনো অব্দি বেগবান এই আন্দোলনের একটি stock taking করার অবকাশ আছে। এর একদিকে যেমন আছে রাজ্য সরকার এবং তার শক্তিশালী আমলা ও পুলিশবাহিনী, অন্যদিকে তেমন রয়েছে জুনিয়র ডাক্তারেরা, ডাক্তারসমাজের বৃহদংশ এবং গৃহকোণ থেকে নেমে আসা স্বতঃস্ফূর্ত নাগরিক অংশগ্রহণ। সুপ্রিম কোর্ট সমগ্র বিষয়টির ওপরে নজর রাখছে, নিজস্ব পর্যবেক্ষণ জানাচ্ছে – রাজ্য সরকার এবং জুনিয়র ডাক্তার উভয়ের ক্ষেত্রেই।
সুপ্রিম কোর্টের প্রথম দিনের শুনানিতে সময়সীমা বেঁধে দিয়ে জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে যোগ দেবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ ছিল – ১৮ থেকে ২৩ বছর জুনিয়র ডাক্তারেরা (সুপ্রিম কোর্টের ভাষায় আমাদের “সন্তানের মতো”) কাজের উপযুক্ত নিরাপদ পরিবেশ না পেলে কাজে যোগ দেবার সমস্যা মিটবে না। একে মানবিকভাবে দেখতে হবে। উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল রাজ্য সরকারকে। গতকালের (৩০.০৯.২০২৪) শুনানিতে সেভাবে জোর দিয়ে না বললেও সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য ছিল, ডাক্তারদের কাজে যোগ দেওয়া দরকার।
একটি আন্দোলনের জন্ম হয় অধিকাংশক্ষেত্রেই – ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি দীর্ঘদিন চলা ঐতিহাসিক রেলওয়ে ধর্মঘট কিংবা সাম্প্রতিক অতীতে কৃষকদের ঐতিহাসিক আন্দোলনের মতো কিছু আন্দোলন ছাড়া – জন্ম নেয় স্বতঃস্ফূর্তভাবে – বিশুদ্ধ আবেগ থেকে। পরবর্তীতে আন্দোলনের ব্যাপ্তি ও প্রসার (আনুভূমিক এবং সমান্তরাল, দুক্ষেত্রেই) আন্দোলনের নিজের dynamics এবং যৌক্তিক কার্যক্রম তৈরি করে। তাহলে যুক্তি ও আবেগ কী পরস্পরবিরোধী? ক্যালিফর্নিয়া ইন্সটিটিউট ওফ টেকনোলজির তাত্ত্বিক পদার্থবিদ Leonard Mlodinow তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত বইয়ে Emotional: How Feelings Shape Our Thinking (২০২২) দেখিয়েছেন, যুক্তি ও আবেগ ভীষণভাবে সংপৃক্ত। এদেরকে আলাদা করে দেখার প্রবণতা ঠিক নয়।
আন্দোলনের ব্যাপ্তি এবং প্রাপ্তি
এখানে আমাদের মনে রাখা দরকার, কোন পেশাজীবীদের আন্দোলনের ওপরেই “নাই ভুবনের ভার”। সে আন্দোলন নিয়ে সমাজের যত চাহিদাই থাক বা আন্দোলনকারীদের যত সৎ আকাঙ্ক্ষাই থাকুক না কেন।
আমি মনে করি, জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন ডাক্তারসমাজের এই প্রথম আন্দোলন যা pro-active, reactve নয়। আমরা প্রায় সবসময়ই রাষ্ট্রের দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় আন্দোলন করি। কিন্তু এই অভূতপূর্ব, হিংসা বা গর্জন-বর্জিত, বিপুল জনসমর্থনে পুষ্ট এবং নারীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে দীর্ঘস্থায়ী এ আন্দোলন সরকারকে অনেকটা দিশেহারা করে দিয়েছে। এরা reactive অবস্থানে যেতে বাধ্য হয়েছে। নিত্যনতুন স্ট্র্যাটেজি তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। সামজিক ক্ষেত্রে একটি নতুন নাগরিক পরিসরের উন্মোচন ঘটিয়েছে।
সরকারের তরফে স্ট্র্যাটেজিগুলো, আমার মনে হয়, পরপর এরকম –
১. আন্দোলন নিয়ে বিভ্রান্তি এবং অস্পষ্টতা তৈরি করা। যেমন প্রতিদিন-এ প্রকাশিত একটি খবর যথেষ্ট প্রচারিত হচ্ছে। একে হালকাভাবে না নিয়ে আমাদের তরফে স্পষ্ট ব্যাখ্যা ও বিবৃতি প্রকাশ করা দরকার।
২. সরকারের বিভিন্ন স্তরের নেতা-নেত্রী হুমকি সহ আরও বিভিন্ন ধরনের প্ররোচনা দেবে। এগুলোকে আমাদের তরফে প্রমাণ হিসেবে সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করতে পারলে ভালো হবে মনে হয়।
৩. সরাসরি আক্রমণ, যেমন সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজে হল। একে স্বতঃস্ফূর্ত জনরোষ হিসেবে দেখার সঙ্গে শাসকদলের যে mass base আছে তাকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করার ধরন হিসেবেও দেখা দরকার। এর সঙ্গে মাথায় রাখুন, হুমায়ুন কবীর বা ভাতারের বিধায়কের মুখনিঃসৃত লাগাতার হুমকি। এবারে শাসকদল তার গণভিত্তিকে ব্যবহার করে সামজিক সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেবার নতুন নতুন চেষ্টা চালাবে।
আমরা কী দেখছি?
