সেদিন সন্ধ্যায় আমাদের আধবুড়ো টেকো ডাক্তার বিমলবাবুর ফাঁকা চায়ের দোকানে বসে বসে মশা মারছিলেন। চমৎকার সব কেঁদো কেঁদো মশা। বিমলবাবু একটা এফএম রেডিওতে কথোপথনের ফাঁকফোকরে গুঁজে দেওয়া বাজনাগান শুনছিলেন। এমন সময় শ্রীযুক্ত দোলাইবাবু (মনে রাখবেন দলুই আর দোলাই সম্পূর্ণ আলাদা) “বড়ো ভয়ে আছি গো ডাক্তার ….বড্ড ভয়”
“হ্যাঁ হ্যাঁ বিলক্ষণ বিলক্ষণ যের’ম দিনকাল পড়েছে তাতে ভয়ের আর দোষ কি?”
দোলাইবাবু কিয়ৎকাল ক্ষ্যান্তবুড়ির দিদিশ্বাশুড়ির মতো চোখে চেয়ে থাকলেন। তারপর ঘ্রুঁৎ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন “ধুর বাবা, ওকথা কে বলেছে? আমি মরে যাওয়ার কথা বলছিলাম …”
“মানে পটল উৎপাটন করা বা পটল তোলার কথা বলছেন?”
দোলাইবাবু সন্দিগ্ধ চোখে চেয়ে রইলেন “ডাক্তার, তুমি কি সত্যিই ডাক্তার? এই ভাষায় মৃত্যুর কথা বলছ? একি তোমার শোভা পায়?”
ডাক্তার চটাশ করে আরেকটা বিধর্মী মশা হত্যা করে বললেন “ধরুন না, কেন আপনার অ্যায়োর্টিক অ্যানিউরিজম আছে … কৈ ধরুন?”
“ধরলাম”
“ওটা ফাটলেই হুশ করে মরে যাবেন”
“ঐ অ্যা না কি ছাতার ঐ কি যেন বললেন? ওটা কি? বোমা? অ্যাটম বোমা?”
“না গো মশয়। ধরুন … না, না, আর ধরতে হবে না। ওটা হলো যদি কোনও ধমনীর পেশী দুর্বল থাকে তাহলে রক্তের চাপে ধমনীটা ফুলতে থাকে … ফুলতে থাকে .. তারপর ফট করে ফেটে যায় .. হুশ হুশ করে শরীরের ভেতরে রক্তপাত হয় আর আপনার প্রাণপাখি ফুশ করে পিঞ্জর ছেড়ে উড়ে যায়। কেউ দেখে বুঝতে পারবে না। বেশ মজা না?”
“ওটা আমার আছে নাকি?”
“থাকতেই পারে। থাকতেই পারে। আপনার ঘিলুতে কিম্বা পেটের ভেতর বা হৃদয়ের পাশে.. হে হে হে হে লিভারের ভেতরে”
“তাহলে উপায়?”
“উপায় কিছু নেই মশাই। এ আমি নিশ্চিত বললাম”
“জানার কোনো উপায়ই তাহলে নেই?”
ডাক্তার প্রথমে পাঞ্জাবির ডান পকেট থেকে, পরে বাঁ পকেট থেকে সর্বমোট দুটো রুমাল বার করে দোলাইবাবুকে শুঁকতে দ্যান “কোনটায় সর্দির গন্ধ আর কোনটায় ঘামের গন্ধ একটু শুঁকে বলবেন? আমার নাকে সর্দি – গন্ধ পাচ্ছি না..”
দোলাইবাবু মুখ বিকৃত করে শুঁকে লাল বর্ডার দেওয়া রুমালটা সর্দি মোছা বলে চিহ্নিত করেন।
“এটা শুঁকলেই বোঝা যাবে….. হোওওওয়্যাক থুঃ…. আমার ঐ ঐটা আছে কিনা?”
