জ্যামজটহীন ফাঁকা রাস্তা, বাসে জানলার ধারের সিট, ফুরফুর করে হাওয়া আসছে — তবু সুতপার ভুরুর জটটা কাটছিল না একটুও। ভিক্টোরিয়ার বাগান আলো করে ফুরুশ ফুটেছে, রেড রোডের ধার বরাবর রাঙা হয়ে ফুটে রয়েছে পলাশ — কিন্তু সুতপার কাঠখোট্টা মনে সে সব প্রাকৃতিক শোভা মোটে আঁচড়ই কাটতে পারছিল না।
শ্যামবাজারের বাপের বাড়ি থেকে ফিরছে সুতপা। নববিবাহিত নয়, সুগতর বছর চারেকের পুরোনো বউ সে, তবু এই চার বছরে হাতে গুণে মাত্র দু’তিনবার বরকে ছাড়া বাপের বাড়িতে রাত কাটিয়েছে।
না, প্রেম নয়, তীব্র বরাসক্তিও নয় — আসল কারণ সুতপার অসম্ভব, প্রচণ্ড, মারাত্মক রকমের সন্দেহবাতিক।
যেমন এই মুহূর্তে, বাস যখন বিদ্যাসাগর সেতু পেরোচ্ছে, অস্তগামী সূর্যের আলোয় ঝিকিয়ে উঠছে গঙ্গার জল, সুতপার অকাব্যিক ভাবনার ঘূর্ণিতে কেবলই ঘাই মেরে উঠছে একটা সন্দেহ — কাল রাত বারোটা থেকে সকাল ন’টা পর্যন্ত সুগতকে ফোনে বারবার কল করেও পায়নি কেন? ঘুমোচ্ছিল? ফোন সাইলেন্ট করে? একা? নাকি ফাঁকা ফ্ল্যাট, বউ নেই, এই সুযোগে আর কাউকে নিয়ে —–
ছুটির দুপুরে জম্পেশ করে একটা আয়েসি ভাতঘুম দিচ্ছিল সুগত। আজ যদিও রোববার, তবে তার ব্লাডব্যাঙ্কে রক্তদান শিবিরের সংখ্যার স্বল্পতার কারণে এই দুর্লভ ছুটিটা সে বাগাতে পেরেছিল। বলতে নেই, সে একটু খাদ্যরসিক। আর তার বউটা খাণ্ডার হলেও রাঁধে ভাল। গতকাল বাপের বাড়ি যাওয়ার আগে সুতপার রেঁধে যাওয়া চিকেনের কষা আর বাসন্তী পোলাও লাঞ্চটাইমে প্রাণভরে সাঁটিয়ে, অগোছালো বিছানায়, ফ্যানের নিচে শুয়ে খবরের কাগজ ঘাঁটতে ঘাঁটতে জব্বর একখানা ঘুম এসে গিয়েছিল তার।
একটা তীব্র চিৎকারে ঘুমটা ফালাফালা হয়ে গেল সুগতর। চমকে জেগে, বিষম খেয়ে, ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসতে বসতে তার কানের পর্দা এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল বউয়ের তীক্ষ্ণ গলা —
”বলি, এই নাইটিটা কার? কাআআআর এই বিচ্ছিরি জংলা ফুলছাপ সাটিনের নাইটি? আমার বাড়ির সোফার উপরে এটা কি করছে? অ্যাঁ?”