১. আমরা একটি অসম যুদ্ধে নেমেছি। পবিত্র ক্রোধ, সততা, নিষ্ঠা, বিবেক এবং বুদ্ধিমত্তা ছাড়া আর কোন পুঁজি নেই। ফলে প্রতিটি পদক্ষেপ সমবেতভাবে আলোচনা সাপেক্ষে নেওয়া দরকার। এখানে জুনিয়র-সিনিয়র ডাক্তার এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের সম্মিলিত মতামত তৈরির প্রয়োজন রয়েছে।
২. আইনী লড়াইয়ের পাশাপাশি মাটির লড়াই বেশি জরুরী। এখানেই আন্দোলনের জয়-পরাজয় নির্ভর করবে।
৩. সর্বোপরি, আমাদের ঐক্য অটুট রাখা একমাত্র মন্ত্র হওয়া দরকার।
৪. শুধু এটুকুই নয়, এ আন্দোলনের অভিঘাতে নারীরা সামাজিক সুরক্ষা এবং ব্যক্তি নারীর স্বাতন্ত্র্যচিহ্ন খুঁজে পেয়েছে। সমস্ত নাগরিক সমাজ – সবরকমের দলীয় প্রভাবকে দূরে সরিয়ে রেখে – একটি নতুন পরিসর তৈরি করেছে। এরকম তৃতীয় পরিসর বা নাগরিক পরিসর স্মরণীয় কালের মধ্যে সমাজে উন্মোচিত হয়নি।
আমার মনে হয়, এ কথা আজ জোর দিয়ে বলার প্রয়োজন আছে যে, জুনিয়র ডাক্তারেরা সরকার ও রাষ্ট্রের তরফে সযত্নে তৈরি করা ‘legalized lawlessness’-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। এবং একটি সিস্টেমের মধ্যেকার নীরব “সন্ত্রাস সিন্ডিকেট”, সম্পূর্ণ অবৈধ ও অনৈতিকভাবে টাকার বিনিময়ে ছাত্রছাত্রীদের পাস-ফেল করানো বা নম্বর বাড়ানো, মর্গের মৃতদেহ বিক্রী থেকে নিম্ন মানের ওষুধ (কোন কোন ক্ষেত্রে ওষুধই নয়, গায়ে দেওয়া পাঊদার) সরবরাহের ঠিকাদারি থেকে কয়েক শ’ কোটি টাকা কামানো, ওয়েস্ট বেঙ্গল মেডিক্যাল কাউন্সিল এবং মেডিক্যাল শিক্ষাবিভাগের অভ্যন্তরের অবর্ণনীয় দুর্নীতি – সমস্ত কিছুর ক্লেদাক্ত আবরণকে একটানে খুলে ফেলে দিয়েছে আমজনতার সামনে।
আমজনতার কাছে নগ্নভাবে প্রশ্নটি উচ্চারিত হয়েছে – রাজা তোর কাপড় কোথায়?
পথের শেষ কোথায়?