“না না, আমি আসলে কোন পকেটে কোনটা রেখেছি গুলিয়ে ফেলি। একবার তো হে হে হে হে হে সর্দিমোছাটা দিয়ে মুখ মুছে ফেললাম হে হে হে হে তাই আপনাকে দিয়ে…. হে হে হে হে” ডাক্তার একটা পটাকা (মতান্তরে পতাকা) বিড়ি ধরিয়ে বললেন “গোটা শরীরের অ্যাঞ্জিওগ্রামতো আর রোজ রোজ করা যায় না! তবে ফাটলেই মৃত্যু। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াও যাবে না তার আগেই সোওওজা…” বলে ঊর্ধ্বে আঙ্গুল দেখান।
দোলাইবাবু আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেন “কী অলুক্ষুণে লোক গো তুমি .. এই ভর সন্ধ্যায়…… রাম কহো …”
ডাক্তার ধুয়ো তোলেন -“রাম নাম সৎ হে রাম নাম…”
দোলাইবাবু কটমট করে তাকিয়ে একটা সিগারেট ধরান ।
“এছাড়া কৃমি থেকেও মরতে পারেন। এক্কেবারে হাতে গরম ফল। ধরুন একটা বড় কৃমিকীট সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়ে ভেবেছিল আপনার মুখ দিয়ে বেরিয়ে পৃথিবীটা দেখবে। ভুল করে শ্বাসনালীতে চলে গেল। ব্যস। ধড়ফড়িয়ে মরে যাবেন। এক্ষুনি। নিয়ে যাবে তক্ষুনি”
দোলাইবাবু কপালের ঘাম মোছেন।
“এছাড়া আরেকটা কৃমি আছে। লিভারে বা মাংস পেশীতে ডিম পাড়ে। ডিম ফেটে যে তরলটা শরীরে মেশে তাতে ভয়ানক অ্যালার্জি হয়ে শ্বাসনালী ফুলে উঠবে। নিঃশ্বাসের পথ বন্ধ। দমবন্ধ। ছটফট ছটফট। ব্যস। কাটা মুরগির মতো মরবেন”
দোলাইবাবু ক্ষীণকন্ঠে বলেন “বিমলদা, এক কাপ চা”
ডাক্তার ফাঁকতালে ফোকটে বলেন “ আমাকেও একটা। দোলাইবাবুর খাতায়।” চা পীতে পীতে ডাক্তার একটা মজাদারু হাসি দিয়ে বলেন
“পায়ে ব্যথা হয়? খুব?”
বিষণ্ণ দোলাইবাবু হেঁতিবাচক মাথা দোলান ।
“তাহলে পালমোনারি এম্বোলিজম হয়েও এক্ষুণি মরে যেতে পারেন। তাতে কোনও ক্ষেতি নেই”
“এম্বোম … এটা আবার কী বোম?”
“পায়ে বা শরীরের যে কোনও জায়গায় একটা রক্ত দলা পাকিয়ে ক্লট তৈরি করে তারপর সেটা রক্তের সঙ্গে সোওওওজা চলে আসে ফুসফুসে। বুকে ব্যথা … শ্বাসকষ্ট .. খেল খৎম”
“আমার হাঁটুতে ব্যথা তাতেও বোমটা থাকতে পারে?”
“না, সাধারণতঃ পায়ের কাফ মাসলে হয়। তবে একবার তখন আমি ছোট্ট বাচ্চা ..” ডাক্তার হাত দিয়ে একটা তিন বছরের বাচ্চার মাপ দেখান
“সদ্য ইন্টার্ন। একটা কোমর ভাঙা রোগী এসেছে। ভীড়ে ভর্তি ওয়ার্ড .. কোনোক্রমে রোগীকে একটা ট্রলিতে শুইয়ে.. জানেন তো ফিমার ভাঙলে কমপক্ষে হাফ লিটার রক্ত বেরিয়ে ভাঙা জায়গাটায় জমা হয়? তা .. সন্ধেবেলা একটা রক্ত চালিয়ে ছাত্রাবাসের কামরায় বসে আলুর চপে কামড় বসিয়েছি ব্যস … হয়ে গেল …”
বিমলবাবুও এখন গল্পোন্মত্ত “কি হয়ে গেল?”