সোফার উপরে গতকালের কাচা, শুকনো জামাকাপড়ের স্তূপে জংলা ফুলছাপ নাইটি আবিষ্কারের পরে ঘন্টা দুই কেটে গিয়েছে। রহস্য সমাধান হওয়ার পরিবর্তে আরো ঘনীভূত। সুতপা বাপের বাড়ি যাওয়ার আগে কাল ওয়াশিং মেশিন চালিয়ে হপ্তাখানেকের হেগো-বাসি জামাকাপড় (দু’জনেরই) কেচে দু’কামরার ফ্ল্যাটের একচিলতে বারান্দার দড়িতে মেলে দিয়ে গিয়েছিল। দোষের মধ্যে সুগত বিকেলে হাসপাতাল থেকে ফিরে সব শুকনো কাপড়গুলো তুলে পাঁজা করে সোফার উপর ফেলে রেখেছিল — বাইরে রাখলে বৃষ্টি বাদলা হলে ভিজে একশা হবে। কাপড়চোপড় পাট করা তার পোষায় না, ওসব বউ এলে করবে’খন।
তা, সে থোড়াই দেখতে গেছে কি তুলল আর কি রাখল।
সুতপার ব্যাঘ্রীগর্জনের মুখে সে মিনমিন করে শুধু বলেছিল —
”যা শুকোতে দিয়ে গেছিলে, তাই তুলে এনেছি। অত দেখেছি নাকি?”
”কি দ্যাখোনি? আমার নাইটি তুমি চেনো না?”
সুগত আহ্লাদ করে বলতে গিয়েছিল — ”সত্যিই চিনি না। নাইটির মধ্যের মেয়েটাকে তো চিনি” —
ভীত, উদ্বিগ্ন মুখে আদুরে কথা তেমন ফুটল না, দুশ্চিন্তায় গলার কাছটা শুকনো শুকনো লাগছিল — তার উপর সুতপার আগুনে হলকায় সামান্যতম দাম্পত্য রসাভাসও শুকিয়ে খরখরে হয়ে গেল —
”নারকোলে কুলের মতো মুখ করে সোহাগের কথা বলতে লজ্জা করে না? কেউ নির্ঘাত এসেছিল কাল রাতে! ঐ জন্য আমি সারারাত ফোনে পাইনি তোমায়। কে এসেছিল ভালোয় ভালোয় বলো! সোজা সাপটা সত্যি কথা চাই, নয়ত ভাল হবে না তোমার পক্ষে” —
মাথাফাথা চুলকে সুগত বলে ফেলল — ‘হ্যাঁ, এসেছিল তো! ব্লাডব্যাঙ্কের অভিজিৎদা”।
এক মুহূর্ত থমকালো সুতপা। ”অভিজিৎদা?” — যেন এই নামটা প্রত্যাশা করেনি সে। তারপরেই দ্বিগুণ তেজে প্রশ্ন ধেয়ে এলো — ”সঙ্গে কে ছিল? অভিজিৎদাকে তো ভাল বলেই জানতাম। তারও পেটে পেটে এত — সঅব তোমার পাল্লায় পড়ে! তোমার মতো একটা লুচ্চা লুম্পেনের পাল্লায় পড়ে — ইশশ, একটা পাঁচ বছরের ছেলের বাবা যে অভিজিৎদা — ছিছিছিছি!”
”কি বলছ কি যা-তা! আমরা দুজনে হসপিটাল থেকে ফিরছি — অভিজিৎদা বলল, দূর শালা, বাড়ি গেলেই এক্ষুণি বউয়ের ফরমাশ শুনতে হবে — মাছ নেই একটুও, আলু ফুরিয়েছে, বাবলুর ড্রয়িং খাতাও শেষ, লণ্ড্রিতে যাও, এতগুলো ইস্তিরি করানোর আছে — লাইফ হেল হয়ে গেল রে বিয়ে করে! তার চেয়ে চল তোর ওখানে খানিক আড্ডা মেরে রাত করে বাড়ি ফিরব — দোকান টোকান বন্ধ হওয়ার পরে। এইটুকু তো রাস্তা — অটো টোটো না পেলে স্রেফ হেঁটে মেরে দোবো। আরো বলল, সুতপা নেই, তোর বাড়ি তো আজ ব্যাচেলর্স ডেন — চল, একটু মস্তি করি, বলে চৌমাথার দোকান থেকে একটা রয়াল স্ট্যাগ আর একটু চপ-ফুলুরি –“
“হুম” — সুতপা কঠোরভাবে প্রশ্ন করে —
“তা অভিজিৎদা এসে জামাকাপড় ছেড়েছিল নাকি এখানে?”