পৃথিবীর কোন আন্দোলনই অনন্তকাল একই গতিবেগ নিয়ে চলতে পারেনা। সমাজবিজ্ঞান বা যেকোন বোধবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষই একথা বুঝবে। সম্মানজনক শর্তে জুনিয়র ডাক্তারদের এখন ধীরে ধীরে কাজে যোগ কাজে যোগ দেবার কথা ভাবতে হবে। এমন যেন না হয় – No Boat to Return।
সুপ্রিম কোর্টের শুনানির পরে আজ জুনিয়র ডাক্তারেরা তাদের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে – আন্দোলনের প্রথম দিন থেকে আমরা স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রশাসনিক পদক্ষেপ, কাজের ক্ষেত্রে শর্তহীন নিরাপত্তা (ডিউটির পরে নিরাপদ বিশ্রামের জায়গা সহ ব্যবহারযোগ্য টয়লেট এবং নারীদের সুরক্ষিত ও পৃথক রেস্ট রুম ইত্যাদি), এবং “সন্ত্রাস সিন্ডিকেট”-এর অবসান চেয়েছি।
কার্যত কয়েকটি সিসি টিভি লাগানো বা পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো একধরনের কসমেটিক ড্রেসিং – এর সাথে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হবার যোগাযোগ খুব সামান্যই। জুনিয়র ডাক্তারদের আবার কর্মবিরতিতে যাবার আগে দেওয়া ১০ দফা দাবী সম্বলিত প্রেস রিলিজের একটি অংশ হল –
এখানে যে প্রশ্নটি থেকে যায় তাহল, অভয়ার বিচারের দাবীতে আন্দোলন ডাক্তারেরা লাগাতার চালিয়ে যাবে, যেতেই হবে। কিন্তু সামাজিক ন্যায় অর্থে যাকে “জাস্টিস” বলা হয় তার দায়িত্ব এসে পড়ে আন্দোলনকারী গণসমাজের ওপরে। এটাই কাঙ্ক্ষিত। এছাড়া, আমার বিচারে, আগের অন্যসমস্ত জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনের মতো এ আন্দোলনও দিশেহারা হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকছে। যে বিপুল সম্ভাবনা এ আন্দোলন তৈরি করেছে তা যেন কোনভাবেই ধ্বস্ত না হয়।
সমর্থন করছি
আন্দোলনের সঠিক বিশ্লেষণ। পথ হিসেবে পূর্ণ কর্মবিরতির রাস্তা থেকে সরে আসা সম্মানজনক শর্তে, যেমন অভয়ার বাবা মায়ের অনুরোধে, এটা ভাবতে হবে।
আর সিনিয়র ডাক্তারদের তাদের বিশ্বব্যাপী যোগাযোগকে হাতিয়ার করে প্রচারের সাহায্যে, বিভিন্ন বিদেশের সংগঠনকে নিন্দা করার বিবৃতি দেবার ব্যবস্থা করে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াতে হবে, কেন্দ্র রাজ্য দুই সরকারের ওপর।
Right ✌✌✌✌🙏🙏🙏
সুন্দর আ পা না র লেখা🙏🙏🙏
Junior Doctors der andolon ke kurnish janai.
Excellent
The wheels of our legal system move (if at all) very very slowly leading to a sense of despair and depression. A recurring question which often keeps me awake at night is: what can I/we do to bring about the changes?
এই ধীরে ধীরে কাজে যোগ দেওয়া প্রয়োজন , নাহলে সাধারণ মানুষের সমর্থন হারাব আমরা । সেই সঙ্গে আবার এটাও ভাবার দাবী দাওয়া গুলো বিশ বাঁও জলে চলে যাবে ।। গ্রামের মানুষ এখনো সক্রিয় ভাবে এ আন্দোলনে সামিল হয়নি একেবারেই –তাঁদের বোঝাতে হবে । বিভিন্ন ভাবে –লিফলেট ছাপিয়ে , গ্রামে ছোট ছোট পথসভা করে ইত্যাদি ।।
এত বছর পরে নবীন ডাক্তার সমাজ যখন জেগেছে তাদের প্রতি পূর্ণ সমর্থন রইল
Sudhu Junior dr noi protiti maa baba protiti manush er andolan eta . Purno samarthan janai🙏🏼
ছাত্রদের এই আন্দোলনকে কুর্নিশ, এদের জন্যই থ্রেট কালচার, পরীক্ষার নামে অনাচার, আরো অনেক কুকীর্তির কথা সামনে এসেছে,ছাত্র আন্দোলন পরে ঘুঘুর বাসা থেকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কে মুক্ত করতে, তবে গত আন্দোলনে সিনিয়র ডাক্তাররা সর্বতোভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সচল রেখেছিলেন, এই মুহূর্তে সিনিয়র ডাক্তার দের যদি সেভাবে তারা পাশে না পান, তাহলে সরকারি মেডিকেল কলেজে স্বাস্থ্য পরিষেবা কিন্তু বিঘ্নিত হতে বাধ্য, আর সরকার কিন্তু এই সুযোগের জন্যই বসে আছে, এই আন্দোলনকে জনবিরোধী হিসেবে দেখতে আরো সুবিধে হবে, তাই জুনিয়র ডাক্তারদের কিন্তু খুব বিবেচনা করে এগোতে হবে, সাধারণ মানুষকে সাথে নিয়েই কিন্তু তাদের আন্দোলন করতে হবে, তাদেরকে ক্ষেপিয়ে দিলে কিন্তু হবে না, তাই রিলের মাধ্যমে যদি করা যায় সেটা দেখতে হবে