“খেল খৎম আলুর চপ হজম। রোগী মরে গেল। তখন সালটা ঊনিশশো ছিয়াশি। আমি আর ডাক্তারবাবু বাকি রাতটা রোগীর বাড়ির লোকের তান্ডবে বাথরুমে লুকিয়ে থাকলাম .. বেশ মজা হয়েছিলো .. ছাত্রাবাসে কয়েকদিন জল ছিলো না তো .. চমৎকার খুশবুদার রাত কাটিয়েছি …. মা বাবা জানতে পারলে ডাক্তার হার্ট অ্যাটাক হয়ে কঅঅঅবে মরে যেতো”
দোলাইবাবু ভয়ে ভয়ে বলেন “রোগীর কি হয়েছিলো? রক্ত দিতে গন্ডগোল?”
ডাক্তার অবলীলায় দোলাইবাবুর পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে নিয়ে বললেন “ভাঙা হাড়ের থেকে চর্বির টুকরো রক্তে ঢুকে গিয়ে ফ্যাট এম্বোলিজম .. তৎক্ষণাৎ পটল ..”
দোলাইবাবু হেঁচকি তোলেন “এসব কি বলছো গো ডাক্তার? আমার বুক ধড়ফড় করছে ..”
“সব থেকে বেশী লোক হার্টের রোগেই হঠাৎ করে মরে – য্যামন ধরুন ভেন্ট্রিক্যুলার ফ্লাটার … বা..”
“এয়ার কুলার?”
“আরে না না হঠাৎ করে হৃদস্পন্দন ভীষণ বেড়ে যাওয়া, হার্ট অ্যাটাক এসব তো জানে গাঁয়ের পাঁচজনা..”
“আগে কোনও লক্ষণ থাকবে না?”
“সব সময় না। এছাড়া হঠাৎ করে দুদিকের ক্যারোটিড আর্টারি বন্ধ হয়ে যাওয়া …”
“তাহলে বাঁচার উপায়?”
“গৌতমদার নাম শুনেছেন?”
“কোন গৌতম? গম্ভীর? না দেব?”
“না, না, লুম্বিনির শাক্য বংশের ছেলে। খৃষ্টপূর্ব পাঁচশো বছর আগে জন্মেছিলেন। জরা মৃত্যু আর ব্যাধির হাত থেকে বাঁচার পথ খুঁজতে উনি প্রচুর তপস্যা করেন। না খেয়ে – না ঘুমিয়ে সে এক ভয়ঙ্কর তপস্যা। তারপর সুজাতা নামের একটি খাটাল মালিকের মেয়ে ওনাকে পায়েস খাইয়ে একটা সন্তান কামনা করে। তখন বুদ্ধ তার কামনা পূর্ণ হবে বলে আশীর্বাদ করেন। তারপর বুঝতে পারেন জরা ব্যাধি মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তির উপায় নেই। বরং পায়েস টায়েশ খেয়ে আয়েশ করা ভালো। যান সবাই সব নিজকার্যে, এখানেই ক্ষ্যান্ত দিই।” ডাক্তার মৃদু মৃদু হাসেন। যাই হোক ফ্রিতে একটা সিগারেট আর একটা চা পাওয়া গেছে। কম কী?
অসাধারণ।
ধন্যবাদ
ওয়াও!!
ধন্যবাদ
Like!! Great article post.Really thank you! Really Cool.
Moved by your comment
ধন্যবাদ
I really like and appreciate your blog post.
I am honoured
ধন্যবাদ
I like the valuable information you provide in your articles.
Thank you
I always spent my half an hour to read this web site’s articles or reviews daily along with a mug of coffee.
It’s great to be of your help.
I love looking through a post that can make people think. Also, many thanks for permitting me to comment!
I am honoured.