“আঃ, আবার আলতু ফালতু বকছো। জামাকাপড় ছাড়তে যাবে কেন? একটু আড্ডা টাড্ডা মেরে ঐ রাত সাড়ে দশটা এগারোটা নাগাদ বাড়ি চলে গেল” —
“শুধু আড্ডা মেরে বোলো না”, সুতপার গলা ছুরির মতো ধারালো —
“বলো ঢুকুঢুকু করে, রাজ্যের পচা নোংরা জোকস নিয়ে হাসাহাসি করে, ফিলমের হিরোইন আর পরের বউদের নিয়ে রসালো আলাপ সালাপ করে, তবে গেল”।
সুগত একটু হাঁফ ছাড়বার অবকাশ পেলো এতক্ষণে! যাক বাবা, তিরটা যেন একটু একটু অভিজিৎদার দিকে বেঁকছে।
তবে স্বস্তি স্বল্পস্থায়ী। দু’মুহূর্ত পরে ফের সুতপার হুকুম — “ফোন লাগাও”।
“মানে? কাকে?”
“কাকে আবার? ন্যাকা! অভিজিৎদাকে ফোন লাগাও”।
“ইয়ে, মানে কেন?”
অগ্নিদৃষ্টিতে সুগতকে ভস্ম করতে করতে সুতপা বলল — “কলটা করো। বলছি”।
আরো কিছুক্ষণ পরে সুগত আবিষ্কার করলো একটা গুটিয়ে যাওয়া কেন্নোর মতো সে ফোনে অভিজিৎদার কাছে প্রশ্ন রাখছে স্তিমিত গলায় — “বাই এনি চান্স, মানে, কাল, মানে গতকাল সন্ধেবেলা তুমি কি বৌদির একটা নাইটি নিয়ে এসেছিলে আমাদের ফ্ল্যাটে?”
আরো ঘন্টাখানেক কেটেছে। দুপুরের পোলাও, রামপাখি সব হজম হয়ে গিয়ে একটু খিদে খিদে পাচ্ছে সুগতর। কিন্তু জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির সামনে খাবারের দরবার করার সাহস তার অন্তত নেই। তার উপর অভিজিৎদার খ্যাঁকখেঁকে হাসিটা এখনো কানে বাজছে। গা-টাও চিড়বিড় করছে অপমানে, কিন্তু মুখ খোলার জো নেই। অগত্যা চুপিসাড়ে রান্নাঘরে ঢুকে দেওয়াল আলমারি খুলে বিস্কুটের কৌটোটা হাতড়ে গোটাকয় ক্রিমক্র্যাকার পেটে চালান করে সুগত। আজকাল বিস্কুটগুলোও এত খাস্তা বানায় শালারা, নিঃশব্দে খাওয়ার উপায় নেই। এদিকে ছোট্ট সাড়ে পাঁচশো স্কোয়ারফিটের নৈঃশব্দ্যে বিস্কুট চিবোনোর কচরমচর কানে গেলে সুতপার বাক্যবাণ সিরিয়ালের ডায়লগের মতো আছড়ে পড়বে, জানে সে। তাই বিরসবদনে বোতলের জল দিয়ে বিস্কুটগুলো কোনোমতে গিলছিল সুগত।
ওদিকে সুতপাও মুখে কুলুপ এঁটে সোফার উপর বসে রয়েছে একভাবে — বাইরের কাপড় ছাড়ার কথাও মনে নেই তার।
সুগতকে বিশ্বাস করা যায় না, কোনোমতেই যায় না।
এই তো ক’দিন আগে সবে ইভনিং ডিউটিতে হাসপাতালে পা রেখেছে কি রাখেনি, শ্রাবণীর ফোন এলো। “অ্যাই শোন, তুই কোথায় রে?”
“কেন? ডিউটিতে। এই তো এলাম —“
“শোন না” — শ্রাবণীর ফিসফিসে স্বরে যেন কোনো ষড়যন্ত্রের পর্দাফাঁসের আভাস —
“সুগতদাকে দেখলাম। একটা ট্রলিব্যাগ নিয়ে হেস্টিংসের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে, বোধহয় শালিমারের বাস ধরবে — সঙ্গে একটা চিমড়ে মতো মেয়েও ছিল, তার সঙ্গেও ঐরকমই একটা ভারি ট্রলিব্যাগ। কি হেসে হেসে কথা বলছিল দু’জনে — কি রে, কার সঙ্গে কি চালাচ্ছে সুগতদা? ইলোপ ফিলোপ করার প্ল্যান করে ফেলল নাকি? তুই এক্কেবারে অন্ধকারে? কিচ্ছু আঁচ পাসনি?”
আর শুনবে কি, মাথাটা এমন ঘুরে উঠেছিল সুতপার, যে আর ডিউটিই করতে পারেনি সেদিন। প্যাথোলজি ল্যাবের রোস্টারের দায়িত্বে থাকা সিনিয়র টেকনিশিয়ান মুক্তিদির বাছা বাছা গা জ্বালানো বিশেষণ আর বরের কীর্তির সংশয়ে জ্বলতে জ্বলতে কোনো মতে বাড়ি ফিরে দেখেছিল, সুগত একটা চিপসের প্যাকেট আর জাম্বো কোল্ড ড্রিংকের পেট জার নিয়ে টিভির সামনে বসে আয়েস করে ‘বাহুবলী’ দেখছে।
সোফার পাশে একটা বড়সড় সাইজের খয়েরি রঙের সফট ট্রলি দাঁড় করানো রয়েছে।
ওকে ঢুকতে দেখে চিপস চিবোতে চিবোতেই অম্লানবদনে তার বর বলল, “ডিউটি গেছিলে যে! ছুটি নিয়ে ফিরে এলে বুঝি? বেশ করেছ। একটু এগ চাউমিন করো না, ক্যাম্পে শালারা খাওয়ায়নি ভাল করে, স্রেফ চাট্টি ডালভাত আলুভাজা আর মাছের ট্যালটেলে ঝোল — তবে হ্যাঁ, ভবানীপুরের এই ক্লাবটা গিফট ভালই দিয়েছে। দ্যাখো, ট্রলিব্যাগটা কি বড় সাইজের! আমি তো প্রথমে ভেবেছিলাম শুধু ডোনারদের দেবে। তারপর দেখি আমাদের পাঁচজনকেও — অনামিকা ছিল আমার সঙ্গে টেকনিশিয়ান হিসেবে। সেই বেহালার অনামিকা গো, গত বছর ওর বিয়ের রিসেপশনে মাটন কবিরাজি খাইয়েছিল, মনে নেই? ওর চয়েস মাইরি এক্কেবারে ছাপড়ি — লাল রঙের ট্রলি নিয়েছে — আমি এই কালারটা পছন্দ করেছি। কি গো, ভাল না? যাও যাও, মুখ হাত ধুয়ে একটু চাউমিন বানাও প্লিজ — দুজনেই একটু খাই — তুমিও তো অনেকক্ষণই বেরিয়েছ ভাত খেয়ে, খিদে পায়নি?”
বিয়েতে পর্যন্ত কি কাণ্ড করেছিল সুগত, ভুলেছে কি সুতপা? প্যাথোলজি ডিপার্টমেন্টের হেডস্যার নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন বিয়েতে। বিয়ের দু’মাস আগেই চাকরি পেয়েছে সে, বসকেও আমন্ত্রণ জানাতে হয়েছে তাই। এদিকে জয়েনিংএর সময় যে সুগতকে নিয়েই কাজে যোগ দিতে গিয়েছিল, আর পিতৃপ্রতিম বসের কাছে ‘আমার দাদা’ বলে পরিচয় দিয়েছিল, সে কথা ততদিনে বিলকুল উড়ে গিয়েছে তার মাথা থেকে।
সে ভুললেও, দেখা গেল বস ভোলেননি। বিয়ের আসরে বরের সঙ্গে আলাপিত হওয়ার মুহূর্তে ভুরুটুরু কুঁচকে বলে উঠেছিলেন — “তোমাকে কেমন চেনা চেনা লাগছে, কোথায় দেখেছি বলো তো?” এবং পরক্ষণেই ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে বলে ফেলেছিলেন —“তোমাকেই তো দেখেছিলাম সুতপার জয়েন করার দিনে — কিন্তু তুমি, তুমি তো ওর দাদা –“
সুগত কোঁচাটোঁচা সামলে সুপার স্যারের মুখে প্রায় থাবা দিয়ে বলে উঠেছিল — “না স্যার, মানে হ্যাঁ স্যার, ওই দাদাব্বর আর কি –“
“ক্কি? ইয়ার্কি মারছ নাকি? দাদাব্বর আবার কি?”
“কেন হবে না স্যার,” বেশ সপ্রতিভভাবে বলেছিল সুগত, “ঐ যেমন অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর — তারপর ধরুন গে’ মান্যবর, বন্ধুবর, মাতব্বর, তেমনি দাদাব্বরও হয় বৈকি! হেঁ হেঁ হেঁ” —
এমন স্বভাবসিদ্ধ খচ্চরিত্রকে সে এই চার বছর ধরে বিশ্বাস করে এসেছে, ভাবতেই গা রি রি করে উঠছিল সুতপার।
ফ্ল্যাটের দরজার ল্যাচ ঘোরানোর শব্দে ঘোর কাটল তার। দেখতে পেল, দুঃস্বপ্নসম নাইটিটা হাতে নিয়ে সুগত বেরিয়ে যাচ্ছে ফ্ল্যাট থেকে।
তড়াক করে সোফা ছেড়ে উঠে পিছু নেয় সুতপা। যাচ্ছে কোথায় ব্যাটাচ্ছেলে, দেখতে হবে না? হাতেনাতে ধরার একটা সুযোগ পেতে চলেছে মনে হচ্ছে।
তাদের ফ্ল্যাটবাড়িটা পাঁচতলা, মানে জি প্লাস ফোর। ওরা থাকে চারতলায়। ল্যাণ্ডিংএ বেরিয়ে সুতপা দেখতে পেল, সুগত গুটিগুটি পাঁচতলার সিঁড়ির দিকে চলেছে। উপরে দুটো অ্যাপার্টমেন্টের মধ্যে একটিতে এক মারোয়াড়ি পরিবার থাকে, অন্য ফ্ল্যাটটা খালি।
খানিক পরে সুগত ‘শুভ লাভ’ লেখা, গণেশের ছোট ল্যামিনেট সাঁটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেলে আঙুল ছোঁয়ালো। পিছনে সুতপা।
দরজা খুললেন এক পৃথুল মধ্যবয়সী। “কেয়া হ্যায়?”
সুগত হাতের নাইটিটা তুলে দেখিয়ে স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করল — “এটা হামলোগকা বারান্দামে মিলা। আপলোগ ভি তো কাপড়চোপড় উপরকা বারান্দামে শুখাতা হ্যায়, হাওয়া মে উড়তে উড়তে হামলোগকা ব্যালকনি মে গির গিয়া কিনা জাননে কে লিয়ে আয়া” — বেচারার হিন্দিটা শেয়ালের লেভেলেই রয়ে গিয়েছে — সে জন্য ব্লাডব্যাঙ্কের ঠেট হিন্দি বলা বাঙালি ডাক্তার ম্যামের কাছে কম বকুনি খায়নি সে এতকাল!
ভদ্রলোক চোখ টোখ কুঁচকে তার হাতের বস্তুটি ভালভাবে নিরীক্ষণ করার ফাঁকে তাঁর পিছন থেকে আবির্ভূত হলেন এক ক্ষীণাঙ্গী মধ্যবয়সিনী।
“আরেরে, গুল্লু কে পাপা, পেহচানা নহী, ইয়ে হি তো উয়ো নায়টি হ্যায় — কল সে লাপতা থা, বড়কি কে সসুরালবালো নে দিয়া থা পিছলে দিওয়ালি পে — ইয়াদ নহী আপকো” — এই বলে সুগতর হাতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আদরণীয় বস্তুটি ছোঁ মেরে তুলে নিলেন তিনি।
শুকনো ধন্যবাদ বা সরস মিষ্টিমুখ, কোনো কিছুর ধার না ধেরেই হতভম্ব বাঙালি দম্পতির মুখের উপর ধড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল সিদ্ধিদাতার লেবেল মারা দরজা।
ঘন্টাখানেক বাদে সুতপা একটু অনুতপ্ত মুখে কয়েকখানা লুচি আর বেগুনভাজা দিয়ে সাজানো থালাটা তুলে ধরে সুগতর সামনে।
যতই অভিমান আর ক্ষোভ গজগজ করুক না কেন সুগতর মনে, নিখুঁত গোল সাদা ফুলকোগুলোর সামনে সে অভিমান টেঁকানো দায় হয়। তার উপর বউ যদি হাতে ঘন সরপড়া রসমালাইয়ের বাটি নিয়ে আরো একটু ঘন হয়ে পাশে বসতে আসে, ক্ষোভটোভগুলোরও যে চিরস্থায়ী ধর্মঘটে যাবার জোগাড় হয়, সে কথা তার চেয়ে ভাল করে কে আর জানে!
স্বর্গীয় তৃপ্তি নিয়ে বউয়ের উষ্ণ সান্নিধ্যে লুচি চিবোতে সুগতর কানে এলো, পাশে রাখা মোবাইল বাজছে। যন্তরের পর্দায় অবহেলায় একবার দৃষ্টিপাত করেই তার গলায় লুচি আটকে যাবার জোগাড় হলো। নীলচে স্ক্রিনে মোটা মোটা কালো অক্ষরে লেখা রয়েছে — রাজ্যশ্রী (চণ্ডীতলা) কলিং!
যতক্ষণে একটু ধাতস্থ হয়ে মনে পড়ল যে এটা সেই চণ্ডীতলার স্টেট অ্যাওয়ার্ড পাওয়া বিখ্যাত কুস্তিগিরদের আখড়ার নম্বর, যারা সামনের রোববার রক্তদান শিবিরের আয়োজন করছে তাদের ব্লাড ব্যাঙ্ক মারফত, ততক্ষণে ফোন চলে গিয়েছে সুতপার হাতে। তার চোখ ফের বিস্ফারিত, ঠোঁট থরথর করে কাঁপছে।।”কে, কে এই রাজ্যশ্রী? বলো, বলো, বলতেই হবে তোমায়, নয়ত ছাড়ছি না” — এই বলে তার টি শার্ট গলার কাছে মুঠো করে ধরে ঝাঁকাতে থাকে সুগতর শক্তিময়ী স্ত্রী। প্রতি ঝাঁকুনির সঙ্গে ইনস্টলমেন্টে এক একটি শব্দ বেরোয় ফোঁপানিকে সঙ্গী করে,
“থাকো মন্দিরতলায়, কাজ করো নিমতলার কাছে, আর পরকীয়া করতে ছোটো চণ্ডীতলায়? লজ্জা করে না?”
ছবি: আন্তর্জাল